ভূত বিলাসের ঘর

আত্মজীবনী ১৮

শ্রেয়া চক্রবর্তী

প্রকাশিত : আগস্ট ০১, ২০১৮

এর মধ্যে দিদিমা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। খুব সামনে থেকে আপনজনের চলে যাওয়ার সাক্ষ্য বহন করার অভিজ্ঞতা সেই প্রথম। তখন মৃত্যু সম্পর্কে সম্যক সচেতন, অথচ দেখি যে, মানুষটি বেঁচে থাকার জন্য হাত বাড়াতে চাইছিল; সেই হাত ধীরে ধীরে বালিশের ওপর লুটিয়ে পড়লো নিস্পন্দ। মুখটা হাঁ করে কিছু বলার ছিল যে প্রয়াস, সেই শব্দের অপভ্রংশটুকু বাতাসের মধ্যে মিলিয়ে গেল কোনো নড়াচড়া ছাড়াই। মৃত্যু এভাবেই আসে, কোনো আওয়াজ না করে।

দিদিমা আমাদের সাথেই থাকতেন। মাস ছয়েকের জন্য গেছিলেন তার একমাত্র ইঞ্জিনিয়ার পুত্রের বাড়িতে। ছেলের সংসারে তিনি কোনোদিনই নাক গলাতে যাননি। পুজোর সময় নিজের দুই মেয়ের জন্য শাড়ি কেনা হোক বা না-হোক, পুত্রবধূর জন্য কেনা নতুন শাড়িটি যত্ন করে আলমারিতে তুলে রাখতেন, এলে হাতে তুলে দেবেন বলে। অথচ সেবার ছেলের বাড়িতে তার এমনই আপ্যায়ন হয়েছিল যে, বছর ঘুরতে না ঘুরতে দিদিমা যখন ফিরে এলেন, তখন তার চেহারা প্রায় কঙ্কালসার হয়ে গেছে। কোন্নগরের বাড়িতে ফিরেই তিনি বিছানা নিলেন। ডাক্তার বললেন, অ্যাকিউট ম্যালনিউট্রিশন।

মা আর বাবুই দিনরাত জেগে অনেক সেবা করলো। কিন্তু দিদিমার স্বাস্থ্যের কোনো পুনরুদ্ধার হচ্ছিল না। সম্ভবত মনে মনে তিনি মৃত্যুকে মেনে নিয়েছিলেন। যে কোনো আঘাতই তো আসলে মৃত্যু। হয়তো তিনি আর চাইছিলেন না ফিরে আসতে। দিদিমা খুব চাপা স্বভাবের মানুষ ছিলেন। কিছু বুঝতে দিতেন না। শুধু মাঝে মাঝে অস্পষ্ট স্বরে ‘খোকা খোকা‘ বলে ডাকতেন। ছেলেকে একবার দেখতে চেয়েছিলেন তিনি শেষবারের মতো। আমরা তার ছেলেকে জানিয়েছিলাম যে, তার মা শয্যাশায়ী। স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ছে দিনদিন। কিছুতেই ভালো হচ্ছেন না। হয়তো আর বাঁচবেন না বেশিদিন। তার আসা উচিত, অন্তত একবার। কারণ তার মা তাকে দেখতে চান। কিন্তু ছেলে এই শেষতম অনুরোধটুকু রাখতেও অপারগ হন। তার আসা হয়ে ওঠে না সুদূর রাজধানী থেকে কলকাতা অবধি।

দিদিমা যেদিন মারা গেলেন ভোরবেলা, মা আচমকা বিছানা থেকে টেনে তুললো, তাড়াতাড়ি আয়। এক ছুটে নিচে গিয়ে দেখি, দিদিমা বিছানায় শুয়ে। তার চোখদুটো স্থির ওপরের দিকে, মুখখানা হাঁ হয়ে আছে। আস্তে আস্তে নিঃশ্বাস ছাড়ছেন। এদৃশ্য দেখার মধ্যে অদ্ভুত এক ভয় মিশ্রিত বেদনা ছিল। এত কাছ থেকে একটি মানুষের মৃত্যু একটি সম্পর্কের মৃত্যু আমি আগে কখনো দেখিনি। মা বললো, দিদার মুখে একটু জল দে। আমি দিলাম। তিনি খুব জড়িয়ে জড়িয়ে কিছু একটা বলার চেষ্টা করছিলেন। মেয়েটার জীবনটা শেষ করে দিয়ে গেলাম, এই ছিল শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগে তার বলা শেষ কথা। তারপর তার দুটো চোখ তার কণ্ঠ তার শ্রবণ তার স্পর্শবোধ তার মগজ ও হৃদয় স্তব্ধ হয়ে গেছিল চিরদিনের জন্য।

