মানুষ মার্কস মানুষের মার্কস

মাজেদা মুজিব

প্রকাশিত : মে ০৮, ২০১৮

কার্ল মার্কস (১৮১৮-১৯৮৩) পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষের পথ প্রদর্শক, শ্রেষ্ঠতম শিক্ষক। জীবনে কখনো আক্ষেপ করেননি, পেছনে ফিরে তাকাননি, মানুষের আচরণে বিস্মিত হননি। এই মহান দার্শনিক শুধু নিজের বোধ-বুদ্ধির উপর আস্থা রেখে বিশ্লেষণ করেছিলেন সমগ্র পৃথিবীকে। এখন পর্যন্ত তিনি পৃথিবীর সবচে প্রভাব বিস্তারকারী দার্শনিক। তাকে নিয়ে হাজার হাজার গ্রন্থ রচনা হয়েছে। বাংলা ভাষাতেও তার তত্ত্ব ও দর্শন বিষয়ক আলোচনা গ্রন্থের বাইরেও বেশ কিছু জীবনীগ্রন্থ আছে। কিন্তু তার জীবনভিত্তিক উপন্যাস সম্ভবত বাংলাদেশে নাই! সেই আক্ষেপ কিংবা ঘাটতিটি মিটিয়েছেন কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদার `কার্ল মার্কস মানুষটি কেমন ছিলেন’ এর মাধ্যমে। ইতিহাসনির্ভর জীবনীভিত্তিক উপন্যাসের কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে। ইতিহাসের সাথে ব্যক্তি মানুষটির সাযুজ্য রক্ষা করতে গিয়ে প্রায় সময়েই ইতিহাস এবং মানুষটি নিজের জায়গা থেকে সরে আসে। তাছাড়া ফিকশন ইতিহাস বলার দায়িত্ব নিলে ইতিহাস বর্ণনায় কিছু বিড়ম্বনা ঘটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। `কার্ল মার্কস মানুষটি কেমন ছিলেন` উপন্যাসটি লিখতে গিয়ে ঔপন্যাসিককে প্রচুর ঘটনা ও ইতিহাসের সম্মুখীন হতে হয়েছে এবং প্রয়োজনীয় ও সংশ্লিষ্ট বিষয়কে উপন্যাসের অংশ করার জন্য বাছাইয়ে মনোযোগ দিতে হয়েছে। যেহেতু জীবনীভিত্তিক উপন্যাসের চরিত্রে ঔপন্যাসিক তার ইচ্ছে আরোপ করতে পারেন না এবং পরিণতিও দিতে পারেন না, সেহেতু কাহিনি বর্ণনার গাল্পিক চমৎকারিত্ব আনয়ন ছাড়া ঔপন্যাসিকের হাতে বিশেষ কিছু থাকে না। তবে থাকে চরিত্রকে, ঘটনাকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি এবং ঔপন্যাসিকের এই দেখার দৃষ্টিভঙ্গি, পক্ষপাতিত্ব বা নিরপেক্ষতা দিয়ে উপন্যাসের পাঠক তাড়িত হন। আর মার্কস ও মার্কসবাদ সারা বিশ্বে এত পরিমাণে পঠিত ও চর্চিত বিষয় যে, তার ব্যক্তিজীবনকে দেখাতে গিয়েও ঔপন্যাসিককে সচেতন থাকতে হয়েছে। এখানে লেখকের সৃজনশীলতার ‘অবাধ’ ব্যবহারের সুযোগ নাই বা ছিল না।

