মিছিল খন্দকারের কবিতা জলফড়িঙের মতো, গল্পময়

মাহরীন ফেরদৌস

প্রকাশিত : মার্চ ১৩, ২০১৮

মিছিল খন্দকারকে চিনি কয়েক বছর আগে থেকে। কবি ও গল্পকার মেঘ অদিতি বইমেলার লিটলম্যাগ চত্বরে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন উনার সাথে। আমরা মুখবইতে বন্ধু হয়েছিলাম। ব্যক্তিগত আলাপ হয়নি। আলাপ শুরু হলো গত বছর থেকে। ২০১৬ সালে, একদিন কোথাও পড়েছিলাম উনার লেখা `দুঃখ থেকে সটকে পড়ার কৌশল`। আর আমার ভালো লেগে গেল। মনে হলো, এমনি করে দুঃখ থেকে সটকে পড়ার কৌশল আমি খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম বহু বহু দিন। জানতে পারলাম, উনার কাব্যগ্রন্থ `মেঘ সামান্য হাসো`র কথা।

আমি তখন আমেরিকায়। মূলবই কোথায় পাবো? তাই অনলাইনেই নানা জায়গায় খুঁজে খুঁজে সেই কাব্যগ্রন্থের কিছু লেখা পড়লাম। এরপর গতবছর দেখলাম তিনি লাইভে এসে নিজের লেখা কয়েকটি কবিতা পড়ছেন। পাশ থেকে উনার কিছু কিছু ভুলত্রুটি ধরিয়ে দিচ্ছেন `নিশা`, উনার জীবনসঙ্গী। লাইভ দেখে মনে হলো, ঘরোয়া পরিবেশ। গমগমে কণ্ঠ নেই, আলগা ভাব নেই, জোর করে আনা কোনও কৃত্রিমতা নেই। কেমন যেন আড্ডা আড্ডা ভাব। আমি প্রায় পুরোটা সময় লাইভে যুক্ত থেকে কথাবার্তা শুনে গেলাম। আমার মনে হলো, যেন প্রবাসের সুনসান সকালে দেশি একটা আড্ডা দেয়া হয়ে গিয়েছে। এর সাথে এক পেয়ালা গরম চা থাকলে আর কিছুই লাগতো না।

এ বছর ফেব্রুয়ারির প্রথমদিন থেকেই আমার গল্পগ্রন্থ `গল্পগুলো বাড়ি গেছে` মেলায় ছিল। দুই তারিখে মিছিল ভাই আমাকে হঠাৎ ম্যাসেজ দিয়ে বললেন, বইয়ের বিস্তারিত তথ্য দিতে। উনি সমকালে প্রকাশ করবেন। সেদিনই উনার সাথে আমার কথা হলো। পরে জানতে পারলাম, ৬৪টি কবিতা নিয়ে আসছে উনার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ `পুষ্প আপনার জন্য ফোটে`। এ কাব্যগ্রন্থ নিয়ে কিছু বলার আগে বলে নেয়া ভালো, লেখালেখির জগতে গল্প-উপন্যাস লিখি বলে আমার একটি ক্ষুদ্র পরিচয় আছে। কিন্তু আমি কবিতা লিখতে পারি না। কবিতার স্টাইল, ছন্দ, প্রকৃত শিল্পরূপ অনেক কিছুই আমি বুঝি না। আমি গল্প বুঝি। গল্প খুঁজি। যে কবিতা পড়ে আমি গল্প পাই, যে কবিতা আমাকে কোনও অনুভবের স্বাদ দেয় আমার কাছে সেই কবিতা ভালো লাগে। আমার শব্দ ভাণ্ডার সীমিত। অনেক কিছুই হয়তো বুঝি না।

বলা বাহুল্য, মানুষ জ্ঞানত যা বুঝতে পারে না, তা সে অনেক সময় অনুভব করতে চায়। কবিতার সাথে আমার সম্পর্কটাও অনেকটা সেরকম। অনুভবের। তাই হয়তো অনেক বিখ্যাত কবির কবিতা আমার কাছে দুর্বোদ্ধ লেগেছে এবং `নন-কমিউনিকেটিভ`। আবার অনেক নব্য কবির সৃষ্টি আমাকে ঠিকই মুগ্ধ করেছে। মিছিল খন্দকারের কবিতাগুলো জলফড়িঙের মতো, প্রাণবন্ত, আনকোরা এবং গল্পময়। কিছু কবিতাকে মনে হয়েছে শক্তিশালী কিন্তু ভারি নয়। বরং সহজবোধ্য যা আমার মতো নাদান পাঠকও বুঝতে পারবে। আলাদা করে উল্লেখ করার মতো, ভালো লেগেছে, `বিপন্নতা তাড়া করে`, `পারাপারহীন সাঁকো`, `যেখানে পাহাড় জীবনের চেয়ে বড়`, `ক্রেজি পারাবার`। তবে যখন তার `ভাঙাবাড়ি` কবিতার কিছু অংশ পড়ি, তখন সেটাকে দৈনন্দিনতায় ডুবে থাকা আমাদের যাপিত জীবনের কবিতাই লাগে।