আমার মায়ের ভুল বিবাহের জন্য তিনি যে কতখানি অনুতপ্ত ছিলেন, মনে মনে নিজেকে হয়তো দোষারোপ করেছেন কত। মৃত্যুর আগে অবধি তার বুকের ওপর সে যন্ত্রণা যে পাথরের মতো চেপেছিল, সেদিন তা বুঝেছিলাম। মৃত্যু তাকে নির্ভার করেছিল। ‘খোকা’ এলেন যেদিন দিদিমা মারা গেলেন সেদিন রাতের ফ্লাইটে। এসে দেহ সৎকার করলেন, কাছা পড়লেন, নেড়া হলেন, শ্রাদ্ধে জোড়ে জোড়ে মন্ত্র পাঠ করলেন। কিন্তু পুত্রের ভূমিকা যদি কেউ সত্যিই পালন করে থাকে সে ছিল বাবুই, যার সাথে দিদিমার কোনো রক্তের সম্পর্ক ছিল না। তার আপন পুত্র, যিনি দিদিমার দীর্ঘ অসুস্থতায় একদিনের জন্য দেখতে পর্যন্ত আসেননি, তিনি আত্মার শান্তি কামনা তথা লোক লৌকিকতা সেরে দিন কয়েক পরের ফ্লাইটে ফিরে গেলেন।

এরপর থেকে আমি এক অদ্ভুত মৃত্যুবোধে আক্রান্ত হতে থাকি। রাত্রিবেলা শুয়ে আছি অন্ধকারে। হঠাৎ মনে হতে থাকে, আমি বুঝি আর নেই। এ শরীর বোধ হতে থাকে, আমার নয়। আমি তবে কোথায়? কোথায় আমি? মৃত্যু অতিক্রান্ত সময়টা তাহলে কি এরকম? এই ঘর এই বালিশ এই মা বাবুই কবিতার খাতা এই সব কিছু যা আমি ইচ্ছে করলেই ছুঁয়ে দেখতে পারি, এই পূর্ণসম্ভবা জীবন যা এক্সসিস্ট করে ভরপুর আমার চেতনায় সে আমি এক্সসিস্ট করি বলেই, আমি না থাকলেও যে জীবন তরঙ্গের একচুলও এদিক ওদিক হবে না, কেবল এই `আমি`টাই থাকবো না এসবের মধ্যখানে, অনুভব করে সে রাতের অন্ধকার কঠিন বরফের মতো শীতল বোধ হয়। অসম্ভব যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে অনুভব করি, আমি ঠিক বারো হাত উপর থেকে নিজেকে দেখছি। আমার শরীরটি কেমন লতিয়ে আছে বিছানার ওপর। এই জীবনাভ্যাস কেমন তুচ্ছ মনে হতে থাকে। চোখ দিয়ে দুফোঁটা জল সেই অপার সম্ভাবনাময় অথচ পরিসীমিত সুন্দরের কথা ভেবে গড়িয়ে পড়তেই বুঝতে পারি, আমি আছি আমার ভেতরেই। নিজের হৃদস্পন্দন শুনে আশ্বস্ত হই যে, এখনো কিছু সময় বাকি আছে। নিজের ভেতরে ও বাইরে এই যাতায়াত আমার চলতে থাকে অনেক অনেক রাত। আমি বুঝতে পারি, সুন্দরকে শৃঙ্খলিত করাই মানুষের ধর্ম। মানুষ বড় ইনসিকিওর, কিছুই রাখতে পারবেনা জানে, তাই সারভাইভাল ক্রাইসিস থেকেই সে যা পারে সঞ্চয় করে রাখতে চায়, সে পার্থিব হোক কিংবা অপার্থিব। ছুঁয়ে ছুঁয়ে নিজেকে জানান দিতে চায় যে, যা আসলে নেই তাও আছে।