মার্কসের জীবনীভিত্তিক এই উপন্যাসটি নানা কারণে বাংলাদেশের পাঠকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ জাকির তালুকদার মার্কসকে নিয়ে উপন্যাস লিখে একইসাথে উপন্যাস এবং ইতিহাসের স্বাদটি দিতে চেয়েছেন। এছাড়া মহান এই দার্শনিককে বৃহৎ পরিসরে জানার সুযোগও করে দিয়েছেন। কার্ল মার্কস ১৮১৮ সালে জার্মানির রাইন জেলার ট্রিয়ার শহরে জন্মগ্রহণ করেন। যদিও ট্রিয়ার তখন প্রুশিয়ার অন্তর্ভুক্ত ছিল। কার্ল মার্কস দশ ভাইবোনের মধ্যে দ্বিতীয়। অবশ্য বড় ভাইয়ের মৃত্যুর পর পরিবারে প্রথম সন্তানের আদরে বড় হয়েছেন মার্কস। মার্কস বাবা-মায়ের বিশেষ অনুরাগী ছিলেন না যদিও, বাবার গল্প বলার গুনটি পেয়েছিলেন চমৎকারভাবে। বোনদের সাথেও শেষপর্যন্ত মার্কসের কোনো যোগাযোগ ছিল না মতাদর্শগত কারণেই। মার্কস একজন কমিউনিস্ট, এই পরিচয় বোনদের কাছে কোনো অর্থ বহন করতো না। বরং তারা বলে বেড়াতেন, মার্কস তার আইনজীবী বাবার ও পরিবারের জন্য কোনো সম্মান বয়ে আনেনি। মার্কসের পরিবার শহরে মোটের উপর সম্মানিতই ছিল। কিন্ত  মার্কস এসব পরিচয়কে ঝেড়ে ফেলতে পেরেছিলেন। এমন অনেককিছুকে তিনি ঝেড়ে ফেলেছিলেন। তোয়াক্কা করেননি তথাকথিত মান-মর্যাদা, স্বাচ্ছন্দ্য এবং প্রচলিত দার্শনিক ও তাদের মতবাদকেও এবং নেপোলিয়নের মতো রাষ্ট্রনায়ককেও। সবকিছু ছিল একদিকে, মার্কস একাই হয়েছিলেন মার্কস। ১৮৩৫ সালে ১৭ বছর বয়সে জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ভর্তি হন। যথেষ্ট নিয়মকানুনের মধ্যে বড় হলেও মার্কস শারিরিকভাবে একটু দুর্বলই ছিলেন। এমনকি তার বাবা হেনরিখ আশঙ্কা করেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে অতগুলো কোর্স তিনি একসাথে সম্পন্ন করতে পারবেন কীনা। রোগাটে হওয়ার কারণে জার্মানিতে বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ করা থেকেও তিনি মুক্তি পান। অবশ্য এতে খুশিই হয়েছিলেন মার্কস। মার্কসের ছিল ঘন চুল আর কৌতূহলী ও আকর্ষণীয় কালো চোখ। বিশ্ববিদ্যালয়ে তার বন্ধু নেই বললেই চলে কিন্তু তিনি যোগাযোগ রেখেছিলেন বন্ধু এডগার ভন ভেস্টাফেলনের সাথে। অবশ্য এ যোগাযোগের নেপথ্যে বন্ধুর বোন জোহানা বার্থা জেনিই মুখ্য ছিল। চার বছরের বড় জেনির সাথে মার্কসের প্রণয় গড়ে ওঠে। জেনির বাবা ছিলেন তৎকালীন প্রুশিয়ার প্রাদেশিক সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। পারিবারিকভাবে জেনির বিয়ে ঠিক হয়েছিল এক লেফটেনেন্টের সাথে। কিন্তু জেনি সে সম্পর্ক মানেননি। ১৮৩৬ সালে জেনি লুকিয়ে মার্কসের কাছে চলে এসেছিলেন এবং মার্কসের মতো অসংসারী এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষি একজন বেকার যুবককে গোপনে বিয়ে করেছিলেন। মার্কসের পক্ষে সম্ভব হয়নি জেনিকে তার কাছে রাখা। মার্কসের সাথে জেনির সংগ্রামী জীবনকে ঔপন্যাসিক অত্যন্ত মমতা দিয়ে উপস্থাপন করেছেন। এছাড়া জেনির স্থির ও সংযমী মানসিকতা মার্কসের মতো দার্শনিকের দর্শন চর্চার পেছনে ইতিবাচক হয়েছিল। এ বিষয়টি যত্ন ও সম্মানের সাথে ঔপন্যাসিক তুলে এনেছেন।

