ভূত বিলাসের ঘর

আত্মজীবনী ২১

শ্রেয়া চক্রবর্তী

প্রকাশিত : আগস্ট ১৮, ২০১৮

হামনে দুনিয়ামে আকে কেয়া দেখা
দেখা যো কুছ সো খোয়াবসা দেখা
হ্যায় তো ইনসান খাক কা পুতলা
এক পানিকা বুলবুলা দেখা

মনে মনে বসি গিয়ে ব্রহ্মপুত্রের ধারে। উঁচু এক প্রস্তরখণ্ডের ওপর বসেন নিপুণ মা। দৃষ্টি তার দিকচক্রবালে। আমি বসি নিচু এক পাথরে। নুড়ির ওপর পায়ের পাতা জলে ভিজে যায়। নিপুণ মায়ের চোখ বুজে আসে। চারপাশে ঘন শ্যামলিমা অহেতুক ঝিম ধরে আছে। নুড়ি গুনতে গুনতে তাকে জিজ্ঞেস করি, তুমি কোথায় থাকো?
আশ্রমে।
সে আশ্রম কোথায়?
এই তো এইখানে।
আমি এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখি। চারপাশ লোকালয়হীন, জনমানবশূন্য। দূরে অস্পষ্ট দেখা যায় দু’একখানা পানসি।
কোথায়? এখানে তো কিছুই দেখা যায় না।
চোখ বন্ধ করে দেখ। মন যেখানে শূন্যতায় এসে মেলে, সেই তো মনের ঘর। সেখানেই আশ্রম।
আর সন্ন্যাস? সে কেমন?
ফিরে যেতে ইচ্ছে হয়? নিপুণ মা জিজ্ঞেস করেন। কণ্ঠ তার গভীরে নামে ক্রমশ।
কোথায়?
অন্ধকার থেকে আলোয়, নিজ অন্তরে। যদি করে তবে চল, দেখ ওখানেই বসে আছে সেই জটাবাবা ব্রহ্মাণ্ড মাথায় করে।

তার শব্দের রহস্য উদঘাটন করার আগেই দেখি, বদলে গেছে চারপাশ। ব্রহ্মপুত্র নয়, নিপুণ মা বসে আছেন বটবৃক্ষের তলে। তার সুবিপুল কাণ্ড সিংহাসনের মতো তাকে ধারণ করে আছে অদৃষ্টের করকুণ্ডলে। চোখ মেলে দেখি, সামনে অগণিত কৃপাপ্রার্থীর সমাগম। চমৎকারের নেশায় ছুটে আসা মানুষের দল লুটিয়ে পড়ছে তার চরণপদ্মে। ওই দু’খানি পা ধরে কী টানাটানি! যেন পৃথিবীর সর্বাধিক সুলভ নিরাময় ওখানেই। কেউ বলছে, মা আমার পুত্রের খুব জ্বর। একটু চরণামৃত...। কেউ বলছে, আমার স্বামী শয্যাশায়ী। একটু খানি স্পর্শ...। কেউ আবার, ছেলের চাকরি নেই, যদি কিছু কৃপা...

কেউ চায় মেয়ের ভাঙা সংসার জোড়া লাগুক চমৎকারি মেডিসিনে। যার যেমন ব্যথা সে তেমন উপশমের আশায় ভিড় জমাতে চায় পুষ্প সিন্দুর অলঙ্কৃত অলৌকিক দেবির অধীত পীঠস্থানে। উৎকোচ হিসেবে আসে দামি দামি উপঢৌকন। সোনার মালা, সমুজ্জ্বল আবরণীর তলে। মানবী দেবির মন্দির ঈশ্বর সুগন্ধ সংযোগে যাবতীয় অলৌকিক নিরাময়ের দায়ে লৌকিক হয়ে ওঠে নিরন্তর পুণ্যার্থীর সমাগমে। নিপুণ মা নিজেও বলেন, ‘এ যেন শালগ্রাম শিলা দিয়ে বাটনা বাটার কাজ হচ্ছে।’ অধ্যাত্মের পথ ক্রমে যাবতীয় শারীরিক মানসিক বেদনা ম্যানেজমেন্টের তাৎক্ষণিক উপশমশালা তথা জাদুকরি কর্মশালায় পরিণত হতে দেখি।

