মনের দরজা খোলা রাখা জরুরি

মাকসুদা আক্তার প্রিয়তি

প্রকাশিত : মে ১২, ২০১৮

বাংলাদেশি নাকি বাঙালি? কোন শব্দটা বেশি প্রযোজ্য এই মেয়ের বেলায়? বলতে চাই একটি সাধারণ মেয়ের কথা। যে স্বামীর মন রক্ষার্থে নিজের বোনের সাথে ছয়-সাত বছর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রাখতে দ্বিধা বোধ করেনি। সংসারে দ্বিমত হলে অশান্তি হতে পারে, তার জন্য নিজের পরিবারের সদস্যদের সাথে যোগাযোগ বিছিন্ন করে একঘরে হয়ে পড়ে ছিল বছরের পর বছর।

স্বামীর ভাষ্যমতে, ভদ্র ঘরের মেয়েরা ঘর থেকে বের হয় না। তাই চার দেয়ালের মধ্যে নিজেকে বন্দি করে রেখেছে দিনের পর দিন। নিজের মগজে, মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে রেখেছে স্বামী ছাড়া তার আর কোনও গতি নেই। আর স্বামীর থেকে পৃথিবীর আর কেউ আপন নেই। যেহেতু তার বাবা-মা বেঁচে নেই। আর সেই মেয়ে নয় বছর স্বামীর অমানবিক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন সহ্য করে, স্বামীর ভুল ও অন্যায় ঢাকার জন্য প্রস্তুত থাকে সর্বদা। সেই মেয়েকে বাঙালি নারী ডাকবো নাকি বাংলাদেশি নারী? কোনো নারী এভাবে নয় বছর মারধোর খেয়ে একই ঘরে থাকার পর যখন জানতে পারে যে, বাইরে তার স্বামীর একাধিক নারীর সাথে শারীরিক সম্পর্ক, তারপরেও যেন স্বামীর আসল মুখোশ সমাজের সামনে না খোলে তার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা, সেই মেয়েকে বাঙালি নারী ডাকবো নাকি বাংলাদেশি নারী?

একাডেমিক শিক্ষায় তার স্বামী বৈমানিক হতে পেরেছেন, কিন্তু নৈতিকতা শিখতে পারেননি বিন্দুমাত্র। তার স্বামী তাকে বিয়ের আগেই আরেকটি বিয়ে করে রেখেছিল, কিন্তু তার স্বামী তাকে এবং তার পুরো পরিবারকেই অন্ধ বানিয়ে বোঝাতে সক্ষম হলো, ওই মেয়ে তার গরিব খালাতো বোন। অসুস্থ মাকে দেখাশুনা করার জন্য মেয়েটিকে তার বাসায় রাখা। চুল পরিমাণও কেউ বুঝতে পারেনি এত নিখুঁত খেলা। যখন কয়েক মাস পর হাতেনাতে ধরা পড়লো, তখনও সমাজের কটাক্ষ চোখ থেকে বাঁচার জন্য মাফ করে দিল স্বামীকে। তারপরেও তার স্বামী ক্ষান্ত নন। পাইলট পেশার ছায়াতলে যে কোনো মেয়েকে তার জন্য যোগাড় করাটা খুব বেশি কষ্টসাধ্য নয়। আর যদি মেয়েদের কাছে একটু ইনিয়ে-বিনিয়ে চোখে দু ফোঁটা জল এনে বলে, দাম্পত্য জীবন দুর্বিষহ, কোনও শারীরিক সম্পর্ক নেই, কয়েকদিনের মধ্যে ডিভোর্সও হয়ে যাবে, তাহলে তো এক শ্রেণির মেয়েরা নিজেকে রানী ভাবতে শুরু করে দেয়। তথ্য কতটুকু সত্য না মিথ্যা, তা পর্যন্ত যাচাই করার প্রয়োজন মনে করে না। কিন্তু শরীর বিলিয়ে দেয়ার জন্য তৈরি।

আচ্ছা বলুনতো, নিজেদের এত মূল্যহীন কেন ভাবেন? শর্টকার্টে নিজের জীবন গুছানো পেতে গিয়ে নিজের বিবেকের সাথে কতটা বেঈমানি করছেন তার কি কখনো হিসেব-নিকেশ করেছেন? উপরে যার কথা বললাম, সে বেশি দূরের কেউ না, আমারই বোন। কিন্তু আমরা নিষ্প্রাণ হয়ে শুধু দূর থেকেই দেখছি, কিছুই করার অধিকার নেই আমাদের। কারণ এই ভদ্রমহিলা আমাদের আগেও কিছু করতে দেয়নি, এখনো দিচ্ছে না। সর্বশেষ যখন তার স্বামী তাকে মেরে বাসা থেকে চলে যায় এবং অন্য মেয়ের সাথে থাকা শুরু করে, তখন আমার বোন পল্লবী থানাতে এফআইআর করতে গেলেও থানার কর্মরত কর্মকর্তাগণ (তার স্বামী পূর্বপরিচিত থাকায়) যথেষ্ট প্রমাণ নেই বলে কেইসটি উনারা নেননি। পরবর্তীতে আমি প্রেস কনফারেন্স করে বিষয়টি সবার সামনে আনার কথা বলি, যাতে প্রশাসন এক তরফা অনুগ্রহ না করে। কিন্তু আমি বা আমরা আবারো হেরে যাই তার জেদের কাছে। তার জেদ, তার স্বামীকে বাঁচানোর জেদ, তার স্বামীর নাম রক্ষার জেদ। তার সেই স্বামী, যেই স্বামী তাকে প্রতিদিন খুন করছে নতুন করে।