বন থেকে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন মার্কস। এখানেই তিনি পরিচিত হন হেগেলের দর্শনের সাথে। হেগেলের দর্শন মার্কস এতবেশি বিশ্লেষণ করেছিলেন যে, শেষপর্যন্ত তিনি হেগেলের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদকে গ্রহণ করেছেন কিন্ত ভাববাদকে উড়িয়ে দিয়েছেন। সমালোচক মার্কস পুরোজীবনে শুধু দার্শনিক হেগেল আর কবি হাইনরিখ হাইনেকেই সমীহের দৃষ্টিতে দেখতে পেরেছিলেন। মার্কস ছিলেন প্রকৃত সমালোচক। ভালোটা গ্রহণ করতে জানতেন। বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি পিএইচডিতে ভর্তি হন। বিষয় ছিল, ডেমোক্রেটিয়ান ও এপিকিউরিয়ান দর্শনের পার্থক্য। হেগেললপন্থী অধ্যাপক এডওয়ার্ড গেনস ছিলেন মার্কসের পিএইচডি থিসিসের তত্ত্বাবধায়ক। অধ্যাপকের আকস্মিক মৃত্যুতে তার থিসিস তত্ত্ববধানের দায়িত্ব পান কট্টরপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল জুলিয়াস স্টোহল। যেকোনো গবেষণাকর্মে তত্ত্বাবধায়কের সাথে মতাদর্শগত মিল না থাকলে কাজ করা দূরহ ব্যাপার। মার্কসও বিপদে পড়েছিলেন। অবশেষে তিনি বার্লিন থেকে ছাড়পত্র নিয়ে ইয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে থিসিস পেপারটি জমা দেন এবং ১৮৪১ সালে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ভেবেছিলেন, পিএইচডি তার বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। কিন্তু তার এ থিসিস তাকে দার্শনিক মতবাদের দিকে অগ্রসর করা ছাড়া আর কিছুতে সহায়ক হয়নি। তিনি বরং জার্মান সরকারের সেন্সরে পড়ে গিয়েছিলেন এবং তার থিসিসটিও। এতে করে তিনি হেগেলপন্থী হিসেবে খ্যাতি পান এবং একই সময়ে ব্রুনো বাউয়ারের ইহুদিবাদ প্রশ্নের উত্তরে মার্কস ধর্মের নামে মানুষকে শোষণ করা এবং শোষিত হওয়ার প্রবণতা থেকে মানুষের মুক্তির কথা বলে ইহুদিবাদের বিরোধী চরিত্র হিসেবে পরিচিতি পান। তিনি মূলত বলতে চেয়েছিলেন ধর্মের ব্যবহারকেই বরং ছেঁটে ফেলতে হবে। সেটা ইহুদিবাদ বা খ্রিস্টবাদ যাই হোক না কেন। `টু ওয়ার্ডস এ ক্রিটিক অব হেগেলস ফিলোসফি অব রাইট- এন ইন্ট্রোডাকশন` প্রবন্ধ লেখার পরে তিনি আরেকবার সবার নজরে আসেন। এখানে তিনি বলেন, `ধর্ম হচ্ছে জনগনের আফিম।` এরপরে তিনি বস্তুবাদী দার্শনিক অভিধার সাথে নাস্তিক পরিচিতিটাও ঝুলিতে তোলেন। ১৮৪৩ সালে জেনির সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ের পর তিনি আরো বেশি মনোযোগী হন লেখালেখির প্রতি। তিনি বোধ করেন জার্মান এখন তার জন্য সুখকর জায়গা নয়। উল্লেখ্য, মার্কস স্বেচ্ছায় জার্মান ত্যাগ করলেও তার লেখা ও চিন্তা তাকে জার্মান ত্যাগে বাধ্য করতো। কারণ তিনি চলে এসেছিলেন জার্মান সরকারের দেশ থেকে নাস্তিক বিতাড়নের তালিকায়। মার্কসের পেশা জীবন, তার লড়াই, শিক্ষক না হতে পারা, স্থির হতে না পারা ইত্যাদি প্রতিটা সময়ের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ আমরা অতটা পাই না উপন্যাসটিতে। যা আসতে পারলে আরও ভালো হতো। মনস্তত্ত্বের জায়গাটা সাধারণ বর্ণনার ভেতর দিয়েই এগিয়েছে উপন্যাসে। যা কিছু এসেছে, তা নিতান্ত ঘটনা পরম্পরায়। হতে পারে লেখক ইচ্ছা করেই এইদিকে মন দেননি।