ক্রমশ নিপুণ মা অধরা হয়ে ওঠেন। ব্রহ্মপুত্র তো অনেক দূর, তার বটবৃক্ষ অবধি পৌঁছতে গেলেও বাবাজীদের ধরতে হয়। একদিন তার সাথে দেখা হতে দু’চার কথা বলি। নিপুণ মা হেসে বলেন, ‘তুই দেখছি বদলাসনি। আমি তো ভেবেছিলাম অন্যদের মতো তুইও।’ সেদিন বুঝতে পারি, আমার মন বোঝার সময় নেই তার। অন্যদের মতো আমি না পারি তার চরণে লোটাতে, না পারি নিরন্তর প্রশ্নবানে জর্জরিত করতে। তাকে আক্রমণ করার শক্তি কোথায় আমার? মনের ভেতরে সন্ধ্যা নামার আগের যে ঘর, কেউ বাতি জ্বেলে দিয়ে যায় রোজ, সে ঘর থেকে একটি পথ সোজা ব্রহ্মপুত্র অবধি যায়। সেখানে একটি পানসি রোজ অপেক্ষা করে। আমার আর তার দেখা হওয়ার কথা ছিল সেখানেই। সে কথা ভুলে জগতের অজস্র কৃপাধন্য আত্মার মাঝে সোনার সিংহাসন আলোকিত করে বসেন তিনি, রাজ রাজেশ্বরী। তবু তার আলতো স্পর্শে মনের নিপুণ দেয়ালে চক আর খরিমাটি দিয়ে আঁকা সাধিকার ছবিটি ওভাবেই রেখে দেই আমি, মুছতে দেই না কাউকে। জীবনের ত্র্যহস্পর্শে সব আবছা হয়ে গেলেও সেই ছবিটি এক অলৌকিক বিন্দুর মতো জ্বলজ্বল করে, যাবতীয় স্পর্শের ভেতর আসলে আমি যাকে ছুঁতে চাই, যার কাছে ঋণী থেকে যাই আজীবন। মনে যাকে যেমনটা চাই না পেয়ে নিজের অন্তরে নিপুণতর হয়ে ওঠার চেষ্টা করি, যাকে ছুঁতে চাই তার শূন্যতায় নিজেকেই ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখি কেবল।

নিপুণ মা অন্তর্হিত হন। পড়ে থাকেন গর্ভধাত্রী মা জীবনের আলো অন্ধকারে। একবার এক বুজুর্গের সাথে পরিচয় হয় কোনোখানে। তিনি মুসলিম। নব্বই বছরের সেই বৃদ্ধ জীবনের নানা কথার পর আসন্ন মৃত্যুর কথা উচ্চারণ করে উদাস হয়ে পড়েন। সেই ঔদাসীন্যে তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে সেই শব্দবলয় যা আমি আমার দাদুকে সান্ধ্য ভ্রমণের অন্তিম ভাগে প্রায়শই বলতে শুনতাম, ‘হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হলো পার করো আমারে।’ এই হরির কোনো জাত ধর্ম হয় না। জন্ম এবং মৃত্যু এই দুই সত্যের কোনো পৃথক বর্ণ বা গোত্র হয় না, বেদনা ও ভালোবাসারও নয়। তৃষ্ণা সে তো একই রকম হৃদয়বিদারক, যে জল তা নিবারণ করে `পানি` উচ্চারণে তার ধর্ম বিন্দুমাত্র বদলায় না। তবু এক ঈশ্বরকে নিয়েই অনন্ত খাবলাখাবলিতে মানুষ ঈশ্বরের থেকে বহুদূর সরে থাকে। সে ঈশ্বর কেবল এক খোঁজ। আমার ভেতরের যে আলো তা তিনি, আবার যে অন্ধকার সেও তিনি। আমার অন্তরের যে আনন্দ তা ঈশ্বর,আর যে বেদনা? তাও ঈশ্বর। শুধু সেই অন্ধকার আর বেদনাকে গ্রহণ করে নিতে না পারা থেকেই যত জলপড়া, তেলপড়া, আর বটবৃক্ষের সাধনা। নব্বই বছরের সেই বুজুর্গকে উঠে দাঁড়াতে দেখি তারপর। ধীর পায়ে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ান। তারপর যিনি সহজ হয়েও অগম্য, অসামান্য হয়েও মহৎ, বিচক্ষণ হলেও উদারতম সেই ঈশ্বর তথা আল্লার উদ্দেশে বলে ওঠেন:
যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে মুক্ত করো হে বন্ধ
সঞ্চার করো সকল কর্মে শান্ত তোমার ছন্দ,
চরণপদ্মে মম চিত নিষ্পন্দিত করো হে
নন্দিত করো, নন্দিত করো, নন্দিত করো হে।

