মারিও ভারগাস য়োসার নোবেল বক্তৃতা থেকে

অনুবাদ

ভাষান্তর: এমদাদ রহমান

প্রকাশিত : এপ্রিল ১৮, ২০১৮

বলিভিয়ার শহর কোচাবাম্বায় দে লা স্যাল একাডেমির ব্রাদার জাস্তিনিয়ানোর শ্রেণিকক্ষে, মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই আমি পড়তে শিখেছিলাম। এই ব্যাপারটিই আমার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলির মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান। এভাবে পাঠের জগতে একে একে সত্তর বছরের বেশি সময় কাটিয়ে দেবার পর আমার এখনও মনে পড়ে বইয়ে লেখা শব্দগুলিকে ছবিতে রূপান্তরের সেই অদ্ভুত জাদুবিদ্যা নিজের জীবনটিকে ঠিক কতোটা পূর্ণ করে তুলেছিল, কাল ও স্থানের দেয়ালগুলি ভেঙে গিয়েছিল ধীরে ধীরে, পথ দেখিয়ে দিয়েছিল ক্যাপ্টেন নিমোর সঙ্গে সমুদ্রের অতল জলরাশির বিশ হাজার লিগ তলে অভিযাত্রায় চলে যেতে। আরামিস, অ্যাথোস, পার্থোসের লড়াই দ্য আরতাঁনার সঙ্গে, রিশেলিওর গূঢ় অভিপ্রায়ের দিনগুলিতে রাণির সহায়তা, প্যারিসের ভূগর্ভস্থ নর্দমায় নেমে গিয়ে জ্যঁ ভালজাঁয় রূপান্তরিত হয়ে যাওয়া, তারপর ম্যারিউসের অচেতন শরীরটাকে পিঠে করে বয়ে নিয়ে যেতাম বহুদূর।

বইপড়া ব্যাপারটি এমন- এই পড়া স্বপ্নকে বাস্তবের রূপ দেয়, বাস্তব হয়ে যায় স্বপ্ন; পাঠের জাদুস্পর্শে একদিন যে এক ছোট্ট বালক ছিল, তার সামনে জীবন ও স্বপ্নের ঘোর দিয়ে তৈরি সাহিত্যের বিপুলা পৃথিবী তার দরোজা উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। মায়ের মুখ থেকে একদিন এই কথাটি শুনতে পেলাম, আমি প্রথম যা লিখতে শুরু করেছিলাম তা ছিল আমার পঠিত গল্পগুলির এক সম্প্রসারণ, কারণ গল্পগুলি যে জায়গাটিতে গিয়ে পৌঁছাত, শেষ হতো, সেই শেষটা আমাকে বিষণ্ণ করে ফেলত। আমি তাই গল্পের সমাপ্তিটিকে নিজের মতো করে বদলে নিতাম। সম্ভবত ব্যাপারটি ঠিকমতো বুঝতে না পেরেই আমি সারাটা জীবন কাটিয়ে দিয়েছি, আর এখনও বয়সের ভারে ভারাক্রান্ত হয়েও যে-গল্পগুলি আমার ছোটবেলার বিষণ্ণতা ও আনন্দের উৎস ছিল, তাদেরকেই নিজের মতো করে লিখে গেছি।

আজ যদি আমার মা এখানে থাকতেন, আমাদো নেরভো আর নেরুদার কবিতা যখন পড়তেন, আমার মায়ের চোখ থেকে অশ্রু ঝরে পড়ত; আমার পিতামহ- পেদ্র, যার নাকটি ছিল বিশাল, সঙ্গে একটি দীপ্তি বিচ্ছুরিত করা টেকো মাথা- আমার লেখাকে তিনি উদযাপন করতেন; আর একজনের কথা বিশেষভাবে বলব, তিনি আমার লুসো কাকা। এই লুসো কাকাই আমাকে শরীর ও আত্মা নিয়ে লেখায় ডুবে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষাটিকে আরও বেশি করে উসকে দিতেন, যদিও সেই সময়ে লেখালেখি করা নিজেকে উজাড় করার নামান্তর ছিল, সেটা জেনেও। জীবনভর আমি আমার পাশে এরকম মানুষকেই পেয়েছি, যারা এভাবেই আমাকে ভালোবেসেছেন, প্রেরণা জুগিয়েছেন, আর যখনই আমি নানামাত্রিক সংশয়ে ভুগেছি তখনই তাদের বিশ্বাসে আর ভরসায় আমি আস্থা রাখতে পেরেছি।