মলয় রায়চৌধুরীর প্রেমের কবিতা

পর্ব ১

তুষ্টি ভট্টাচার্য

প্রকাশিত : জানুয়ারি ০৯, ২০১৯

মলয় রায়চৌধুরী কেবল কবি নয়, পাটনার ইমলিতলা পাড়ার ছোটলোক ও অন্ত্যজদের সঙ্গে তিনি ছেলেবেলা কাটিয়েছেন। মলয় রায়চৌধুরীর জ্যাঠতুতো ভাই মেজদা চোর ছিলেন। কবিতা লেখার দায়ে মলয় রায়চৌধুরীকে কোমরে দড়ি বেঁধে কয়েকজন চোর-ডাকাতের সঙ্গে রাস্তায় হাঁটিয়ে পুলিশ আদালতে তুলেছিল। হিংসুটেরা বলে, মলয় রায়চৌধুরী আত্মপ্রচার সর্বস্ব একজন মানুষ। সেযুগে যখন আন্তর্জাল ছিল না, হাংরি বন্ধুদের কাছে পোস্টকার্ডে নিজের লেখার খবর জানাতেন। মলয় রায়চৌধুরী অত্যন্ত অশ্লীল লেখেন, কম বয়সী মেয়েদের সঙ্গে এখনও নষ্টামি করে চলেছেন। আমি এই মলয় রায়চৌধুরীর গত জন্মের ঠাকুমা ছিলাম। এ জন্মেও সেই আত্মিক টান কাটিয়ে উঠতে পারিনি। বছর চারেক আগে ‘কালিমাটি’ পত্রিকার একটি সংখ্যায় আমার বাবাকে নিয়ে একটু লিখেছিলাম। তখনও মলয় রায়চৌধুরীকে আমি চিনি না। মানে গত জন্মের স্মৃতি মনে আসেনি।

উনি সেই লেখা পড়ে মন্তব্য করলেন, ‘বাবার মুখ রেখেছিস তুই। যোগ্য বাপের যোগ্য মেয়ে।‘ পড়ে খুবই আবেগ প্রবণ হয়ে পড়লাম। আর তারপর বললেন, ‘আমি তোর বাপের চেয়ে পাঁচ বছরের বড়। আমাকে জেঠু বলবি।‘ সেই নতুন লিখতে আসা একটি মেয়ে এরকম আন্তরিকতার ছোঁয়া পেয়ে স্বাভাবিক ভাবেই আপ্লুত হয়েছিল। এবং তারপর থেকে আমার সমস্ত লেখার দিকে ওঁর কড়া নজর থাকে। এক সময়ে জানালেন, ‘বড় লেখার হাত তৈরি হয়ে গেছে। এবার উপন্যাস শুরু কর।‘ বারবার আমাকে কঠিন কঠিন বিষয় নিয়ে প্রবন্ধ লিখতে উৎসাহ দিয়েছেন। আর শুধু উৎসাহ বললে কম বলা হবে, কোন সাইটে গেলে ভালো তথ্য পাওয়া যাবে, সে বিষয়েও জানিয়েছেন। তো সেই আত্মপ্রচারক মলয় রায়চৌধুরী, যে কিনা নিজের লেখা ছাড়া আর কারুর লেখার দিকে নজর দেয় না বলে প্রচারিত ছিল, বুঝলাম সেই ধারণা কত ভুল, কত ঈর্ষান্বিত। এক সময়ে ওঁর নিজের মুখেই শুনেছি, যার বা যাদের লেখা ওঁর ভালো লাগে, তাদের উনি এভাবেই নিশ্চুপে উৎসাহ দেন।

মলয় রায়চৌধুরীকে নিয়ে লেখা,  বা ওনার কবিতা নিয়ে লেখা, আমার কর্ম নয়, এ আমি স্পষ্ট বুঝে গেছি। এখনও এই বয়সে হাজার রকম শারীরিক অসুবিধে নিয়ে এক আঙুলে কিবোর্ডে টাইপ করে লিখে চলেছেন। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, অনুবাদ আর প্রবন্ধ কত যে লিখেছেন আর লিখছেন, ছোটবেলার স্মৃতিকথা, ওঁর দাদার কথা, আমি এই লেখার সমুদ্রে পড়ে হাবুডুবু খেতে খেতে হাল ছেড়ে দিয়ে ডাঙায় উঠে বসেছিলাম বেশ কিছুদিন। নাহ, মলয় রায়চৌধুরীকে নিয়ে লেখা আমার দ্বারা আর হলো না। তবু মাঝে মাঝে মনে পড়ে যেত ওঁর কথা। এই তো সেদিন ওনার দাদা সমীর রায়চৌধুরী চলে গেলেন, মৃত্যুর পরে ওঁকে নিয়ে কত লেখালেখি হলো, হয়ে চলেছে, হবে। মলয় রায়চৌধুরী সম্পর্কে লেখার জন্য আবার আদা জল খেয়ে নামলাম। ইদানীং নিজের ব্লগে মলয়দা ওঁর বেশ কয়েকজন তরুণী প্রেমিকাকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন। তার আগে ওঁর সেই বিখ্যাত অবন্তিকা সিরিজ পড়েছি। তাই ভাবলাম, এমন একজন প্রেমিক পুরুষের প্রেমের কবিতা নিয়েই কিছু লিখি। হয়তো লিখতে গিয়ে এত এত প্রেম ওঁর আসে কোত্থেকে, জানা যাবে!

