ভূত বিলাসের ঘর

আত্মজীবনী ১৭

শ্রেয়া চক্রবর্তী

প্রকাশিত : জুলাই ২৭, ২০১৮

উচ্চ মাধ্যমিকের পর ইংলিশ লিটরেচারে অনার্স নিয়ে ভর্তি হই শ্রীরামপুর কলেজে। উইলিয়াম কেরী প্রতিষ্ঠিত হুগলি জেলার এই প্রাচীন ও স্বনামধন্য কলেজটি ছিল গঙ্গা নদীর ধারে। প্রবীণ স্থাপত্যের গায়ে প্রাচীন অশ্বত্থের পাতা ঝরা আর নবীন জল হাওয়ার মতো আমারও সেই চিত্রকল্পের সাথে মিশে যেতে চাওয়ার মধ্যে লেগে ছিল নেহাতই কবিতাদোষ। কলেজের ছাত্র উইনিয়নের তৎকালীন জি.এস ছেলেটি ছিল বেশ সৌম্যকান্তি। সে আমার রেজাল্ট দেখে বললো, ‘সেকি! ইংলিশ কেন? বলতো ফিজিক্সে ট্রান্সফার করেদি। এখনো সময় আছে।’ আমি একটু মুচকি হাসি দিতে সে বললো, ‘আচ্ছা সে তোমার ব্যাপার। তবে এসো মাঝে মাঝে।’ আমি ছাত্র রাজনীতির কিছুই বুঝি না, ঘাড় কোনদিকে কাত করবো না বুঝে সোজা হয়ে বসে ছিলাম।

তারপর থেকে আস্তে আস্তে বেউলফ, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কোলরিজ, শেকসপিয়র, ব্লেক, ইয়েটসে ডোবা শুরু হয়। প্রত্যেক কবিই সময়োত্তীর্ণ এবং একে অপরের থেকে ভীষণভাবে আলাদা, যেন আলাদা আলাদা ফল থেকে সংগ্রহ করা মদ আলাদা আলাদা পাত্রে মাটির নিচে সূর্যালোক থেকে দূরে জমিয়ে রাখা ছিল বহুদিন। যে পাঠক সেই জারণকাল পার করে দীর্ঘ সময়ের সরণী অতিক্রম করে পৃথিবীতে এসেছে, সেও সেই নেশার অংশীদার হচ্ছে তার মন-নে, এভাবে হাজার লক্ষ শিরা উপশিরা স্পর্শ করে এক একটি স্পন্দন ছড়িয়ে পড়ছে লক্ষ কোটি মস্তিষ্কে, একটা তরঙ্গকে বেষ্টন করে জন্ম নিচ্ছে সহস্র তরঙ্গ। যে কোনো উত্তীর্ণ রচনাই আসলে অনাগত সময়ের জন্য লেখা হয়। আমার মতো যে পাঠক কবির জীবদ্দশায় পৃথিবীর কোনো ধূলিকণাতেও ছিল না, সেও কোনো সময় অতিক্রান্ত তরঙ্গের ভেতর থেকে আদিম তরঙ্গটিকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতে চায়।

নিজেও লিখতে থাকি কবিতার হাত ধরে একদিন পাশাপাশি দাঁড়ানোর তাগিদে। একটি প্রকাশযোগ্য কবিতা লেখার আগে আমি অন্তত পাঁচশো কবিতা লিখেছি আর কেটেছি, যে কবিতার সম্পৃক্ততা নিয়ে যার সর্বাধিক সন্দেহ ছিল সে আমি নিজেই। একটি নির্দিষ্ট প্রস্তুতিকাল শেষ হওয়ার আগেই যদি কবিতা পাঠকের দরবারে চলে আসে, তাহলে নিজের সৃষ্টিকে মূল্যায়ন করার মতো যথাযথ মেরুদণ্ড তৈরি হয় না বলে আমার বিশ্বাস। ঠিক যেমন একটি শিশু একটি নির্ধারিত সময়কাল মাতৃগর্ভে লালিত হওয়ার পরেই প্রকৃতি তাকে পৃথিবীর আলো দেখার সার্টিফিকেট দেয়। তেমনি কবিতাও একটি মানসিক অবস্থা, যাকে বহুকাল একা একা আগে নিজের মধ্যে লালন করতে হয়।

