মলয় রায়চৌধুরীর প্রেমের কবিতা

শেষ পর্ব

তুষ্টি ভট্টাচার্য

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১১, ২০১৯

তাই তার প্রেম আর ফুরোয় না। বিগত জন্মের যে প্রেমিকাকে স্বীকৃতি দিতে পারেননি, এ জন্মে তার জন্যই লিখেছেন, মাথা কেটে পাঠাচ্ছি, যত্ন করে রেখো—

মাথা কেটে পাঠাচ্ছি, যত্ন করে রেখো
মুখ দেখে ভালোবেসে বলেছিলে, ‘চলুন পালাই’
ভীতু বলে সাহস যোগাতে পারিনি সেইদিন, তাই
নিজের মাথা কেটে পাঠালুম, আজকে ভ্যালেনটাইনের দিন
ভালো করে গিফ্টপ্যাক করা আছে, ‘ভালোবাসি’ লেখা কার্ডসহ
সব পাবে যা-যা চেয়েছিলে, ঘাম-লালা-অশ্রুজল, ফাটাফুটো ঠোঁট
তুমি ঝড় তুলেছিলে, বিদ্যুৎ খেলিয়েছিলে, জাহাজ ডুবিয়েছিলে
তার সব চিহ্ণ পাবে কাটা মাথাটায়, চুলে শ্যাম্পু করে পাঠিয়েছি
উলঙ্গ দেখার আতঙ্কে ভুগতে হবে না
গৌড়ীয় লবণাক্ত লিঙ্গ দেখবার কোনো স্কোপ  নেই
চোখ খোলা আছে, তোমাকে দেখার জন্য সবসময়, আইড্রপ দিও
গিফ্টপ্যাক আলতো করে খুলো, মুখ হাঁ-করাই আছে
আমার পছন্দের ননভেজ, সন্ধ্যায় সিঙ্গল মল্ট, খাওয়াতে ভুলো না
মাথাকে কোলেতে রেখে কথা বোলো, গিটার বাজিয়ে গান গেও
ছ’মাস অন্তর ফেশিয়াল করিয়ে দিও, চন্দনের পাউডার মাখিও
ভোরবেলা উঠে আর ঘুমোতে যাবার আগে চুমু খেও ঠোঁটে
রাত হলে দু’চোখের পাতা বন্ধ করে দিও, জানো তো আলোতে ঘুমোতে পারি না
কানে কানে বোলো আজও উন্মাদের মতো ভালোবাসো
মাথা কেটে পাঠালুম, প্রাপ্তি জানিও, মোবাইল নং কার্ডে লেখা আছে

কী ভয়ানক প্রেমিক! পড়লে গা শিউরে ওঠে। যে চিত্রকল্প তৈরি হয়েছে এই কবিতায়, একটা কাটা মাথা র্যা পারে মুড়ে পৌঁছচ্ছে প্রেমিকার বাড়ি। সেই মুখে আবার ছ’মাস অন্তর ফেশিয়াল, আবার আলো পড়লে ঘুমোতে পারেন না বলে চোখের পাতা বুজিয়ে দিতে হবে ! এই অসম্ভবকে সম্ভব করতে এই কবিই পারেন সম্ভবত। আবার এই কবিই ‘এক ন্যাংটো তন্বীর জন্য প্রেমের কবিতা’য় লিখছেন—

কুচকুচে চকচকে পুংঘোড়া হাঁকিয়ে ন্যাংটো তন্বী তুমি
দুর্বিপাক ডেকে আনলে ঝুলে-পড়া গোলার্ধ দুটোয়
জুজুবুড়ি জুজুবুড়ো খোকন খুকুরানি তটস্থ সক্কলে…

যেন মনে হচ্ছে পৃথিবী ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে, আর কবি এই মেয়েটিকে আর তার ঘোড়াকে দায়ী করছেন এর জন্য। যৌনতাকে এখানে তিনি ‘সবার আগে’ বা ‘সার্বভৌম’ বলতে পারেননি। এও কি তাহলে এক দ্বিচারিতা নয়?  নাকি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যৌনতার ভেদাভেদ হয়? এখানে আমাদের কবি ভাবার সময় দিয়ে চলে গেলেন অন্য কবিতায়। ‘কঙ্কালের দেশের জন্য প্রেমের কবিতা’য় যেখানে লিখছেন—

আমি বিষ খাই বিষ খাই বিষ খাই দীর্ঘ হয়ে উঠি
আকাশে মাথা ধাক্কা খেলে বুঝতে পারি উড়ছে অন্ধ পেঁচারা
আমার চোখ লক্ষ্য করে কঙ্কালরা হাড়ের স্লোগান আওড়ায়
চারিদিকে মানুষীদের জরায়ু পড়ে আছে বিষে নীল
নেকড়েরা তবুও জরায়ু টানাটানি করে চলেছে
আমি দীর্ঘ হতে থাকি দীর্ঘ হতে থাকি দীর্ঘ হতে থাকি
বিষ আমাকে এত ক্ষমতা দেবে তা তোমরা জানতে না
তোমরা মানুষ ছিলে এককালে এখন জানোয়ারের কঙ্কাল হয়ে গেছো