এ উপন্যাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র জেনি। মার্কসের জীবন সঙ্গী। চার বছরের ছোট মার্কসকে বিয়ে করে এক চ্যালেঞ্জিং জীবন বেছে নেন। মার্কসের সারাজীবনের সকল কাজ, সকল দারিদ্র্যের সঙ্গী হয়েছিলেন তিনি, হয়েছিলেন ভরসাস্থল। জেনির মা তাকে তার বাবার মৃত্যুর পর টাকা পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছিলেন। জেনি বিয়ের সময় যে উপহার পেয়েছিলেন তা বিক্রি করে দিয়েছিলেন মার্কস। প্যারিসে প্রথম সন্তান জেনিচেনের জন্ম হয়। জেনি ও মার্কস উভয়েই বুঝলেন, অর্থ সঙ্কটে সন্তান লালনপালন করা কী কষ্টকর! মার্কসের সান্নিধ্য জেনিকে ত্যাগ করতে হলো। জেনিচেনকে নিয়ে জেনি মায়ের কাছে ট্রিয়ারে যান। বিয়ের পরে প্রথম জেনি মার্কসকে অনুরোধ জানান, স্থায়ী ইনকামের ব্যবস্থা করতে, যেন জেনি সবসময় মার্কসের সঙ্গেই থাকতে পারেন। মার্কসের কখনোই স্থায়ী কোনো ইনকাম ছিল না। সমস্ত কষ্ট মেনে নিয়েছিলেন জেনি।  আর কখনো অনুরোধ করেননি, অভিযোগও করেননি। মার্কস জেনির অর্থকষ্টে, সন্তানের মৃত্যু ইত্যাদি মানবিক বিষয়সমূহ উপন্যাসেও খুব যত্নের সাথেই এসেছে।