বলেন, এ আমার প্রার্থনা।
আমি চমকে উঠি।

শুভ আমাকে ভালোবাসে। সে আমাকে পেতে চায়। সে চায় প্রজাপ্রতিটির মতো আমি তার সাথে থাকি সারাক্ষণ। নজরে হারায়। হারানোর ভয় পায়। আমি তবু ওড়ার জন্য ছটফট করি। কি এক অস্থিরতা আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় সারাক্ষণ। কোথাও যেন এক মুহূর্ত শান্তি নেই। শুভ আমাকে চিঠি লেখে, অ্যান্ড ট্যু স্পিক অ্যাবাউট মাই নেভার এন্ডিং লাভ ফর ইউ। আই উইল সে দ্যাট ডে বাই ডে নাইট বাই নাইট স্টেপ বাই স্টেপ আই ফল ইন ইওর লাভ। আ লাভ সো ইনকমপ্রিহেনসিবল, সো ভিভিড, সো ইউনিক দ্যট নট ইভেন দ্য রেইন অফ গড কুড কনট্রোল আ প্যাশন সো ডিপ, আ নিড সো নেসেসারি, আ ওয়ান্ট সো স্ট্রং। আই লাভ ইউ টুডে, আই উইল লাভ ইউ টুমরো, আই উইল লাভ ইউ ফর এভার।

ফর এভার? অনন্ত? সে বড় দুর্গম এক কল্পনা। এই অনন্ত ব্রহ্মাণ্ডে ঘন নিপুণ শূন্যতা ছাড়া আর কিই বা আছে যার কোনো অন্ত নেই? শুভর মনে কী আছে তা যদিও বা কিছু বুঝতে পারি, নিজেকে বুঝতে পারি তার চেয়েও কম। প্রেম-ভালোবাসা তো ক্ষণজন্মা, পদ্মপাতায় এক ফোঁটা জলের মতো। এতই স্পর্শকাতর বলে ধারণ করা বড় কঠিন। কিন্তু সে যে আঘাত দিয়ে যায়, তার চলে যাওয়ার অনুরণনে অন্তর্গত প্রকৃতিতে যে তরঙ্গ ওঠে, সে তরঙ্গ মনকে যে কত গভীরভাবে নাড়া দেয়, কত কিছু যে ওলট পালট করে দিয়ে যায়, গলে পড়ে যাওয়ার আগে বুঝে উঠতে পারি না। সে তরঙ্গ একই ভাবাবেগে চুলের মুঠি ধরে আমাকেও টেনে নামাতে পারে জগৎপ্লাবী অন্ধকারে। যেদিন সে গলে যায় ঋতুকালীন মনসিজে যে আমার একবিন্দু জল...

অ্যান্ড দেন উই ডাই, অ্যান্ড গো ইন গ্রেভস, টুগেদার উইথ রেথস অফ লাভ ফরএভার। প্রেমে যার মরণ হয়েছে, সে মানুষ সুখি। আর কিছুই তাকে মারতে পারে না।

চলবে