এখানে দেখি, মানুষের অধঃপতন আর তার ফল। এই বিষ কি আমাদের শরীরেও প্রবেশ করল না কিছুটা? মানুষের চামড়ায় ফোস্কা পড়বেই, যদিও তারা ক্রমে জানোয়ার না হয়ে উঠেছে। অবন্তিকা ছাড়াও কবি প্রেমের কবিতা লিখেছেন অনেকের জন্যই। তানিয়া চক্রবর্তীর জন্য প্রেমের কবিতায় দেখতে পাই, কবি যেন এক উদাসী পুরুষ। বারবার সাবধান করছেন প্রেমিকাকে—

আমি তো বুনোপ্রেমিক সাধু, আমার প্রেম বদনাম করবে তোকে
প্রাণচঞ্চল বাদামি পাথরের কাঁপুনি, অণুরণন, অয়ি প্ররোচনাময়ী
অ্যানার্কি— হাই ভোল্টেজ উল্কি— ক্রিয়া না বিশেষ্য বুঝতে পারি না
আমি তো মাটিতে-পোঁতা সাধু, তুই খুঁড়ে তুলবি বিপদে পড়বি
আমি ভাটিয়ালি গেয়ে বেড়াই, নৌকোর দাঁড় বাইনি কখনও

দিল্লি-নিবাসী সুন্দরী সম্পাদিকা সোনালী মিত্রকে লিখছেন এভাবে—

সোনালী প্রেমিকা! তুইই বুঝিয়েছিলিস: হুদোহুদো বই লিখে
বিদ্বানের নাকফোলা সাজপোশাক খুলে দেখাও তো দিকি
কালো জিভ কালো শ্লেষ্মা কালো বীর্য কালো হাততালি
উলঙ্গ নাচো তো দেখি তাণ্ডবের আঙ্গিকবর্জিত তালে তালে
চুমুর পুনঃচুমু পুনঃপুনঃচুমু দিল্লির নিম্নচাপ মেঘে
এ দ্যাখ গণ্ডারের শিব-সত্য-সুন্দরের চামড়া খুলে ফেলে
আজকে পেয়েছি নখে প্রেমিকার চুলের জীবাশ্ম!

কবিকে যেন পাণ্ডিত্যের, আভিজাত্যের বর্ম থেকে বের করে সাধারণ মানুষের মত বোধ আয়ত্ব করিয়েছেন তাঁর এই প্রেমিকা। বিবাহিতা ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায়ের জন্য প্রেমের কবিতায় কবি যেন হয়েছেন সুন্দরের পূজারী—

অসহ্য সুন্দরী, আমার নিজের আলো ছিল না
তোর আলো চুরি করে অন্ধকারে তোরই ছায়া হয়ে থাকি
তোর আর তোর বরের নাঝে শ্বাসের ইনফ্যাচুয়েশানে
অসহ্য সুন্দরী, বেহালার কোন তারে তোর জ্বর, তা জানিস?
জানি না কেমন করে রেমব্রাঁর তুলি থেকে পিকাসোর তুলিতে চলে গেলি!

বাংলাদেশি প্রেমিকা উপমা অগাস্টিন খেয়ার জন্য প্রেমের কবিতায় রয়েছে শুধুই প্রেম আর প্রেম, একটু বিষাদ মাখা বিরহের ছোঁয়াও আছে অবশ্য—

উপমাকে পেতে আমার সারা জীবন লেগে গেল, জানি পাবো না
পুরুষদের কাটা মাথার আবর্জনায় আমার মাথা তুই চিনতে পারিসনি
কবিতারা কেন যে উপমাকে বাদ দিতে শকুন কলোনিতে ঢোকে
আকাশে পাক ধরেছে, দেখতে পায় না—

এভাবেই একে একে অনামিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, কৃতি ঘোষ, সোনালী চক্রবর্তীর জন্য লিখেছেন বিভিন্ন স্বাদের প্রেমের কবিতা। কবির অফুরান কলমের কালি, অবিরাম মেধা আর শ্রম রয়েছে এই কবিতাগুলোর পিছনে। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমার দুটি কবিতাকে মনে হয়েছে ভীষণ রকম আন্তরিক। যার পেছনে কারিগরির থেকে অন্তরের আবেগের টানটাই বেশি। ‘বুড়ি’ কবিতার কাছে আমার আজীবন প্রণাম রেখে গেলাম। আর কবির মৃত্যুচেতনা নিয়ে লেখাগুলোর মধ্যে এটিও একটি।

