ভূত বিলাসের ঘর

আত্মজীবনী ১৯

শ্রেয়া চক্রবর্তী

প্রকাশিত : আগস্ট ০৬, ২০১৮

গ্র্যাজুয়েশনের সময় অনার্স সাবজেক্ট পড়ার জন্য এক প্রফেসরের কাছে যাই। অনাদি স্যার। প্রফেসরের পুরনো আমলের বাড়ি। কলকাতার কাছে তার খড়খড়ির জানালাঅলা দক্ষিণের ঘরটিতে মেঝে থেকে প্রায় কড়িবরগা অবধি সুবিপুল আলমারি দেশ-বিদেশের বইয়ে ঠাঁসা। একটি অ্যান্টিক আরামকেদারায় কাঠের নকশাতোলা সিংহমুখ হাতলের ওপর আরাম করে দু’হাত এলিয়ে বেলা দ্বিপ্রহরে আকণ্ঠ মদ্যপান করে একঘর ছাত্রছাত্রীকে সাহিত্যের পাঠ দিতেন অনাদি স্যার। উইলিয়াম ব্লেকের `সঙস্ অফ ইনোসেন্স অ্যান্ড অফ এক্সপেরিয়েন্স` পড়াতে পড়াতে তার চোখ বুজে আসতো। তার বিষয় নির্বাচন কিংবা বাচনভঙ্গির ওপর সুরার প্রভাব ছিল না বিশেষ। বরং সোমরসের প্রভাবে দেবতার অঞ্জলি প্রদানপূর্বক উদাত্ত ব্রাহ্মণের মতোই কবিতার পঙ্‌ক্তি বলে যেতেন ঝরঝর করে, যেন মন্ত্রপাঠ চলছে। দেশ-বিদেশের সাহিত্যের রেফারেন্স টেনে এনে অপূর্বভাবে পাঠ্যবিষয়ের সাথে তার যোগসূত্র তুলে ধরে বিষয়কে নিয়ে যেতেন সম্পূর্ণ অন্য মাত্রায়। তার শিক্ষণভঙ্গির অনুরাগী না হওয়া অসম্ভব ছিল। অনাদি স্যার বেহালা বাজাতেন। হয়তো পড়াচ্ছেন হিস্ট্রি অফ ইংলিশ লিটরেচার, জার্মান ইনভেশনের মাঝখানে লিটরেচারের বই নামিয়ে রেখে হাতে তুলে নিলেন বেহালাখানা। এরপর আপনমনে বাজাতে শুরু করলেন রবীন্দ্রসংগীতের সুর,
তোমরা যা বলো তাই বলো আমার লাগে না মনে,
আমার যায় বেলা বয়ে যায় বেলা কেমন বিনা
কারণে...

এই সাহিত্যের সিদ্ধপির অনাদি স্যারের এক স্বতঃসিদ্ধ ব্যামো ছিল। কন্যাসমা ছাত্রীদের শরীরের ওপর ছিল তার কুনজর। পুরুষমানুষের নারীশরীরের প্রতি আগ্রহ ছোঁকছোঁকানি এসব তো স্বাভাবিক। কিন্তু নিজের কন্যার ক্ষেত্রে যা কাম্য নয় একেবারেই, পরের কন্যার প্রতি প্রকৃতিপ্রদত্ত এই অনুরাগ যদি খণ্ডনযোগ্য না হয়, একই যুক্তিতে তবে সেই মানুষকে আমি `হিপোক্রিট` বলতেই পারি। এ হলো বায়োলজিকাল হিপোক্রিসি। এমন অনেক তরুণ ছেলেকেও দেখেছি রাস্তাঘাটে তরুণী মেয়েদের কুশ্রী ইঙ্গিত দেয় অনায়াসে, আবার এই ছেলেরাই নিজের বোনের দিকে কেউ চোখ তুলে তাকালেও চোখ উপড়ে নেয়ার হুমকি দেয়। মেয়েমানুষের সম্ভ্রম রক্ষার অধিকার কিংবা দায়িত্ব তাহলে কি কেবল নিজের জেনেটিক পেডিগ্রিকে সিকিওর করার মধ্যেই ন্যস্ত ও সীমাবদ্ধ? মানুষের বেসিক সেক্সুয়াল এথিকস বলে কি আদৌ আছে কিছু? একবার অনন্যকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমার প্রতি আপনার যে এই ভয়ানক অধিকারবোধ, আপনার মেয়ে যেও প্রায় আমারই বয়সী, বাবার বয়সী কোনো পুরুষের অনুরাগী যদি হয় সে এভাবেই, আপনি কি করবেন? অনন্যর উত্তর ছিল এককথায়, তাড়িয়ে দেব।

