ভূত বিলাসের ঘর

আত্মজীবনী ২০

শ্রেয়া চক্রবর্তী

প্রকাশিত : আগস্ট ১১, ২০১৮

ক্রমশ এক অন্য মানুষের জীবন কাটাতে থাকি। যে জীবন আমার ছিল না অথবা আমি সে মানুষ নই, যার এ জীবন অধিকারগত ছিল। যেন আমি সে মানুষের জীবনটা নিয়ে বাঁচতে থাকি, আর সে মানুষ আমারটা নিয়ে। সে মানুষকে আমি চিনি না যাকে আমি খুঁজে বেড়াতে থাকি। মনে হয়, যুথবদ্ধ এ জীবনের চলন্ত গাড়ি থেকে নেমে পড়েছিলাম কোনোদিন অরণ্যের শোভা দেখবো বলে। তারপর পথ হারিয়েছি। সন্ধ্যার নীড়মুখি পাখির পিছু নিয়েও খুঁজে পাইনি শহরে ফেরার পথ। গাড়িটিও আমাকে ছেড়ে চলে গেছে বহুদূর। আর আমি আসন্ন রাত্রির অপেক্ষা করতে করতে ভেবেছি, আগামী ভোর আমার জীবনে কোন দিশাকাল নিয়ে আসবে।

ক্রমশ আমায় সে
টেনেছে গহ্বরে। ক্রমশ আমিও
তার অলীক মাস্তুল ধরে
নেমেছি মাটিতে। শহরে ফেরার
আর পথ নেই—
সারারাত জানতে চেয়েছি এক
অরণ্যের নাম।

ঝরাপাতার দস্তাবেজে লিপিবদ্ধ এ জীবন অতঃপর ঘুমিয়ে পড়েছে অনির্বচনীয় রাত্রির মুখোমুখি। উদ্ভিজ্জ প্রকৃতির মতো এ পৃথিবীর আপামর জীবকূলের মতো নিঃসংশয় হয়ে বাঁচা হয়ে ওঠে না তবুও। বারংবার নিজেকে আক্রমণ করি অফুরন্ত জিঘাংসায়। জানতে চাই, `সত্য` কি? উত্তর না পেলে নিজেকেই নিঃশেষ করে দিতে ইচ্ছে হয়। অনেক নশ্বর দ্বন্দ্বের শেষে শুভ্র পৃষ্ঠাজুড়ে ফুটে ওঠে এক একটি অবিনশ্বর হরফ। কলেজ চলে। কোচিং চলে। কবিতা— সেও রয়ে যায় প্রচ্ছন্ন অনুসরণকারীর মতো। মাঝে মাঝে কেউ পথ আগলে দাঁড়ায়।

সেদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিলো। গোটা স্টেশন ঝাপসা হয়ে ছিল কারোর বলতে চাওয়ার নীরবতায়। দিকভ্রান্ত হলুদ আলোয় সীমানা ছারখার করে মাঝে মাঝে চলে যাচ্ছিল এক একটি ট্রেন। স্টেশনে দাঁড়িয়েছিলাম আমি, শুভ আর স্মৃতি। স্মৃতি গান গাইছিল। বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে যাচ্ছিল তার কণ্ঠস্বর—

ভেবে দেখেছো কি
তারারাও যত আলোকবর্ষ দূরে তারও দূরে
তুমি আর আমি যাই ক্রমে সরে সরে...