পুরনো বাড়ির জীর্ণ দেয়ালে
ইট দিয়ে লেখা `পাখি`।
কারও পোষা ছিল? ছেঁড়া ঘটনায়
উড়ে গিয়েছিল নাকি?

কিন্তু পঞ্চম লাইন থেকে কবিতাটি স্পষ্ট হয়ে উঠে `গল্পে`। এরপর `জুয়ার আসর` পড়ে মনে হয়, পুরো কবিতাই যেন একটা ঘটনাবহুল সিনেমা। এটাও আমার বেশ বেশ পছন্দ হয়। কিংবা কেউ যদি ভাবে, কিছু প্রশ্ন আছে যার কোনও উত্তর নেই। অথচ প্রশ্নগুলো ক্যামোফ্লেজে আমাদের বিভ্রান্ত করে যাচ্ছে ঠিকই। তখন তাকে পড়তে হবে `বিভ্রান্তি`-

মানুষ মূলত ৯৯টা মুখ নিয়ে ঘোরে
আর কবিরা ৯৯৯টা।
তাই তাদের এক মুখের কথার জন্য
আরেক মুখকে দোষ দেওয়া যায় না।
এবং তারা কখন কোন মুখ দিয়ে কথা বলেন,
সেটা চিহ্নিত করাও দুরূহ ব্যাপার।
কখনো কখনো রুগ্ন মুখটায়ও
মোড়ানো থাকে সুন্দর র‍্যাপিং পেপার।

আবার ভাবুন, অগুনতি মানুষের ভিড়ে আপনি কি `একা`? আপনার কি মনে হয়, ঘুমের মধ্যেই বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে আপনি দেখছেন আকাশে মেঘ উড়ছে। বৃষ্টি এসে হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছে আপনাকে? আর রাস্তার মোড়ে পেনশনের কাগজ হাতে স্বল্প ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে ভিজছে কোনো এক রিটায়ার্ড বুড়ো? আর এসব দেখতে দেখতে যদি বা রাত নেমে আসে, আপনি কি তাহলে এক সময় বুঝতে পারবেন আর কেউ নেমে আসেনি সাথে! মূলত আপনি `একা`! একদমই `একা`।

এভাবে শব্দে, ছন্দে, মাত্রাবৃত্তে, কোলাজে, গদ্য কবিতায়, কোনও এক ঠিকানায় কিংবা গন্তব্যহীনতায় `পুষ্প আপনার জন্য ফোটে` আপনার হৃদয় স্পর্শ করবে। খুব নীরবে, সাদামাটাভাবে। আপনার মনে হবে, কেউ আপনার ওপর নিজের কাব্যিকতা চাপিয়ে দিচ্ছে না। বরং আপনি হেঁটে বেড়াচ্ছেন কোনো এক পথে। আর সেখানে নিজের মতো জগৎ সৃষ্টি করে খুঁজে যাচ্ছেন `কিছু একটা`। তারপর আপনাদের সাথে গল্প করতে করতেই বইটির শেষ পাতা উলটিয়ে আমি বলবো, লেখা শেষ করার আগে, যেতে যেতে বলে যাই,

হুলস্থূল শীত পৃথিবীতে
গুটিয়ে আসা কুয়াশায়
পাতাঝরা গাছের শোকের তলায়
বিস্ময়বোধক চিহ্ন হয়ে পড়ে আছি,
প্রলম্বিত ভোর-
নড়লেই ভেঙে যাচ্ছে ঝরাপাতার কোমর।

`পুষ্প আপনার জন্য ফোটে`
প্রকাশনী: জেব্রাক্রসিং। দাম: ১৪০ টাকা, পৃষ্ঠা: ৬৪, প্রচ্ছদ: আনিসুল হক

একুশে বইমেলা ২০১৮