চিত্রকর্ম: জয়নুল আবেদিন

চিত্রকর্ম: জয়নুল আবেদিন

মাহমুদা খাতুন সিদ্দীকার একগুচ্ছ কবিতা

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ১৪, ২০১৮

দারিদ্র-মাহাত্ম্য

জীর্ণ বসনখানি ঢাকিতে পারে না তার দেহ
বাহিরিতে চাহে না লজ্জায়।
আভিজাত্যের কুণ্ঠাভারে নিপীড়িত জন
অন্ধকারে লুকাইতে চায়।
তবুও বাহির হতে হয় শত কাজে
অত্যাচারী সংসারের মাঝে।

পথের পরে
হৃদিস্পন্দ স্তব্ধ করি ধনীর মোটর চলে যায়,
শব্দমান দূরে বহু দূরে।
বক্ষের পঞ্জর টুটি দীর্ঘশ্বাস বাহিরিয়া আসে
আঁধারের কালো বুক চিরে।
পথের দুধারে খাবারের দোকানগুলি
ক্ষুধাতুর ক্ষুধা দ্বিগুণ করিয়া তোলে খালি।

কাজ শেষ হয়
ক্ষুধা ভরা বুকে বলহীন পায়,
আলোহীন বায়ুহীন ঘরে তারে ফিরে যেতে হয়,
সন্ধ্যা আসে, নীলাকাশে, ভেসে ওঠে চাঁদ,
সে জ্যোৎস্না আনে না মোহ, আনে বিস্বাদ,
মর্মাকাশে গর্জে ওঠে তৃষ্ণার্ত রুক্ষ আত্মার।

                       বিশ্বাসহীন রুদ্র হাহাকার—
মনে হয় শ্যেন সম নখে ছিঁড়ে ছিঁড়ে ধরণীরে
আপনার দাবি দিয়ে নিয়ে আসে আত্মার তৃপ্তিরে,
কর হানি কপালেতে কহে বারবার
হে দারিদ্র্য, তোমায় নমস্কার
তোমার মাহাত্ম্য শুধু বনবাসী সন্ন্যাসীর মাঝে—
নহে লক্ষ লক্ষ নরনারী তরে, নহে সংসারের কাজে।

মাটির স্বাক্ষর

যুগ-যুগান্তর
মৃত্তিকা আপন বক্ষে রচিয়াছে এ মাটির ঘর।
তারি মাঝে রচি সজ্জা জ্বালি’ সাঁঝবাতি
তারি মাঝে আসে যায় পূর্ণচন্দ্র তিথি
আঙিনায় শেফালিকা ঝরে
কাকলিতে ওঠে বন ভরে—
এ মাটি দিয়েছে মোদের এই অধিকার—
এ তার অনন্ত স্বাক্ষর।

সেই মেয়েটি

ভিজে চুলে আলো ঢেলে সে মেয়েটি খোলা জানালায়
আজ আর আসেনি তো খুলে দিতে রুদ্ধ বাতায়নে
চাইল না চোখ তুলে ওই নীল আকাশের পানে
দাঁড়ালো না ক্ষণ তরে এসে সেথা নীরব চরণে।

কে তারে লইয়া গেছে নিয়ে গেছে কোন সুদূরের ডাকে
যেথায় স্তব্ধ আত্মা মরণের হিমশীতল ছোঁয়ায়—
উৎসের মুখে তার কি ব্যথা পাথর দিল চাপি
হিমকালো ওষ্ঠাধর ক্ষণে ক্ষণে ওঠে শুধু কাঁপি।

ভুল তার ভেঙে গেছে জীবনের প্রথম পদক্ষেপে
প্রেম তার মরীচিকা হলো তার ভূজঙ্গ দংশন
তাই সে সরিয়া গেছে আজি জানালায় তল হতে
একাকী আঁধার ঘরে বসে আছে আঁখি করি নত।

জানালা রয়েছে রুদ্ধ অপেক্ষায় সেও বুঝি আছে
বাহিরে ঝড়ের বেগে পৃথিবীর বুক কাঁপিতেছে।

