মলয় রায়চৌধুরীর প্রেমের কবিতা

পর্ব ২

তুষ্টি ভট্টাচার্য

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১০, ২০১৯

এহেন আধুনিকা অবন্তিকাকে কবি আবার বিড়ি ফোঁকা, গুটকা খাওয়া, বাংলা টানা, মিছিলে যাওয়া শ্রমিক মজুরের মতো কল্পনা করেছেন। তার চুমুতে শ্রমের স্বাদ, নিঃশ্বাসে ঘুমের গন্ধ, তার জিভে রক্তের ছোঁয়া, আর গায়ের ঘামে দিবাস্বপ্ন দেখতে পেয়েছেন কবি। জরায়ূ বাদ দিয়ে গোরস্থানে দাঁড়িয়ে থাকা অবন্তিকা যখন তার পূর্ব প্রেমিকদের বহুগামিতার কথা ভাবছে, তখন কবি লিখছেন শরীরই সার্বভৌম—

এই মনে করে যে দেহটা তো সার্বভৌম, মন বা মনন নয়–
মন না চাইলেও দেহে খেলে যায় ওগড়ানো তরল বিদ্যুৎ
যা কিনা ভালো-খারাপের ঊর্ধ্বে; ঠিকই বলেছিস তুই
শরীরই সার্বভৌম…

‘অবন্তিকার শতনাম’ কবিতাটি আমার মনে হয় অবন্তিকা সিরিজের সেরা কবিতা। কয়েকটি লাইন এখানে দিই—

আমি অবন্তিকার দুটো মাইয়ের নাম দিয়েছি কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়া… বাঁদিকেরটা আদর করলেই গোলাপি হয়ে যায়… ডানদিকেরটা আদর করলেই হলদেটে রঙ ধরে… বাঁদিকের বোঁটার নাম করেছি কুন্দনন্দিনী… বঙ্কিমের বিষবৃক্ষ তখন ও পড়ছিল চিৎ শুয়ে… ডানদিকের বোঁটার নাম ও নিজেই রেখেছে কর্নেল নীলাদ্রি সরকার, যে লোকটা সৈয়দ মুস্তফা সিরাজের ডিটেকটিভ… ডিটেকটিভ বই পড়তে ওর জুড়ি নেই… ছুঁলেই কাঁটা দিয়ে ওঠে তাই… যোগেন চৌধুরীর আঁকা ঝোলা মাই ওর পছন্দ নয়… প্রকাশ কর্মকারের আঁকা কালো কুচকুচে মাই ওর পছন্দ নয়… পেইনটিঙের নাম রাখা গেল না… যোনির কি নাম রাখবো চিন্তা করছিলুম… অবন্তিকা চেঁচিয়ে উঠলো পিকাসো পিকাসো পিকাসো… পিকাসোর যোনির কোনো আদল-আদরা নেই… কখনও বাদামি চুল কখনও কালো কখনও কিউবিক রহস্য… তাহলে ভগাঙ্কুরের… ও বলল সেটা আবার কি জিনিস… ওর হাত দিয়ে ছুঁইয়ে দিতে বলল অমঅমঅমঅম কি দেয়া যায় বলতো… পান্তুয়া চলবে… ধ্যুৎ… রস মানেই পান্তুয়া নাকি আরও কত রকম মিষ্টি হয়… ছানার পায়েস… নারকেল নাড়ু… রসমালাই… নকশি পিঠা… রাজভোগ… লবঙ্গলতিকা… হলদিরামে ভালো লবঙ্গলতিকা পাওয়া যায়… আমি বললুম স্বাদ কিছুটা নোনতা… ও বলল, দূর ছাই আমি নিজে টেস্ট করেছি নাকি যাকগে বাদ দে… হ্যাঁ…এগোই…পাছার কি দুটো নাম হবে… ডিসাইড কর… ডিসাইড কর… তুই কর আমি তো দেখতে পাচ্ছি না… না না ফের ফের… লাবিয়া নোনতা হলেও ওটার নাম দিলুম গোলাপসুন্দরী… পারফেক্ট হয়েছে… তাহলে পাছার একটাই নাম দিই… নরম নরম কোনো নাম… পাসওয়র্ড… ঠিক… এর নাম দেয়া যাক পাসওয়র্ড… ধ্যাৎ… পুরো রোমান্টিক আবহাওয়া ফর্দাফাঁই করে দিচ্ছিস……গ্যাস পাস হয় বলে পাসওয়র্ড হতে যাবে কেন… ছিঃ… তাহলে এর নাম হোক গরমের ছুটি…

এই কবিতায় যেন দুই কিশোর কিশোরীকে প্রত্যক্ষ করলাম আমি। যেন এরা শরীরের খেলায় মাতছে না, খেলা এদের প্রাণের। এদের বয়সও বাড়বে না যেন কোনোদিন, এভাবেই এরা ছেলেমানুষ থেকে যাবে। কবিতাটি তাই যৌনক্রীড়া ছেড়ে কেমন ভাবে যেন শিশুখেলার মাঠ হয়ে গেছে, কীভাবেই বা হলো এমন... ভাবি আর ভাবতেই থাকি। অবন্তিকা ব্যায়াম করা থেকে ওঠাবসা, প্রায় সমস্ত কল্পনাতেই কবি তীব্র প্যাশন এনেছেন। অবন্তিকাকে নিয়ে অনেক অনেক কবিতা লিখেছেন কবি, হয়তো সংখ্যায় সব থেকে বেশি প্রেমের কবিতা লিখেছেন এই অবন্তিকাকে নিয়েই। প্রেমের মোহময় রূপ শুধু না, শরীরী আকর্ষণ শুধু না, অবন্তিকার সুখ, দুঃখ, রোজকার জীবনের ছোট বড় সমস্ত অভিঘাত এসেছে এই সিরিজে। এক কথায় বলতে গেলে, অবন্তিকাই কবির স্পেশাল প্রেমিকা। তবে সমস্ত কবিতাগুলোতেই আবেগ যেমন আছে, প্যাশন যেমন আছে, নির্মাণও তেমনি আছে ষোলকলায়। আর এই মিস্তিরিগিরিতে মলয় রায়চৌধুরী আমাদের সবাইকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন, কীভাবে একেকটি নির্মাণ নিপুণ শিল্প হয়ে উঠতে পারে, আদ্যপান্ত কবিতা হয়ে উঠতে পারে।

মলয় রায়চৌধুরী কবি ও প্রেমিক। কবিতা, নাকি তাঁর প্রেম, কাকে মাহাত্ম্য দেব, আমি বুঝে পাইনি এখনও। আর চির তরুণ সবুজ এই কবি নিজেই লিখেছেন তাঁর ‘ঘাস’ কবিতায়—

ঢেউ তুলব ঘর্মাক্ত শরীরে, একদা
সবুজ ঘাস আমি, নবজন্মে আজ
প্রহেলিকা ইশারার ফাঁদ পেতে আছি
জানি কোনো সৎ-কাপুরুষ আসবে
তার বাড়তি বীজ ফেলার জন্য রাতে

চলবে