গরিবত্বই পৃথিবীর সবচেয়ে নোংরা দিক। গরিব থাকা আরো ন্যাক্কারজনক এবং গরিবত্বকে পুঁজি করে গড়ে ওঠা ধনীত্বই হলো পৃথিবীর উপর চাপিয়ে দেয়া দুঃসহ অসাম্য, অন্যায্য ও অগ্রহণীয় বিষয়। মার্কস এই গরিবত্বের অবসান চেয়েছিলেন। নিজেকে অর্থসঙ্কট থেকে মুক্তি দিতে পারেননি, কিন্তু কখনোই মার্কস তার এই অর্থসঙ্কট অন্য কারো কাছে প্রকাশ করেননি। এঙ্গেলসের মতো বিরল বন্ধু ছাড়া। দার্শনিক মার্কস, আইনবিদ মার্কস, অর্থনীতিবিদ মার্কস সমাজবিজ্ঞানী একত্রে এ-পৃথিবীর শোষণের শৃঙ্খল ভাঙতে চেয়েছেন। মানুষের সবচেয়ে বড় মুক্তি হিসেবে তিনি অর্থনৈতিক মুক্তিকেই সামনে এনেছেন। এডাম স্মিথ, ডেভিড রিকার্ডো, জেমস মিল পড়ে ইউরোপের অন্যান্য দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সাথে ব্রিটিশদের অর্থতত্ত্বও জেনে নিলেন। পৃথিবীর সব দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার যোগসূত্র পেয়ে গিয়েছিলেন তিনি। শ্রমিক আর মালিক, শাসক আর শোষিতের দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের বাইরে পৃথিবীতে আর কোন সম্পর্ককে তিনি সত্য বলে মানেননি। লিখিত সমস্ত ইতিহাসকে তিনি চিহ্নিত করলেন শ্রেণি দ্বন্দ্বের ইতিহাস হিসেবে। `ভোরওয়াটস` পত্রিকায় `ইকোনমি এন্ড ফিলোসফিক্যাল মেনুস্ক্রিপ্ট` নামক নোট প্রকাশ করে বললেন, `মজুরি নির্ধারিত হয় শ্রমিক ও পুঁজিপতির তীব্র দ্বন্দ্বের মাধ্যমে। এ দ্বন্দ্বে জয়ী হয় পুঁজিপতি।` তিনি বিশ্লেষণ করে দেখালেন কিভাবে আধুনিক শ্রমব্যবস্থায় শ্রমিক পণ্যে পরিণত হয়। রিকার্ডো ও স্মিথের অর্থনৈতিক তত্ত্বের দুর্বলতা হিসেবে  তোলে ধরেছেন ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে ধ্রুব ধরে নিয়ে রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্রে অগ্রসর হওয়া এবং পরবর্তীতে প্রায় সব অর্থনীতিবিদের অর্থতত্ত্বকে তিনি প্রয়োগহীন বলে খণ্ডন করেছেন। দার্শনিকদের নিয়ে বলেছেন, এতদিন যাবত দার্শনিকরা পৃথিবীকে নানা উপায়ে কেবল ব্যাখ্যাই করে চলেছেন। কিন্তু বিষয়টা হচ্ছে, পৃথিবীকে পালটানো। এবং প্রয়োগহীন তত্ত্ব হলো `বুদ্ধিবৃত্তিক স্বমেহন বা হস্তমৈথুন`। ঔপন্যাসিক জাকির তালুকদার একে ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে, `যা হয়তো যথেষ্ট আনন্দ দান করতে পারে কিন্তু পরিণতিতে তা বন্ধ্যা, কোনোকিছুই উৎপাদন করতে পারে না।` মার্কস চেয়েছিলেন তার তত্ত্বের প্রয়োগ এবং উৎপাদনশীল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। তার `জার্মান ইডিওলজি` যা পরবর্তীতে থিসিস অন ফয়েরবাখ নামে পরিচিতি পায়, এখানে তিনি অর্থব্যবস্থা, উৎপাদন ও বণ্টনব্যবস্থা তত্ত্ব দেন। জার্মান ইডিওলজি হলো কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো ও ডাস ক্যাপিটালের চিন্তার প্রাথমিক সূত্র। যে সাম্যবাদী সমাজের রূপরেখা তিনি এই বইয়ে তুলে ধরেছেন তা পড়ার পরে এক লোক জনসম্মুখে প্রশ্ন করেছিলেন, `সাম্যবাদী সমাজে জুতা সেলাই করবে কে?`

মার্কস সাথে সাথেই উত্তর দিয়েছিলেন, `তুমি।` মার্কসের তত্ত্ব  নিয়ে যারা ভুল ব্যাখ্যা করেন, বিভ্রান্তি ছড়ান তারা প্রকৃতপক্ষে মার্কসের তত্ত্বকে বুঝে উঠতে পারেননি এবং এ পর্যন্তও এ সংখ্যা বিপুল। ঔপন্যাসিক জাকির তালুকদার বিংশ শতকের ব্রিটিশ রাষ্ট্রনায়ক টনি ব্লেয়ারকেও এই সারিতেই ফেলেছেন। অবশ্য টনিদের মতো শোষকরা বুঝবেই বা কেন! ফলে অনেকের শুধু ব্যক্তিগত লাভালাভের জন্যই তাকে বোঝেন না, বা বুঝতে চাননি অথবা ইচ্ছা করে ‘বুঝ’ আড়াল করেছেন।