হঠাৎ শুভ তার ছাতার নিচে টেনে নেয় আমাকে। একটাই ছাতার ওপর দিয়ে ঝরতে থাকে দুই পৃথিবীর জল। স্মৃতি গান থামিয়ে উদাস হয়ে চেয়ে থাকে। পাশের মধ্য বয়স্ক পুরুষ ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়েন সম্ভবত, তার ছাতার নিচে তিনি একাই। ধরা গলায় বলে ওঠেন, ‘এই খোকা, সরে দাঁড়াও। পাশে ওটা কে?’
‘আমার সোলমেইট।’
আমার অবাক হয়ে পড়ার তোয়াক্কা না করেই ট্রেন এসে পড়ে।
শুভ `তুই` থেকে `তুমি` হয়ে যায়। বলে, ‘তোমাকে দেখার অনেক আগেই তোমার কথা শুনেছি আর শুনে শুনেই...’ মুখ তার আলোয় উদ্ভাসিত। যে স্মৃতি পাশাপাশি হাঁটতো এবার আগে আগে চলে। আমি, শুভ আর স্মৃতি একসাথে পিকনিকে যাই। পুকুরধারে বসে স্মৃতি সিগারেট ধরায়। দিব্য মুখ দিয়ে টেনে নাক দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ে ফসফস। তার দেখাদেখি আমিও একটি ধরাই। আমার কায়দা দেখে স্মৃতি বলে, ‘এই তুই বরং বিড়ি খা’। পুকুরের জলে আমার সিগারেটঅলা মুখের ছবি দেখে আঁতকে উঠি। সিগারেট ছুঁড়ে মারি জলচ্ছবির দিকে, সে ছাই হয়ে ছবি সমেত ডুবে যায় বুদবুদের ভেতর। আমরা দোলনায় গিয়ে বসি। শুভ দুলিয়ে দেয়।

আমি আর শুভ সারা শহর ঘুরঘুর করি। লাইটহাউস, মেট্রোসিনেমা, পার্কস্ট্রীট, ময়দানে ঢেউ ওঠে। শুভ শেখায় কীভাবে আইলাইনার পড়তে হয়, লিপস্টিকের কোন্ শেড ভালো, কেমন পোশাকে আমাকে মানায়। সব টিপটপ না হলে সে খালি খুঁতখুঁত করে। রেস্টুরেন্টে গেলে সাদা ধবধবে ন্যাপকিনখানা নিজের হাতে আমার কোলে পেতে দেয়। তাজা গোলাপ নিয়ে আসে সারপ্রাইজ দেবে বলে। নিজেকে আমার সেই ভিক্টোরিয়ান যুগের কাব্য প্রেমিকা মনে হতে থাকে। ভারি গাউন হাইহিল টপ নট আর ভ্যানিটি ব্যাগ হাতে ঝুলিয়ে যে পৃথিবীর মাটিতে পদার্পণ করা মাত্রই উড়ো হাওয়া তার সুগন্ধিত রুমালখানা উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে ফেলে প্রেমিকের কাঁধে, যে তখন ঘোড়ার মাথার চুলে বিলি কাটতে ব্যস্ত! রুমাল দেখেই মনে পড়ে যায়, কোথায় কখন কথা দেয়া আছে, অমনি ঘোড়ার পিঠে চড়ে ছোটে সে প্রেমিক ধুলো ওড়ানো নিকুঞ্জের পথে।

এসবের মাঝে পার্ট ওয়ান এসে পড়ে। নোট নোট রব ওঠে। লাইব্রেরিতে দৌড়াদৌড়ি। কিছু কিছু পত্রপত্রিকায় লেখা ছাপা শুরু হয় তখন থেকেই। এসব হৈ হৈ চৈ চৈ এর মধ্যেই এক শ্রাবণ সন্ধ্যায় যখন বনে বনে ছায়া ঘনাচ্ছে আচমকা বিদ্যুতের শোভার মতো যার সাথে দেখা হয় তিনি এক জগন্মাতা, নাম তার নিপুণ মা। কোনো এক ভক্ত সমাদৃত বেদীমূলে ফুল নৈবেদ্যর মাঝে যিনি ধ্যানমুদ্রায় অধিষ্ঠিত হয়ে ঈশ্বরের কথা বলছিলেন। সেই ঈশ্বর যিনি মন্দির মসজিদ গির্জায় নয়, যিনি বিশ্বপ্রকৃতির প্রত্যেক কণায় সমাহিত থাকেন। যিনি অন্তরাত্মার সৌরভে জাগ্রত হন। যিনি প্রাণবায়ুর দোলাচলে পুলকিত হন। যিনি প্রতিটি প্রাণের আনন্দে উচ্ছ্বসিত হন। নিপুণ মায়ের দু’চোখ আনত হাত ভাবমুদ্রায় স্থির ছিল। যেন সরোবরে ফুটে থাকা পদ্ম। যেন আপাদমস্তক এক কবিতা।