মজার ব্যাপার শুনুন, আমার বোনকে তার স্বামী এমনভাবে গত নয় বছরে তৈরি করেছে যে, তার বাসায় কোনও ইন্টারনেট ছিল না। এখন পর্যন্ত আমার বোনের হাতে কোনও স্মার্ট ফোন নেই। সে জানে না, কীভাবে গুগুল করতে হয়, কীভাবে ফেসবুক চালাতে হয়, কীভাবে একটা অ্যাপ ডাউনলোড করতে হয়। এতটাই অজ্ঞ বানিয়ে রাখতে তার স্বামী ‘প্রাক্তন বিমান বাহিনী অফিসার’ সক্ষম হয়েছেন। উনি উনাদের ক্রিমিনাল ট্রেনিং পুরোদমে আয়ত্ত করতে পেরেছেন, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। আমি এই বছর জানুয়ারিতে যখন বাংলাদেশে আসি তখন ওদের ইন্টারনেট নেয়ার অনুরোধ করে একটি রাউটার কিনে দেই, তারপরই আসে তাদের বাসায় ইন্টারনেট সংযোগ, যা মাঝে আবার বিছিন্ন ছিল। যাই হোক, উনি যে পরনারীর প্রতি আসক্ত বা শারীরিক সম্পর্ক করছেন, তার বিন্দু মাত্র আন্দাজ ছিল না আমার বোনের। কিন্তু দেখুন প্রকৃতির কী নির্মম পরিহাস, যেই মেয়ের সাথে প্রেমের অভিনয় করে, তার শরীর ভোগ করার পর তাকে ছেড়ে দিয়ে আবার অন্য মেয়ের কাছে চলে যায়, সেই মেয়েরাই আবার ফোন করে আমার বোনকে সব তথ্য দিতে থাকে। কিন্তু তার স্বামী বরাবর অস্বীকার করে আসে আর মারধোর করতে থাকে। সর্বশেষ, ৫ মে আমার বোন ভাবিকে নিয়ে ধানমন্ডি স্টার কাবাবে চা খেতে গেলে মেয়েসহ তার স্বামীকে হাতেনাতে ধরে ফেলে। সেই নাটক দেখেছে রেস্টুরেন্টসহ অত্র এলাকা। বোনকে ওই মেয়ে জানায়, একবছর পর তাদের বিয়ে করার পরিকল্পনা রয়েছে। নিজের স্ত্রীকে অগ্রাহ্য করে ওই লোক ব্যস্ত হয়ে যায় উনার প্রেমিকাকে সামলাতে এবং মানাতে। অথচ, এই একই লোক বাসায় তার স্ত্রীকে প্রতিনিয়ত বলতেন হাদিস পড়তে, তাদের একমাত্র সন্তানকে হাদিস শোনাতে। পরবর্তীতে ওই লোকের পরিবারকে এইসব ঘটনা জানানো হলে, আমার বোন ঠিকমতো রান্না করতে পারে না, এই দোষে সাব্যস্ত করে উনাদের পুত্রকে শাসন না করে, পুরোপুরি সমর্থন করেন।

আর সমাজ? সমাজের দোষ দিয়ে তো লাভ নেই। সমাজ তো আমরাই। আজ সমাজে আমার বোনের মতো মানুষেরা ঘটনাগুলো ঘটতে দিচ্ছে বলেই নারীর দুর্বলতা বাড়ছে। কটাক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিও বাড়ছে। হ্যাঁ, স্বীকার করছি সবার মনোবল সমান নয়, সবার যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলার ক্ষমতাও সমান নয়। সেই ক্ষেত্রে নিজের আবেগের থেকে নিজের বিশ্বস্থ মানুষের উপর বিশ্বাস রাখা জরুরি। আমি বিশ্বাস করি, কোথাও না কোথাও কেউ না কেউ থাকেই কথা শোনার, পাশে থাকার, সাপোর্ট করার। আর এজন্য মনের দরজা খোলা রাখা জরুরি।

Data Protection Rules এর কারণে আমি কারও নাম উল্লেখ করিনি। Consent & Proof ছাড়া কারও নাম বা ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবহার করা আইনগত নিষিদ্ধ। আমার এতগুলো কথা বলার কারণ হলো, অন্যান্য সাধারণ মেয়েদের সতর্ক/সচেতন করে দেয়া, সেইসঙ্গে আমার যদি কখনো কিছু হয়ে যায়, পরবর্তীতে এই স্টেটম্যানটি হয়তো কোনও কাজে লাগতেও পারে। তবে দুঃখ থেকে যাবে, আমি আমার বোনকে শক্ত করতে পারিনি। বাস্তবতার কাছে আগেই হার মেনেছে এই বাঙালি অথবা বাংলাদেশি নারী। প্রিয়তির ফেসবুক থেকে

লেখক: সাবেক মিস আর্থ ইন্টারন্যাশনাল