অনন্যর কথা মনে পড়ে যায়। কেন ফোন করতে বললেন আমায়? কেন? কেন? ফোন করবো ভেবেও করে উঠতে পারিনা। দু’পা এগিয়ে চার পা পিছিয়ে আসি।। মনের মধ্যে কত প্রশ্ন দলা পাকিয়ে ওঠে। কত কথা বলার ছিল তাকে, যা বলতে না পেরে পাতা ভরিয়ে লিখেছি এতদিন। তবু টেলিফোনের কাছে গিয়ে দুটো সংখ্যা ডায়াল করেই রিসিভার নামিয়ে রাখি। শিরার ভেতরে রক্ত বল্গাহীন ঘোড়ার মতো ছোটে। হৃদস্পন্দন অ্যালার্ম ঘড়ির মতো জোড়ে জোড়ে বাজতে থাকে, যেন বুক ফেটে বেরিয়ে আসবে এক্ষুণি। তারপর নিজের হৃদয় নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বসে থাকবো আজীবন। এক একটা কুঠুরি খুলে দেখবো, কত অন্ধকার জমে শব্দের মতো দানা বেঁধে আছে। শেষ অবধি একদিন সব ক‘টা সংখ্যা ডায়াল করি। কানের কাছে শক্ত করে ধরে থাকি রিসিভার। হাত কাঁপে। ওদিকের ফোনে বাজতে থাকে কলার টিউন:
ও শাম কুছ আজিব থি
ইয়ে শাম ভি আজিব হ্যায়
ও কালভি পাশ পাশ থি
ও আজভি করীব হ্যায়
ও শাম...
 
ওপাশে অনন্যর কণ্ঠ শোনা যায়।
আমি শ্রেয়া বলছি।
কেমন আছো?
ভালো। আপনি?
বেঁচে আছি। তোমার সাথে একবার দেখা হতে পারে?

পরের সপ্তাহে ব্রিটিশ কাউন্সিল থেকে ফেরার পথে যাই অনন্যর অফিসে। কত কিছু বলার আছে, তবু কিভাবে যে শুরু করবো বুঝতে পারি না। অনেক দ্বিধা ও সংশয় কাটিয়ে তাকে প্রশ্ন করি, ‘তবে আমার কি করা উচিত?’ ডালহাসৌ থেকে প্রিন্সেপ ঘাট অবধি হাঁটি পাশাপাশি।
তুমি ইংলিশ অনার্স নিলে কেন?
আপনিই তো বলেছিলেন...
আমি বলেছিলাম বলে? সে তো কথার কথা।
আপনার সব কথাই তো তাই। কথার কথা। আমার বুঝতে ভুল হয়েছে।
না, সব কথা নয়।
কোনটা নয়?
অনন্য কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। তারপর স্তব্ধতা ভঙ্গ করে বলেন, চলো এখান থেকে কোথাও চলে যাই। অনেক দূরে কোথাও। অনন্য আমার হাত মুঠো করে ধরেন। আমি হাত ছাড়িয়ে নেই। আপনি কাকে ক্ষয় করতে চান? নিজেকে তো নয়। এসব উপমায় কেবল ক্ষয়ে যাই আমি। নড়বড়ে পাটাতনের ওপর মাঁচা করে খরকুটো দিয়ে মূর্তি বানানো যায়। সেটা ক্ষণভঙ্গুর। সেটা সুন্দর হতে পারে। কিন্তু আপনি যে নিসর্গের স্বপ্ন দেখান তাকে ছুঁয়ে উঠতে পারবেন না কোনোদিন, আপনি যে লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে রেখেছেন তাকে স্পর্শ করার সাথে সাথেই ফুরিয়ে যাবে সব।

তুমি মুহূর্তে বিশ্বাস করো না?
আমি প্রতিটা মুহূর্তে বিশ্বাস করি। মুহূর্তকে ফিলটার করা যায় না, এটাই মুশকিল। বিষ ও অমৃত দুটোই একসাথে হজম করতে অনেক শক্তি লাগে।
আমি তোমাকে হেল্প করতে চাই। আমাকে পাপী বানিও না। তুমি আর আসবে না?
আসবো। কিন্তু এখন আমাকে ফিরতে হবে।
কবে? আবার কবে?

দূরের আকাশ, নদী, নদীর ওপর নুয়ে থাকা সেতু, ছোট ছোট মাছধরা নৌকো এই `কবে`রঙা নুড়ি লেগে নড়েওঠা জলের ছলাৎ আওয়াজে ঝাপসা হয়ে যেতে থাকে। অনন্য দেখেন, একটি মেয়ে অনেক জ্বর নিয়ে ফিরে যাচ্ছে। ক্রমশ ছোট হতে হতে মিশে যাচ্ছে ভিড়ের মধ্যে। অথচ তিনি কিছুই করতে পারছেন না, তিনি তার ফিরে যাওয়ার পথ আগলে দাঁড়াতে পারছেন না, এই যাবতীয় না পারার মধ্যে আসলে তার মৃত্যু হচ্ছে, হ্যাঁ তারই। ভালোলোবাসার কোনো মৃত্যু হয় না। মৃত্যু তো হয় কেবল প্রেমিকের। রঙ মশালের মতো রঙিন আগুনের শেষে সে কেবল পড়ে থাকে ছাই হয়ে।

চলবে