তারপর একদিন এক ছায়াবৃত ঘরে তার সাথে সাক্ষাৎ হয়। ঘর বদলে যায় তপোবনে। জীবন যেন এক আশ্চর্য বোধের মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়। যে বোধ আসলে এক দরজা। কারো কারো সেই দরজা অবধি আসাই হয় না আজীবন। কেউ এসেও ফিরে যায়। কেউ চৌকাঠ অবধি এসে দাঁড়িয়ে থাকে। আর খুব কম মানুষ আছেন যাদের সেই চৌকাঠ অতিক্রম করার সাধ্য কিংবা সৌভাগ্য হয়। এ জীবনে যে যাই অর্জন করুক না কেন, তার তা হারানোর ভয় থাকে। মানবজীবনের এই তো করুণ আয়রনি। জীবন স্বয়ং প্রাণবায়ুকে হারানোর ভয় পায়। মা সন্তানকে। প্রেমিক প্রেমকে হারানোর ভয় পায়। কবি কবিতাকে। রাজা রাজত্ব হারানোর ভয় পান। যোদ্ধা শৌর্য হারানোর। ধনী ধন হারানোর ভয় পায়। যশস্বী যশকে। শ্রদ্ধাবান সম্মান হারানোর ভয় পান। যৌবন বয়ঃপ্রাপ্তির। অথচ মৃত্যু অনিবার্য। মানুষের যাকিছু সাধনা, যত কিছু অর্জন, যত তার লড়াই, এ সবের প্রতিই সে ভয় থেকে তাড়িত। এই ভয় থেকেই ঈশ্বরকে বশে রাখার কল্পনা, পূজা অর্চনা। কেবলমাত্র সত্য উপলব্ধি যা মানুষকে মৃত্যুর সাথে সমান্তরাল রাখে। কেবলমাত্র সন্ত যিনি পারেন সকল ভয়ের ঊর্ধ্বে উঠে বৃক্ষের মতো পতঙ্গের মতো বাতাসের মতো জলধারার মতো পারঙ্গম যাপনের সাথে লীন হয়ে যেতে। যিনি জীবনের প্রতিটি ছন্দের ভেতর আমৃত্যু সমাহিত থাকেন। নিপুণ মাকে দেখে আমার সেই মানুষের কথা মনে হতে থাকে, নিজের ভেতর আজন্ম আমি যার অপেক্ষায় ছিলাম হয়তো।

মনে মনে কত কথা হতে থাকে তার সাথে, সে বিচিত্র সংলাপ কবিতার রূপ নেয়—
তোমার কি মনে আছে
কোনো এক বিশ্লিষ্ট রাতে
জীবনের সহজিয়া সুর
বেজেছিল তোমার ও-হাতে।
নুড়িজন্ম ভেসে যায় অতলান্ত স্রোতে
নদীর মতন তার অবাক বিস্ময়!
জলের গভীর থেকে উঠে এসে তুমি
মধ্যখানে এঁকে দিলে পূর্ণ সমন্বয়।
ক্লান্তভার বসে থাকা মৃত্যুহীন পথ
জন্মহীন আলো একা তোমার কপালে
রাত্রি রাত্রি পার হয় হরিণীর ঘুমে
কবে তুমি নিশ্চুপে ও হাত ছোঁয়ালে?

পৃথিবীর যাবতীয় স্পর্শাতুর দোলাচল বড় নীরবে হয়। এই যে সকাল থেকে সন্ধ্যা হলো, এই যে গ্রীষ্ম থেকে বর্ষা, শীত থেকে বসন্ত তার অবিরাম পথ পার হওয়া, কত নিপুণ প্রকৃতি তার ফুল ফোটানো থেকে পাতা ঝরানো অবধি প্রতিটি ছোঁয়ায়, কখনো তার আওয়াজ পেয়েছো কি?

চলবে