অনন্যকে সেদিন বড় ভয়ঙ্কর মনে হয়েছিল। একটি মানুষের সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টশন, অন্যের প্রতি তার যৌন প্রস্তাবের যে শৈলী কিংবা ভঙ্গি, তথাকথিত যৌন স্বভাব এবং আচরণের মধ্যে দিয়ে গোটা মানুষটির সামগ্রিক অস্তিত্বের অনেক অনালোকিত দিক উঠে আসে। যৌনতা মানেই কেবল যৌনসঙ্গম নয়, যৌনতা একটি জীবন শৈলীর সম্পূর্ণ মানচিত্র, যা আসলে যতটা না শরীরের তার চেয়ে অনেক বেশি মনের। একটি মানুষের সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টশন তথা যৌনবিশ্বাস সেক্সুয়াল পোটেন্সি অ্যাটেইন করার যে বয়স, সেই বয়সে পৌঁছনোর অনেক আগেই তৈরি হয়ে যায় বলে আমার বিশ্বাস। যেসব পুরুষেরা ছোটবেলা মায়ের হাতে প্রচুর মার খায়, মাকে অহেতুক রাগী কিংবা বদমেজাজি মানুষ হিসেবে চিনতে শেখে, তারা সেক্সুয়ালি ইনসিকিওর হয়। কোনো মহিলার কাছেই নিজেকে সম্পূর্ণভাবে মেলে ধরতে দ্বিধান্বিত থাকে। আবার যেসব ছেলেরা ছোট থেকে দেখে সংসারে মায়ের স্থান কেবল যৌন সামগ্রীর মতো, তার কোন সম্মান নেই অভিমত নেই, বাবা-মার সাথে কঠোর ভাষায় কথা বলে অসম্মান করে গায়ে হাত তোলে, সঠিক শিক্ষা ও আলোকপাতের অভাবে এসব ছেলেরাও কদাচিৎ মহিলাদের সম্মান করতে শেখে, তাদের দৃষ্টিতেও মহিলাদের অবস্থান সেই যৌন সামগ্রীর মতোই হয়, যেমন ছিলেন তার মা সেই বাবার আঙ্গিকে।

একবার অনাদি স্যারের ক্লাস শেষে বাইরে অপেক্ষা করছি। এক বান্ধবী হাঁফাতে হাঁফাতে ছুটে এলো। সে কিছুদিন আগেই পক্স থেকে উঠেছে। চোখমুখ লাল হয়ে আছে। এই জানিস, স্যার আমাকে কী বললেন?
কি?
বললেন, তোমার বুকে যে পক্সের দাগগুলো আছে তাতে কী মলম লাগাচ্ছো!

এই অনাদি স্যার একদিন রাতে মদ্যপ অবস্থায় আমাকে ফোন করলেন। প্রায় হুমকি দেয়ার স্টাইলেই আমাকে বললেন, তার কাছে অনেক ভালো ভালো নোট আছে। ফার্স্ট ক্লাস পাওয়ার জন্য সেগুলো নাকি খুব জরুরি। আমি যেন অবশ্যই তার সাথে আলাদাভাবে দেখা করি, এবং নোটগুলো পাওয়ার জন্য যা করণীয়, তা করি। তার ডাকে সাড়া না দেয়ায় তিনি যারপরনাই রাগান্বিত হন। এমন প্রস্তাব তিনি যে কেবল আমাকেই দিয়েছিলেন, তা নয়। আমারই এক রোগা বান্ধবী শর্ত মেনে নোট আদায় করে আনে। পরে আবার দুঃখ করে বলে, অনাদি স্যার তাকে আশানুরূপ নোটপত্র দেয়নি এবং আমার না যাওয়ার দরুণ তার গভীর রাগ ও আক্ষেপের কথা অনাদি স্যার সেই বান্ধবীর কাছেও প্রকাশ করেছেন। তারপর আবার এক সন্ধ্যায় অনাদি স্যারের ফোন আসে। রাগে দাঁত কিড়মিড় করতে করতে তিনি বলেন, দেখে নেব তোমার কতদূর কী হয়!  বলে দড়াম করে ফোনটা নামিয়ে রাখেন।