মার্কসের সাথে এঙ্গেলসের বন্ধুত্ব হয়েছিল ১৮৪৩ এর দিকে। মার্কস ও এঙ্গেলসের বন্ধুত্ব পৃথিবীর জন্য এক নতুন প্রাপ্তিও বটে। বন্ধুকে কিভাবে বিশ্বাস, শ্রদ্ধাবোধ, সমালোচনা, পারস্পারিক সহযোগিতায় নিজের অংশ করে নিতে হয় মার্কস এঙ্গেলসের বন্ধুত্ব এ যাবত পর্যন্ত ভালো উদাহরণ হিসেবে সামনে আসতে পারে। এঙ্গেলসই মার্কসের একমাত্র বন্ধু যিনি মার্কসের লেখালেখিসহ পরিবারের খোঁজখবরও রাখতেন। মার্কসকে নিয়ম করে টাকা পাঠিয়েছেন। পরিবারের সদস্যদের মতো মার্কসের বাসায় থেকেছেন। মার্কসের সন্তানদের অসুখের চিকিৎসার ভার নিয়েছেন। এঙ্গেলস তার নিজের বেতনের অংশসহ পরিবার থেকে পাওয়া অর্থও মার্কসকে  দিয়েছেন।

প্যারিস থেকে মার্কস আবার জার্মানিতে আসেন, জার্মানি থেকে বেলজিয়াম যান। মার্কসচালিত পত্রিকা `জার্মান ব্রাসেলস  সংবাদপত্র` সম্পর্কে বেলজিয়াম সরকারের স্পাইরা লিখেছিলেন, `এই বিষাক্ত পত্রিকাটি জনমানুষের মনে সবচাইতে বেশি আগুন জ্বালাতে ভূমিকা পালন করছে।` মার্কস ও এঙ্গেলসের কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো প্রকাশিত হয় ১৮৪৮ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। এটি এত দ্রুততার সাথে প্রায় সমগ্র ইউরোপ ছড়িয়ে পড়ে যে, শ্রমিকরা যেন এর জন্যই অপেক্ষা করছিল এবং ফলশ্রুতিতে জায়গায় জায়গায় শ্রমিকরা সংগঠিত হতে থাকে ও আন্দোলন করতে থাকে। ৩ মার্চ ১৮৪৮ সালে কার্ল মার্কসকে বেলজিয়াম থেকে বহিষ্কার করা হয় এবং বলা হয়, মার্কস আর কখনোই বেলজিয়াম প্রবেশ করতে পারবেন না। বেলজিয়াম থেকে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিতে নিতেই রাতে মার্কস গ্রেপ্তার হন এবং তাকে পাগলের সাথে একই সেলে রাখা হয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে জেনিও সে রাতে গ্রেফতার হন এবং তাকে ভ্রাম্যমাণ পতিতাদের সেলে আটকে রাখা হয়। অভিযোগ, তাদের কাছে বিপ্লব সংঘটনের জন্য টাকা আসে। উল্লেখ্য, এর আগে যে টাকা মার্কসের হস্তগত হয়েছিল তা তার পৈত্রিক ওয়ারিশের টাকা। উপন্যাসের এই জায়গায় লেখককেও বেশ দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। কারণ এখানে ঘটনার এতবেশি সংশ্লেষ যে কোনটাকে মূল ঘটনা করে তুলবেন সেটা নিয়ে ভাবতে হয়েছে, সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। তবে ঔপন্যাসিক মার্কসের এই বিপদ মুহূর্তে এঙ্গেলসকেই প্রধান করে দেখিয়েছেন মার্কসের বন্ধু হিসেবে এবং ইতিহাসের চেয়ে এখানে বাস্তব জীবনের প্রতিই ঔপন্যাসিক বেশি দৃষ্টি দিয়েছেন। তৎকালীন বেলজিয়ামের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও শ্রমিক আন্দোলন আরো একটু বিস্তৃত পরিসরে আসতে পারতো।