কলেজে ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে আমার বেশিরভাগ সময় কাটতো লাইব্রেরিতে এবং গঙ্গার ধারে। সে সময় আমার নিজের ভেতর ডুব মেরে বসে থাকা স্বভাবটি গভীরতম অন্তর্দশায় ছিল। ক্লাসের মধ্যে শান্ততম মেয়েটি যার নাম ছিল সিমি, বরাবর আমার পাশে বসতো। কলেজ ছুটি হলে সে আমার সাথে স্টেশন অবধি যেত। তার আর আমার গন্তব্য এক ছিল না। তবু ট্রেন না আসা অবধি সে আমার প্ল্যাটফর্মে আমার সাথেই দাঁড়াতো। এই দাঁড়িয়ে থাকার মাঝে সে নিজের অনেক কথা আমাকে বলতো। সিমি কারোর প্রেমে ছিল। কোনো এক পড়ন্ত বিকেলে হাত ধরাধরি করে ফেরার সময় প্রেমিক তাকে কেমন করে ছুঁয়েছিল সে কথা বলতে বলতে হেসে লুটিয়ে পড়তো সিমি, লজ্জাবনত হাসি। সে হাসির অনুরণণে আমি দেখতাম অস্তগামী সূর্যের অনুকম্পা লাগা এক চুম্বনোন্মুখ তরুণ তরুণীর জলছবি। ট্রেন এলে আমাকে ট্রেনে তুলে দিয়ে তবেই সিমি বাড়ি যেত। আমি কোনোদিন কলেজে অনুপস্থিত হলে তার ফোন আসতো। তিন বছরের কলেজ জীবনে যতদিন অনুপস্থিত হয়েছি, প্রতিদিনের নোট সে সাজিয়ে গুছিয়ে আমার কাছে পৌঁছে দিত। আমি এসব কোনোকিছুই প্রত্যাশা করিনি তার কাছে, তবু সে করতো। একদিন প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে ফিরতি ট্রেনের অপেক্ষা করছি, সিমি আমার পাশে দাঁড়িয়ে, হঠাৎ আমাকে বললো, ‘জানিস শ্রেয়া, ওরা আমাকে ডেকে তোর নামে অনেক কিছু বললো।’ সিমি কয়েকজনের নাম বললো, তারা আমার সহপাঠী।
ওরা! ওরা কি বললো? ওরা তো কিছুই জানে না।
জানে না। তাই তো বলে। তবে যে যাই বলুক আমি তোকে খুব ভালোবাসি। সিমি আমার হাতটা ধরে খপ করে।

এর পর আমার আর কিই বা বলার থাকে? ওই `ওরা` যারা নাকি কিছু বলে, তাদের কোনোদিন প্রশ্ন করা হয়ে ওঠে না, ‘কেন?’। আর যে ভালোবাসে, ট্রেন না আসা অবধি পাশে থাকে, তাকেও কোনোদিন প্রশ্ন করা হয়ে ওঠেনি যে, ‘কেন?’ এই দুইয়ের মাঝখানে রেললাইন পাতা থাকে জীবনের। যাবতীয় নৈঃশব্দ্যের অতীন্দ্রিয় পরিসীমা ভেঙে দিয়ে ট্রেন এসে পড়ে হুঁইশেল বাজিয়ে। আমি ট্রেনে উঠে দেখি, তখনো সিমি দাঁড়িয়ে, দৃশ্যমানতার সীমা পার হয়ে যাওয়া অবধি সে হাত নাড়ে।