অনাদি স্যারের গোপন নোটের অনুরাগী ছিল যারা যে কোন শর্ত সাপেক্ষে, তাদের আমার পরীক্ষা হলে পকেট ভরে চোতা আনা পরীক্ষার্থীদের মতোই মনে হতো। ওইরকম অনুবীক্ষণিক শিল্পকর্মের নমুনা বানাতে যে সময় এবং পরিশ্রম লাগে তা দিলে তো গোটা বইখানাই মুখস্থ হয়ে যায়। কিন্তু কোন প্যারালাল বা অলটারনেটিভ সিস্টেম রপ্ত করে ফেললে মেইনস্ট্রিমে আর ফেরা যায় না। এই চোতা করার পদ্ধতি জীবনের আরো নানা স্তরের পরীক্ষায় অনেককেই নানাভাবে ব্যবহার করতে দেখেছি। একবার এক কবিতার অনুষ্ঠানে গেছি। সামনের সারিতে বসে আছেন স্বনামধন্য এক কবি। হঠাৎ তার সামনে এসে দাঁড়ালেন এক সুপরিচিতা মহিলা কবি। তিনি ওই কবির দিকে একটু ঝুঁকলেন, কবির কানে ফিসফিস করে কী যেন বলছেন। ওমা, এমন সময় দেখি, ওই কানাকানি ফিসফাসের মাঝেই মহিলা কবি নিজের শাড়িটা তার সুউন্নত বক্ষযুগলের ওপর থেকে ইঞ্চিখানেক নামিয়ে দিলেন একটানে, যাতে বাসা থেকে উঁকি মারা পক্ষীশাবকের উন্নত চঞ্চুর মতো তার অপূর্ব ক্লিভেজখানা প্রকাশিত হয়ে পড়ে। ব্যাপারটা সচেতনভাবে হলেও ভাবখানা এমন যেন, উফ কী গরম! কবি তখন জানালা দিয়ে বাইরের তালগাছের দিকে চেয়ে থাকতে না পেরে ওই অনিন্দ্যসুন্দর চিত্রের প্রতি লুব্ধ চুম্বকের মতো দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন।

এভাবে কিছুক্ষণ কালক্ষেপের পর তিনি মন্ত্র মুগ্ধের মতো উঠে মহিলা কবির পিছন পিছন কোথায় চলে যান। জানি না, ওই সুখশব্দ সুখদৃষ্টি বিনিময়ের সময় তাদের মধ্যেও কোনো নোট বিনিময়ের চুক্তি হয়েছিল কীনা। এভাবে মদ মাংস কিংবা শরীরের উৎকোচ সহযোগে সহজেই কিছু পেতে চাওয়া বা পাইয়ে দেয়ার লিগ্যাসি তো জীবনের সকল পরীক্ষায় সর্বক্ষেত্রেই কম বেশি প্রতিষ্ঠা করে দিয়ে গিয়েছেন আমাদের অগ্রজেরাই। সহজেই বাজিমাত করতে চায় যারা তাদের জন্য এমন অনেক দরজা খোলা আছে চিরকাল, থাকবেও।