মলয় রায়চৌধুরীর ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ এর উল্লেখ না করলে উনি অসম্পূর্ণ থেকে যাবেন। এরকম এক পাগল করা কবিতা পড়তে গিয়ে আমি যে লাইনগুলোয় থেমে যাই, যেখান থেকে প্রেমিক মলয় রায়চৌধুরীর জন্ম, সেই উৎসমুখ হলো শুভা।

আজ আমি মগজের শরণাপন্ন বিপর্যয়ের দিকে চলে এলুম
আমি বুঝতে পার্ছি না কী জন্যে আমি বেঁচে থাকতে চাইছি
আমার পূর্বপুরুষ লম্পট সাবর্ণচৌধুরীদের কথা আমি ভাবছি
আমাকে নতুন ও ভিন্নতর কিছু কোর্তে হবে
শুভার স্তনের ত্বকের মতো বিছানায় শেষবার ঘুমোতে দাও আমায়
জন্মমুহূর্তের তীব্রচ্ছটা সূর্যজখম মনে পড়ছে
আমি আমার নিজের মৃত্যু দেখে যেতে চাই
মলয় রায়চৌধুরীর প্রয়োজন পৃথিবীর ছিল না
তোমার তীব্র রূপালি য়ূটেরাসে ঘুমোতে দাও কিছুকাল শুভা
শান্তি দাও, শুভা শান্তি দাও
তোমার ঋতুস্রাবে ধুয়ে যেতে দাও আমার পাপতাড়িত কঙ্কাল
আমাকে তোমার গর্ভে আমারই শুক্র থেকে জন্ম নিতে দাও
আমার বাবা-মা অন্য হলেও কি আমি এরকম হতুম?
সম্পূর্ণ ভিন্ন এক শুক্র থেকে মলয় ওর্ফে আমি হতে পার্তুম?
আমার বাবার অন্য নারীর গর্ভে ঢুকেও কি মলয় হতুম?
শুভা না থাকলে আমিও কি পেশাদার ভদ্রলোক হতুম মৃত ভায়ের মতন?
ওঃ বলুক কেউ এসবের জবাবদিহি করুক
শুভা, ওঃ শুভা
তোমার সেলোফেন সতীচ্ছদের মধ্যে দিয়ে পৃথিবীটা দেখতে দাও আমায়
পুনরায় সবুজ তোশকের ওপর চলে এসো শুভা
যেমন ক্যাথোড রশ্মিকে তীক্ষ্ণধী চুম্বকের আঁচ মেরে তুলতে হয়

কবির নিজের ভাষাতেই বলি, যেন ধর্ষণ থেকে ফিরে এসেছেন প্রেমে। নিজের মৃত্যু দেখতে চেয়েছেন, আরেকটা জন্ম পাবেন বলেই। আর এই শুভা ছাড়া এই বিবর্তন আমরা দেখতে পেতাম না কিছুতেই। এইখান থেকে শুরু হলো এক উপাখ্যান। হাংরি মলয় রায়চৌধুরীর পাশে চিরনবীন, সবুজ এক প্রেমিক কবিকে পেয়ে গেলাম আমরা।

এরপর দেখি অবন্তিকাকে। একজন আধুনিকা যিনি টেবিলের ওপর ঝুঁকে বসে আলফা, গামা, বিটার বিস্তারে অঙ্ক কষছেন, আর কবির তখন এই ইউক্লিডিনি প্রেমিকার অঙ্ক দেখে মাথা ঝাঁ ঝাঁ করছে, তাঁর নিজের লেখা চিঠিকে মহেঞ্জোদরোর লিপি বলে ভ্রম হচ্ছে। কবি তাঁর নবতম প্রেমিকা অবন্তিকার প্রেমে পুড়ে যেতে-যেতে তাকেই আকুল হয়ে জিজ্ঞেস করে চলেছেন, কি লিখেছিলাম আমি ওই পুরনো ভাষায়? এই সুন্দরী কি মর্ম উদ্ধার করতে পেরেছে প্রবীণ কবির অস্থিরতাকে? তারপর যখন দেখি এই কবিকে তন্নতন্ন করে কী যেন খুঁজছেন। অবন্তিকাকে খুঁজছেন মাঝরাতে? নাকি মায়ের ট্রাঙ্ক খুলে নিজের বিয়ের কার্ড দেখছেন? লকআপে পেচ্ছাপের ওপর বসে থাকা বেশ্যাকে খুঁজছেন? দুপুর রোদে লাঙল কাঁধে চাষিকে খুঁজছেন? রক্তমাখা অতীতকে খুঁজছেন আসলে। এবং সেটাও কবিতায় কবিতায়। এভাবেই প্রেমিক মলয় রায়চৌধুরীর এক একটি নির্মাণ কী নিপুণ ভঙ্গিতে কবিতা হয়ে উঠছে!

আবার কখনও এই অবন্তিকা যেন এক অনির্ণেয় সংজ্ঞা। যাকে কেউ কখনও দেখেনি, যার কণ্ঠস্বর কেমন কেউ জানে না। যার নরম যৌনতাকে তুলনা করা যায় না কোনো যৌনভাষ্য দিয়ে। যার পূর্বপুরুষের কোনো দেশ, কাল সীমা নেই। সে যদি কোনো বেড়ালকে কোলে তুলে আদর করে, সে নিজেই তখন বেড়াল হয়ে যায়। যেমন তেমন বেড়াল না, আলফা বিড়ালিনী ! তার ক্যাট-ওয়াকে চন্দ্র সূর্য হেলে যায়, সৌরমণ্ডল কেঁপে ওঠে। এমন এক অবিশ্বাস্য প্রেমিকা কবির কাছে নীলাভ দূরত্বে থাকা অরুন্ধতী ছাড়া কীই বা হতে পারে। কোনো পুরুষ এই অবন্তিকাকে ছুঁতে পারে না। ক্ষমা, শ্রদ্ধার প্রতিমূর্তী এই অবন্তিকাই আবার ক্যাটওয়াকের সময়ে কবিকেই খোঁজে!

চলবে