মেহফুজ কলকাতায় ফিরে চিঠি লেখে। সে বুঝতে পারে অনেক দ্বিধার পাহাড় বয়ে বেড়াচ্ছি নিজের ভেতর, অনেক আড়াল করে রেখেছি আমার মনের নির্জনতম চরাচর। সে লেখে, ‘আমি জানি তুমি প্রতিনিয়ত দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত। এই দ্বন্দ্ব থেকে মুক্তিলাভ সহজ নয়। কিন্তু অসম্ভব নয়। নিজেকে এত নিষ্ঠুরভাবে দমন কোরো না। নিরাপত্তাহীনতা আর অবদমনের যন্ত্রণা অসহ্য। আমি জানি এই দ্বিধা একদিন কেটে যাবে। এন্ডারসনের রূপকথার রাজহংসের মতো নিজেকে চিনতে পারবে তুমি। চারদিক উদ্ভাসিত করে নীল আকাশে উড্ডীন হবে। সেদিন হয়তো গর্বিত আমি চেয়ে থাকবো অধরা তোমার দিকে।’

মেহফুজ দেখা করবে বলে। আমি তার বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যাই। গোটা ইউনিভার্সিটি ঘুরে দেখি। শহরে সন্ধ্যা নামতে দেখি। অলিগলি থুম মেরে থাকে। পাখিদের উড়ে যাওয়া দেখি। মেহফুজকে নিজের হাতে এমব্রয়ডারি করা একটি রুমাল উপহার দেই। ফিরে এসে মনে পড়ে একটি আপ্তবাক্য, কোনো বন্ধুকে নাকি রুমাল উপহার দিতে নেই, তাতে বন্ধুত্ব ভেঙে যায়। মেহফুজকে তাড়াতাড়ি জানাই, ‘তুমি একটা টাকা পাঠাও বাই পোস্ট। নইলে বন্ধুত্ব ভেঙে যাবে।’ সবকিছু ভেঙে যাওয়ার ভয়, হারিয়ে ফেলার ভয়ে আক্রান্ত হই। সিঁড়ি দিয়ে নামতে গেলেও এক অদ্ভুত ভয় হয়, একি আশ্চর্য ফোবিয়া! রেলিঙ ধরে ধরে পা টিপে টিপে নামি, তবু রাতে দুঃস্বপ্ন আসে সিঁড়ি থেকে পড়ে গেছি সারা শরীরে কালসিটে।

সপ্তাহখানেক পরে মেহফুজ চিঠি লেখে। তাতে সে লেখে, ‘খামে করে শুধু একটাকা পাঠানো যাবে না। তাই চিঠির মধ্যে টাকা ভরে পাঠালাম।’ কিন্তু সে খামের মধ্যে কেবল চিঠি ছিল, একটি টাকাও ছিল না। আমি তড়িঘড়ি তার দেয়া টেলিফোন নম্বরে ফোন করে জানতে পারি, মেহফুজ তার শহরে ফিরে গেছে।

তারপর মেহফুজকে চিঠি লিখি তার বাসার ঠিকানায়। যে চিঠির কোনো উত্তর আসে না। যে মেহফুজ সগর্বে চেয়ে থাকবে বলেছিল এই অধরা আমার দিকে, সে আসলে জানতো এই বন্ধুত্বের ডেডলাইন কবে কোথায় লেখা আছে। আমি তা জানতাম না। মেহফুজকে রুমাল উপহার দেয়া এবং তার মূল্য স্বরূপ কাকতালীয়ভাবে হলেও একটি টাকা চেয়েও না পাওয়া সেদিন অর্থবহ মনে হয়।

বন্ধুকে রুমাল উপহার দিতে নেই। দিলে বন্ধুত্ব ভেঙে যায়। প্রথম প্রথম কিছুদিন অভিমান হয়। তারপর মনে হয় সবই স্বাভাবিক। সব সম্পর্ক শেষ অবধি থাকে না, থাকবেও না। কিছু কিছু সম্পর্ক কিছু কিছু বন্ধুত্ব একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্যই বাঁধা থাকে। যে সম্পর্ক উত্তীর্ণ হলো না, ম্লান আলোর মতো তারও একটি নিজস্ব কবিতা থাকে। অন্ধকার থেকে আলো আবার আলো থেকে অন্ধকারে মন তার নিজস্ব ছোঁয়ায় যেকোনো অভিঘাতকে ট্রান্সফর্ম করে দিতে পারে, শুধু এটুকু জানতে হয়, প্রতিটি মুহূর্ত সত্য কিন্তু সূর্য ওঠার মতো চিরসত্য বলে কিছু নেই মানুষের জীবনে।

