অলঙ্করণ: পাপিয়া জেরিন

অলঙ্করণ: পাপিয়া জেরিন

ভোগ্যবস্তু: নারী না পুরুষ

রিফাহ সানজিদা

প্রকাশিত : জানুয়ারি ০৫, ২০১৮

আমাদের সমাজ পুরুষশাসিত। ছোটবেলা থেকেই আমরা এ পারম্পর্যে বড় হয়ে উঠি। যদি আমি মেয়ে হই, তবে আমি জানি, আমি মেয়ে। ফুলের চেয়ে নরম, ভীষণ পুত-পবিত্র আমার শরীর। সেটাকে পবিত্র রাখা আমার দায়িত্ব এবং অন্যের দ্বারা অপবিত্র হলেও দায়ভার আমারই!
ছেলে হলে তাকে শেখানো হয়, ছেলেদের আলাদা করে শরীর করে বলতে কিছু নেই। ওতে ইচ্ছেমতো ধাক্কাধাক্কি কিংবা স্পর্শ কিংবা যা-তা করে বেড়ালেও তোমার শরীর বলতে বোধ থাকবে না। এর মানে একঅর্থে তুমি কখনো অপবিত্র হতে পারো না।
আমরা জানি, শরীর ও যৌনতা পারস্পরিক যোগবদ্ধ। একটা মেয়েকে শেখানো হয়, তোমার শরীর ভোগের বিষয়। সেটা কেউ ছুঁয়ে দিলে কিম্বা দেখলেও, একঅর্থে কিন্তু সে তোমাকে ভোগ করল। কিন্তু ব্যাপারটা কি আসলেই তাই? এজন্যই আমাদের দেশে নারী-পুরুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি ব্যাপক আকারে জটিলতা তৈরি করে।
একটা মেয়ে আর ছেলে যখন পরস্পর সম্মতিতে একটা প্রেম বা ভালোবাসার সম্পর্কে জড়িয়ে যায়, তখন তাদের মধ্যে যা কিছুই হোক, সম্পর্ক ভেঙে গ্যালে মেয়েটা ছেলেটার বিরুদ্ধে মোলেস্টেশান কিংবা যৌন-হয়রানি ধরণের অভিযোগ আনে। ছেলেটা সম্পর্কে থাকাকালীন যদি যৌন সম্পর্কে জড়ায় মেয়েটার সাথে তাহলে ছেলেটা ভোগ করেছে মেয়েটাকে?
তাহলে এরকম ভোগ তো চিরকাল বিবাহ-প্রথায় বিদ্যমান ছিল, এখনো আছে! একটা সম্পর্ক নানা কারণে ভেঙে যেতে পারে। তার মানে এই নয়, ভেঙে গ্যালেই আমার সঙ্গী আমাকে ভোগ করেছে পুরোটা সময়। তাহলে আমি মেয়ে হয়ে কোথায় ছিলাম সে সময়টায়? একটা শারীরিক সম্পর্কে তাহলে নারী হিসেবে আমার কোনও ভূমিকা নেই?
নারী ধর্ষিত হলেও তাকে ভাবতে হয়, আমাকে ভোগ করা হয়েছে। আমার সাথে অন্যায় হয়েছে বা আমি নির্যাতিত। এটা ভাবতে বেশ বেগ পেতে হয়! কেন? কারণ, নারী বলতেই শরীর, ভালো হোক কিংবা খারাপ অর্থে।
এবার আসা যাক, একটা পুরুষের ক্ষেত্রে। সে কিভাবে দ্যাখে কিংবা তাকে কিভাবে দেখানো হয়, একটা ছেলেকে আলাদা করে বোঝানো হয় না তার শারীরিক বোধগুলো নিয়ে। তখন একটা ছেলে ছোটবেলায় বারবার যদিও যৌন-নিপীড়নের শিকার হয়, তবে বুঝতে পারে না তার সাথে যা হচ্ছে তা অন্যায়। এরকম হাজারো গল্প আছে রয়েছে হাজারো ছেলের জীবনে। যেখানে তার ছোটবেলা কেটেছে অন্ধকারে-ভয়ে, সে মুখ ফুটে কিছু বলা দূরে থাক, বিষয়টা না বুঝেই সেটাকে স্বাভাবিক হিসেবে নিয়েছে।
আমি ছোটবেলা থেকে নিজে দেখে এবং জেনে এসেছি, একমাত্র মেয়েরাই এসব সেকশুয়্যাল হ্যারাসামেন্টের শিকার হয়। আর ভাবে, আমি ভোগের একটা পণ্য মাত্র। তাই সে সকল সম্পর্কে কিংবা নির্যাতনে নিজেকে ভোগের বিষয় হিসেবে ধরে নেয়। আবার একটা ছেলে কখনোই জানতে পারে না, তার জন্যও নিরাপদ নয় এই সমাজ। তারও শরীর আছে এবং সেটাকে শ্রদ্ধা করতে হবে। অস্বাভাবিক যৌন সম্পর্ক তাকে ভাবায় না। কারণ সে জানে, একমাত্র মেয়েরাই ভোগের বস্তু হতে পারে, একটা ছেলে কখনোই নয়।
পরিবার থেকে সমাজ- সবাই এই ভয়ঙ্কর সত্যটা একটা ছেলের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখে। আবার তাকে পরে সেই অস্বাভাবিক সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসার জন্য যখন চাপ দেয়া হয়,  ততদিনে সে সম্পর্কে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। নিতান্তই না পেরে তাকে লোক-দেখানো বিয়ে দেয়া হয়। সেখানেও পীড়িত হয় তার সঙ্গী মেয়েটা।
মেয়ে কিংবা ছেলে কেউই ভোগ্যবস্তু হতে পারে না একপাক্ষিকভাবে। একটা সম্মতির সম্পর্কে থাকাকালীন, আবার প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী যদি ধরাই হয় একটা মেয়ের শরীর ভোগ্যবস্তু তবে, একটা ছেলেও সেই ভোগ্যবস্তুর চেয়ে কম কিছু নয়। পাল্টাতে হলে এই পুরো ধারণাই পাল্টাতে হবে। সেটা আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভবই বটে। আমরা এখনো এসব শিক্ষার গুরুত্ব নিয়ে ভাবছিই তো না, শিক্ষার প্রচলন তো দূরের ব্যাপার।