এই বুড়ি আমার দিদিমার বয়সী
চুল পেকে গেছে, কয়েকটা দাঁত
নেই, দিদিমার মতন শুয়ে থাকে—
কবে শেষ হয়ে গেছে পুজো-পাঁজি
ক্যালেণ্ডারে ছবি-আঁকা তিথি
দিদিমার মতো এরও প্রতিরাতে
ঘুম পায় কিন্তু আসে না, স্বপ্নে
কাদের সঙ্গে কথা বলে, হাসে
চোখে ছানি তবু ইলিশের কাঁটা
বেছে ঘণ্টাখানেকে মজে খায়
দিদিমার মতো, বলেছে মরবে
যখন, চুড়ি-নাকছাবি খুলে নিয়ে
পাঠাতে ইনসিনেটরে, এই বুড়ি
চল্লিশ বছর হলো সিঁদুর পরে না
পঞ্চাশ বছর হলো শাঁখাও পরেনি
দামি-দামি শাড়ি বিলিয়ে দিয়েছে
দিদিমা যেমন তপ্ত ইশারায়
দাদুকে টেনে নিয়ে যেতো রোজ
এও আমাকে বলে এবার ঘুমোও
আর রাত জাগা স্বাস্থ্যের পক্ষে
খারাপ, এই বুড়ি যে আমার বউ
বিছানায় শুয়ে বলে, কাউকে নয়
কাউকে দিও না খবর, কারুক্কে নয়—
এ-কথাটা আমারই, কাউকে নয়
কারুক্কে বোলো না মরে গেছি।

আরেকটি কবিতা, যা ঠিক প্রেমের কবিতা না হলেও এখানে উল্লেখ না করে পারছি না। নববিবাহিত দুজনের প্রেমের ওপর বাবা-মা’র যে আস্কারা বা যে অধৈর্য হয়ে পড়ার চিত্র এই কবিতায় দেখি, তাও মনে থাকবে অনেক দিন।

নতুন বউ
আমরা দুজনে বাথরুমে বৃষ্টির তলায় নাচি
আমাকে সাবান মাখাচ্ছে ও, আমি ওর চুলে
শ্যাম্পু লাগিয়ে তুলছি বঙ্গোপসাগরের ফেনা
মুখে ঢেউ বুকে বানভাসি হাসছি দুজনে
দেড় ঘণ্টায় আমি ওর ও আমার মাংসে মিশেছে
বন্ধ দরোজার ভেতরে আয়না লাগিয়ে
দিয়ে গেছে দাদা, নতুন বউ যে এসেছে সংসারে—
দেখাচ্ছি দুজনের বেপরোয়া পেছলা তাণ্ডব
প্রথম দিনের স্নানে জীবন্ত পেইনটিঙ
বাথরুমে বনাঞ্চল ঝর্ণা নতুন বউকে নিয়ে
সাবান মাটিতে পড়লে চেঁচিয়ে উঠছে ও
‘এই এই ভালো হবে না কিন্তু বলে দিচ্ছি
বাথরুমে নয়, কালই তো ফুলশয্যা করেছিলে’

হঠাৎ বাইরে থেকে বাবার কণ্ঠস্বর শুনি—
‘আর কতক্ষণ লাগবে তোদের, দুঘণ্টা তো হলো
কখন করব চান, কখন বসব খেতে, আজকে পূর্ণিমা’

মায়ের ফিসফিসানিও শুনতে পাই, বাবাকে বলছেন—
‘আহ, দাও না দুজনকে একটু ভালোভাবে
পরিচয় করে নিতে, কাল থেকে তো সেই
চাড্ডি মুখে গুঁজে নিয়ে দশটা পাঁচটার সংসার’

অনেক দিন আগে মলয় রায়চৌধুরী লিখেছিলেন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রতিষ্ঠিত ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার জন্য আমন্ত্রিত এক কবিতায়, যা পত্রিকা-কর্তৃপক্ষ প্রকাশ করেননি, ‘নীরা আমার ঠাকুমা ছিলেন।‘ সুনীলের নীরাকে নিজের ঠাকুমা বানিয়ে দিয়েছিলেন অবলীলায়! একজন নীরা, যে কিনা সারাজীবন আগের প্রজন্মের এক কবির প্রেমিকা, অধরা মাধুরী, যার বয়স কোনোদিন বাড়ল না, আর তাকেই মলয় রায়চৌধুরী বানিয়ে দিলেন নিজের ঠাকুমা! তো, সব শেষে এসে এইখানে নিজের জন্য একটু আশার আলো আমি দেখতে পাই। নীরা যদি ঠাকুমা না হয়েও মলয় রায়চৌধুরীকে দিয়ে ঠাকুমার কবিতা লেখাতে পারেন, আমি যে কিনা মলয় রায়চৌধুরীর গত জন্মের ঠাকুমা ছিলাম, আমাকে  নিয়েও নিশ্চই লেখা হবে কোনো যুগান্তকারী কবিতা, একদিন না একদিন।