যে ছেড়ে যায় সে কেবল সম্পর্ক নয়, `ইগো` নামক আত্মপূজার মূর্তিকেও আক্রান্ত করে। সেই আহত তথা ক্ষুব্ধ `আমি` টাকেও ডানা ভেঙে পড়া থাকা পাখির মতো আদর করে গ্রেসফুলি তুলে নিতে না জানলে, মৃত `আমি` পচে পচে ফুলে ওঠে, জীবাণু সংক্রমণে দুর্গন্ধ জন্মায়, তখন সে দুর্গন্ধ ওঝা দিয়ে ঝাড়িয়ে বা পৃথিবীর সেরা পারফিউমেও দূর হয় না কখনো কখনো। যে যেতে চায়, তাকে ভালোবেসে যেতে দিতে হয় তাই।

এমনই কোনো এক সময় একদিন কলেজ থেকে ফিরছি। সন্ধ্যার ল্যাম্পপোস্টের আলোয় সমস্ত গলিটাই কেমন অদ্ভুত ছায়াচ্ছন্ন হয়ে আছে। মাথার ভেতর ক্রমাগত চলছে ইলিয়টের কিছু লাইন,
আইস আই ডেয়ার নট মিট ইন ড্রিমস
ইন ডেথ`স ড্রিম কিংডম
দিজ ডু নট অ্যাপিয়ার
দেয়ার দ্য আইস আর
সানলাইট অন আ ব্রোকেন কলাম
দেয়ার ইজ আ ট্রি সুইনঙ্গিং
অ্যান্ড ভয়েসেস আর
ইন দ্য উইন্ড`স সিঙ্গিং
মোর ডিসট্যান্ট অ্যান্ড মোর সোলেম
দ্যান আ ফেডিং স্টার।

হঠাৎ পিছন থেকে এক কণ্ঠ আমার নাম ধরে ডেকে উঠলো। সহসা বিদ্যুৎ চমকের মতো বহু জন্মের চেনা সেই কণ্ঠে এক ঝটকায় পিছনে ফিরে দেখি, কিছুটা দূরে অন্ধকারে বৃষ্টিতে নুয়ে পড়া গাছের মতো দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। অনন্য চ্যাটার্জি। আমি ঠিক দেখছি না ভুল বুঝে ওঠার আগেই দেখি তিনি আমার দিকে এগিয়ে আসছেন ক্রমশ। সন্ধ্যার সেই গলি যেন নিমেষে বদলে যায় জনমানবহীন তেপান্তরের মাঠে। কোনো নির্ভুল প্রোফেসির মতো বৃষ্টি মাথায় করে আমি নিজেকেই একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি সেই দিকশূন্যপুরে। আমাকে আগলানোর কেউ নেই সেখানে। কোনো তৃতীয় উইচের ওড়না ঝলসে ওঠে নিরাবরণ দিগন্তজুড়ে। কোনো এক ওমেন যেন ফলপ্রসূ হতে চলেছে। কে যেন বলছিল, ‘নো ওয়ান ক্যান টেক ইউ অ্যাওয়ে ফ্রম মি।’ সে আমায় গিলতে আসে। বিদ্যুতের আলোয় আমি একবার তার মুখ দেখতে পাই। তারপর কোনদিকে পালাবো না বুঝতে পেরে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি।

অনন্য কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলেন,‘আমাকে একবার ফোন কোরো, প্লিজ।’ একথা বলে তিনি অন্ধকারে মিলিয়ে যান। ভূতগ্রস্ত আমি একা দাঁড়িয়ে থাকি স্মৃতির কবোষ্ণ গলিতে, যেখানে তখন সবেমাত্র সন্ধ্যা হয়েছে, সামনে অন্তহীন রাত, গাছে গাছে ফুটে থাকা বরফের ফুল হঠাৎ ওম লেগে ঝরে পড়েছে পৃথিবীর রঙিন গালিচায়।

চলবে