লালমণির হাট

নয়নের আগে মোর খোলা বাতায়ন
সম্মুখে চাহিয়া আছি মেলিয়া নয়ন
দূরে দূরে রয়ে গেছে তৃণভরা মাঠ সবুজ সুষমায়
মিশেছে শেষে এসে বন কিনারায়।
রাঙা সুরকির পথগুলো উজ্জ্বল রৌদ্রের আভায়।
এ যে লালমণির হাট
স্বাপ্নিক প্রহর হেথা নীরবে বহে যায়
আকাশ নীরবে শুধু চোখ মেলে চায়
                         দিগন্ত সীমায়।
ধানক্ষেত সবুজে সবুজে ঢেউ তোলে
সহসা পাখির গান
সচকিত করে তোলে প্রাণ।
জানি না কো ছিল কীনা কোনো মেয়ে
লালমণি ছিল যার নাম
কিবা তার ছিল পরিচয় কোথা ছিল ধাম
ইতিহাস যার কথা লেখার প্রয়োজন মনে করেনি কো
তবু সে বাঁচিয়া আছে মানুষের মুখের কথায়
তবুও তাহার নাম মুখে মুখে শোনা যায়
মনকে সে টানে
পিছনের পানে।

চোরাবালি

পায়ের নিচেতে যদি থাকে চোরাবালি
তারপরে বিশ্বাস ভরে পা ফেলিয়া চলি
সহসা বিশ্বাস ভঙ্গ করে
যেতে পারে সরে।

চোরাবালির পথে হতে পারে শ্যাম দূর্বাদল
হতে পারে বনজ পুষ্পের বিকাশ
হৃদয় ভুলানো সর্বনাশ
সে শুধু নয়ন দুটি টানে
ভাবনা ভুলায় সবখানে
নাহি তবু শক্তির সম্বল
সে যে শুধু ছল।

চোরাবালি তাই হোক যত মনোহর
যত সে ইঙ্গিত দিক বাঁধিবার ঘর
তার পরে হেঁটে যাতায়াতকালে
সহসা ডুবাতে পারে গভীর অতলে
চোরাবালি ছলনা সে, শুধু ছল
মিথ্যা মরীচিকা হানে কেবল।

মাহমুদা খাতুন সিদ্দীকার ‘অরণ্যের সুর’ বই থেকে পুনর্মুদ্রণ করা হলো

বিভাগপূর্ব বাংলা সাহিত্যে মুসলিম কবি সাহিত্যিকদের কাব্যকীর্তির অপ্রতুলতায় পূর্ণতার মানসে হঠাৎ আলোর দ্যুতি নিয়ে আবির্ভূত হন কবি মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা (১৯০৬-১৯৭৭)। তিনি স্বকালে মুসলিম কবিদের অকর্ষিত ঊষর কাব্যভূমে স্বীয় মেধা, মনন ও প্রজ্ঞার অমিয় বারি সিঞ্চনে সজীব ও শ্যামলতায় প্রাণবন্ত করতে সমর্থ হয়েছিলেন। দৃঢ় প্রত্যয় ও একনিষ্ঠতায় বিভাগপূর্ব বাংলা সাহিত্যে মুসলিম কবি সাহিত্যিকদের অস্তিত্বের সংকটকালে শেষপর্যন্ত তিনি নিজস্ব অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পেরেছিলেন। তার সৃষ্ট পথপরিক্রমায় পরবর্তী মুসলিম কবি সাহিত্যিকরা সাহিত্য সাধনার পরম্পরা ও প্রেরণার যোগসূত্রের সন্ধান পেয়েছিল। বিশ শতকের সমাজ প্রেক্ষাপটে মুসলিম নারীর সাহিত্যচর্চা অকল্পনীয় ছিল সন্দেহাতীতভাবে। এক্ষেত্রে অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের ঘেরাটোপ ছিঁড়ে প্রথম নিজেকে অসূর্যস্পর্শা মুক্ত করলেন রোকেয়া শাখাওয়াত হোসেন (১৮৮০-১৯৩২), এরপরেই মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকার (১৯০৬-১৯৭৭) অবস্থান। উচ্চশিক্ষিত না হয়েও আত্মস্বভাবজাত কবি সত্তার মৌলিকত্বে সমকালে প্রতিষ্ঠিত কবি সাহিত্যিকগণের দৃষ্টি আকর্ষক হতে পেরেছিলেন তিনি।