শুনেছিলাম অনাদি স্যারের পূর্বপুরুষেরা নাকি জমিদার ছিলেন। তাদের আউটহাউসে জোড় করে মেয়েদের ধরে এনে নাকি নাচানো হতো। বাইজিনাচের চল আর সেরকম না থাকলেও অনাদির রক্তে মেয়েদের ইচ্ছেমতো নাচাতে চাওয়ার শখ যে থাকবেই সে বলাই বাহুল্য। তার অবচেতন অবধি যদি নামা যেতো, তাহলে এ সত্যই প্রকাশিত হতো যে অনাদি স্যারের ভাঙাচোরা মনের আউটহাউসে আসলে মেয়ে মানেই বাইজি! এরপর অনাদি স্যারের কোচিং ছেড়ে অনন্ত স্যারের কোচিংয়ে ভর্তি হই। অনন্ত স্যার কলকাতার এক নামকরা কলেজের প্রফেসর ছিলেন। শুধু সাহিত্য নয়, জীবনের গূঢ় বোধ ছিল তার। অনন্ত স্যারের বাড়ি যাওয়ার পথে একটি সেমেট্রি ছিল। কোনো কোনোদিন পড়ন্ত বিকেলে পাঁচিলের ভগ্নপ্রায় অংশের মধ্যে দিয়ে সেই সেমেট্রিতে ঢুকে বসতাম আমরা জনাপাঁচেক। তখন সূর্য ডোবার পথে। চারদিক আচ্ছন্ন করে থাকা এক অদ্ভুত উদ্ভিজ্জ ছায়ার ভেতর বসে প্রাণ ভরে নিতাম নশ্বর জীবনের গন্ধ। কবরের ওপর কান পেতে শুনতে চাইতাম থেমে যাওয়া ঘড়ির টিকটিক, কিংবা দুর্বোধ্য কিছু আবেগের অপভ্রংশ। আলো ফুরিয়ে আসতো নিমেষেই। অনন্ত স্যারের কোচিংয়ে আমার সাথে শুভর দেখা হয়। আমি, শুভ আর স্মৃতি তিনজন খুব ভালো বন্ধু হয়ে উঠি।

অনন্যর সাথে দেখা হয় ডালহাউসির এক রেস্তরাঁতে শেষ বারের মতো। অনন্য স্কচ নিয়ে বসেন। আমার ব্লাডি মেরি। এরপর কোলরিজের কথা জিজ্ঞেস করেন, জন কিটস শেক্সপিয়রের কথা। যেন এঁরা সব আমার গতজন্মের প্রেমিক। আমি কাঁধের ঝোলা ব্যাগ থেকে মোবাইলখানা বের করি লাজুক মুখে। সেই প্রথম মুঠোফোন পেয়েছি। হঠাৎ অনন্য আমার ফোনটা কেড়ে নিয়ে কললিস্ট স্ক্রল করতে থাকেন। সবার ওপরে আসে শুভর নাম।
শুভ কে?
আমার বন্ধু।
কলেজে পড়ে?
না। কোচিংয়ে।
অনন্যর মুখ গম্ভীর।
এসব শুভ-টুভর সাথে মেশা যাবে না।
অনন্যর প্রতিক্রিয়ায় আমি স্তম্ভিত।
মেশা যাবে না মানে? শুভ আমার বন্ধু।
হঠাৎ অনন্যর চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। তুমি অন্য ছেলের সাথেও মিশবে আবার আমার কাছেও আসবে, তা হবে না। ওসব ছাড়তে হবে।
অনন্যর এধরনের অযাচিত দখলদারিতে বিরক্ত হয়ে ফোনটা কেড়ে নেই। কোন অধিকারে আপনি এসব বলছেন? আমি নিজে থেকে আপনার কাছে আসিনি। আপনি অনুরোধ করেছিলেন।

অনন্য গুম হয়ে বসে থাকেন। অনন্যকে সামনাসামনি দেখি শেষবারের মতো। তারপর উঠে পড়ি। ব্লাডি মেরি গড়াগড়ি যায়। মনে পড়ে যায় শেলীর সেই বিখ্যাত লাইন, দাও লাভেস্ট: বাট নেভার নিউ লাভ`স স্যাড স্যাটাইটি। মনে পড়ে যায়, অনন্যর প্রথমদিন লেখা সেই কবিতা,
বন্যা আসে মাঝে মাঝে
ভেঙে দিতে গৃহ।
বলে দিতে আকাঙ্ক্ষার পরিণতি এই
সব বিত্ত বলি দিয়ে এখানেই বসে থাকা
তাও বুঝি নয়
শোক আসে বন্যা আসে আপদ প্রলয়
ভেঙে দিতে গৃহ
ধুয়ে দিতে মোহ।

প্রেমের মোহ ভেঙে যায়। যখন প্রশ্ন করি নিজেকেই, বলো, কী অধিকার ছিল তোমার? নিজেরই ভেতর নিরুত্তর অন্ধকারে বুঝতে পারি, অধিকারের মোহ প্রেমের চেয়ে ঢের বেশি। চুপচাপ তখন ইচ্ছে করে গিয়ে বসি কোনো আজনবির কবরের পাশে। ইহজীবনে প্রেমিকই সবচেয়ে বড় আজনবি।

চলবে