মাঝে মাঝে দ্যাখা হয় নিয়তির সাথে

শ্রেয়া চক্রবর্তী

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ০৭, ২০১৮

মাঝে মাঝে যাওয়া আসার পথে নিয়তির সাথে দ্যাখা হয়। নিয়তি হয়তো তখন বাজারের থলে হাতে বেরিয়েছে। গাড়ির কাঁচ শিশির লেগে ঝাপসা হয়ে আছে। তবু বুঝতে পারি, নিয়তির চোখ আমার দিকে। সেই চোখ দু’খানা, তীক্ষ্ম এবং স্থির। রিমলেস ফ্রেমের ভেতর জ্বলজ্বল করে চেয়ে থাকে। আমি চিনেও না চেনার ভান করি। ড্রাইভারকে বলি না, ‘ভাই গাড়ি থামান। ওনাকে লিফ্ট দেব।’ না, অত পাত্তা দেই না আর। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি, নিয়তি ক্রমশ ছোট হতে হতে মিশে যাচ্ছে দূরগত ছায়াদের সাথে। হাতে তার বাজারের থলে।

কখনো ভাবি, বড় বেশি রূঢ় হয়ে গেছি। একজন পুরুষ মানুষ একবার বলেছিল, ‘ধুর এত বেরসিক হয়ো না।’ কী আর করবো? রঙ ঢঙ জানিনে, ঘুম ঘুম চোখ বড় বেশি আকাশের খোঁজে থাকে। তাই ভাবি মাঝে মাঝে, নিয়তিকে নিয়ে কফি খেতে গেলে কেমন হয়? ডেকে বলতে ইচ্ছে হয়, ‘রাখুন তো আপনার বাজারের থলে। আমাদের একসাথে সমুদ্রে যাওয়ার কথা ছিল মনে আছে? সেই আপনি এখন রোজ থলে হাতে বাজারে যান? রোজ? চলুন কফি খাই।’

এরপর যা বলার নিয়তিই বলে। বলে, ‘তোমাকে বুঝতে পারি না আমি। কী যে দেব তোমাকে! স্তুতি না বিদ্বেষ, বুঝতে পারি না। এত ভয় পাও কেন আজকাল?’ একথা শোনার সাথে সাথে ভেতরটা কেঁপে ওঠে আমার। কফি কাঁপে লেগে থাকা লিপস্টিক চুঁইয়ে নামে নাভির গভীরে। কাজল ঘেঁটে যায় অকস্মাৎ। এত বড় কথাটা লোকটা বললো কি করে? সত্যি! কাকে এত ভয় পাই আজকাল? কাকে? ভয়ে জেগে থাকি সারারাত। কিন্তু নিয়তি সে কথা জানলো কি করে?

নিয়তির চোখ হাসে। বড় গভীর সেই হাসি। শার্টের ভেতর থেকে তার রোমশ বুক দেখা যায়। আমি কোনোদিন মাথা রাখিনি সেই বুকে। আমি কখনো কারো বুকে মাথা রাখবো না আর। এতখানি নিশ্চিত হবো সেই সুসময় কই? বরং ইচ্ছে করে, আখড়ায় যাই। বাউল গান শুনি, সাধুসঙ্গ করি। ক্রমশ সম্পৃক্ত হই। নিজেকে ভালোবাসতে সাধ জাগে খুব।

তবু ভয়ে আঁকড়ে ধরি নিয়তির হাত। মনে হয় মুঠো ভরে উপড়ে নেই তাকে, বন্দি করে রাখি। এত সাহস হয় না আর। কাকে ভয় পাই আমি? কাকে? ভয় সেই সকল চোখকে যারা আমার দিকে চেয়ে আছে। গোপন সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো আছে যেন চতুর্দিকে। এক্ষুণি সেইসব ছবি ট্রিন্সফার হয়ে চলে যাবে দিগন্তের ওপারে। নিজের চোখে নিজেকে দেখিনি কতকাল হলো? মশগুল হয়ে শুধু কাপড় জড়িয়েছি, কেবল রঙ মেখেছি। নিয়তি সে কথা জানে। বাতাসের মতো কানে কানে বলে ওঠে, ‘কফি ঠাণ্ডা হয়ে গেল যে।’

এই যাওয়া আসার কোনো মানে খুঁজে পাই না আর। কিছু কিছু মানুষের খোঁজ থাকে আজন্ম। সেই অতৃপ্তি নিয়েই সে বাঁচে। এটাই তার নিয়তি। তাকেও অতিক্রম করা যায় কি? যে অনেক খুঁজেও আমাকে পেলো না, আমি কেবল তার কথা ভাবি। হঠাৎ কে যেন কানের কাছে জোরে জোরে গান বাজিয়ে দেয়:

রনজিস হি সহি দিল দুখানে কে লিয়ে আ
আ ফিরসে মুঝে ছোড় জানেকে লিয়ে আ
রনজিস হি সহি...

এত আবদার সহ্য হয় না আর! চিৎকার করে বলে উঠি, ‘বন্ধ করো। বন্ধ করো। বন্ধ করো।’ সমস্ত আওয়াজ থেমে যায় হঠাৎ, হঠাৎই!

লেখক: কবি