স্ত্রী জেনি আজীবন মার্কসের দুর্ভোগকে সমান করে ভাগ করে বয়ে বেড়িয়েছেন। এই মহিয়সী মার্কসের সাথে যাযাবরের মতো ছুটে বেড়িয়েছেন জার্মান, প্যারিস, বেলজিয়াম, ইংল্যান্ড। নিজে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, সন্তানরা অসুস্থ হয়েছে এমনকি মার্কসও ডাস ক্যাপিটাল লেখার শেষপর্যায়ে এত পরিমানে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন যে, বসে থাকা সম্ভব হয়নি বলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লিখেছেন। সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম নেয়া জেনি ভুলে গিয়েছিলেন সুখ স্বাচ্ছন্দ্য। স্যাঁতসেঁতে ঘরে চারটি বাচ্চা নিয়ে শীতের দিনগুলায়ও মেঝেতে থেকেছেন কিন্তু মার্কসের সাথে তার জীবনকে তিনি অভিশাপের ভেতর দিয়ে দেখেননি। তিনি ছিলেন মানুষের মুক্তির জন্য লড়ে যাওয়া এক দার্শনিকের সহযোদ্ধা। গুণী মানুষের সাথে তার জীবন কাটছে এটাকে তিনি আশির্বাদ হিসেবে নিয়েছিলেন। তার নিজের এবং বাচ্চাদের কষ্টকে তিনি পেছনে ফেলে বরং আফসোস করেছেন মার্কস লেখালেখির জন্য উপযুক্ত জায়গা পাচ্ছেন না বলে।

মৃত্যুর সময় মার্কসের কোনো দেশের নাগরিকত্ব ছিল না, ছিলনা কোনো সম্পদও। ঔপন্যাসিক তার সম্পদ হিসেবে ব্যবহৃত আসবাবের মূল্য দেখিয়েছেন দুশো পঞ্চাশ পাউন্ড। কিন্তু মার্কস নিজেই তো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ! সম্পদহীন হয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির ত্রাতা কার্ল মার্কস। আশ্চর্য কিছু কাকতাল আমরা তার মৃত্যুর মধ্যেও দেখি! ব্যক্তিগত সম্পদের অবসান চাওয়া মানুষটি ব্যক্তিগত সম্পদহীন রইলেন। তিনি যখন মারা গেলেন, তখন তিনি কোনো দেশের নাগরিক নন! এই আন্তর্জাতিকতাবাদী শেষপর্যন্ত পৃথিবীর মানুষ হিসেবে সমাধিস্থ হলেন, কোনো দেশের নাগরিক হিসেবে নয়!

ঔপন্যাসিক জাকির তালুকদার `কার্ল মার্কস মানুষটি কেমন ছিলেন` উপন্যাসে পরিমিতিবোধের পরিচয় দিয়েছেন। উপন্যাসটি আরো বৃহৎ পরিসরে হলেও পাঠকের আগ্রহ ধরে রাখা সম্ভব হতো। তিনি যেন উপন্যাসটি দ্রুত শেষ করে দিয়েছেন, এমন মনে হতে পারে। সমাধিপাশে বক্তৃতায় পৃথিবীর মানুষ মার্কসকে মনে রাখবে বলে যে আশাবাদ রেখেছিলেন, সেই আশা কি গভীর ভাবেই না বেঁচে আছে! বেঁচে আছেন মার্কস, পৃথিবীর মেহনতি মানুষের মুক্তির ঝাণ্ডা নিয়ে!

একুশে বইমেলা ২০১৮