মিডওয়েস্ট থেকে দেখা ডেভিড ফস্টার ওয়ালেসের ৯/১১

পর্ব ২

অনুবাদ-নাদিম হায়দার

প্রকাশিত : জুলাই ১০, ২০১৮

ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষনসমূহঃ
 
 
প্রায় ৬৫,০০০ বসবাসকারীসমৃদ্ধ ব্লুমিংটন এমন এক শহর, যা রাজ্যের মধ্যভাগে অবস্থিত এবং তুলনামূলকভাবে সমতল অঞ্চল। একারণে অনেক দূর থেকে শহরটির প্রধান আকর্ষণের কাঠামোগুলো চোখে পড়ে। কিছু রেললাইন সহ এখানে প্রধান আকর্ষনের স্থান তিনটি। এটি শিকাগো আর সেইন্ট লুইসের ঠিক মাঝামাঝিতে অবস্থিত। শহরটির উৎপত্তির সাথে একসময় ট্রেনের ডিপো স্থাপনের ঘটনা জড়িত আছে। শহরটির অপেক্ষাকৃত ছোট অন্য আরেক যমজ সহোদরের দেখা মিলবে, যেটি একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে বানানো এবং উৎপত্তির গল্পটিও তুলনামূলক ভিন্নতর। কিন্তু দুটো শহরের মোট জনসংখ্যা সর্বমোট ১১০,০০০ এর কাছাকাছি।
 
 
মিডওয়েস্টের অন্য শহরগুলোর মতই, ব্লুমিংটনের চোখে পড়ার মত একমাত্র বিষয় হলো এর সমৃদ্ধি। অর্থনৈতিক মন্দার ছিটেফোঁটাও এখানে পাওয়া দুষ্কর। যার পেছনে দায়ী এখানকার উর্বর জমি, যেটি এতোটাই ব্যয়বহুল যে হয়তো আপনি ধারনাও করতে পারবেন না এর দাম কত হতে পারে। তাছড়া ব্লুমিংটনে স্টেট ফার্মের সদর দফতর অবস্থিত। স্টেট ফার্ম হল ভোক্তা বীমার কালো-দেবতারূপ এবং স্বাভাবিকভাবেই শহরের নিয়ন্ত্রকের ন্যায় আচরণ করে। যার কারণে ব্লুমিংটনের পূর্বাংশে ধোঁয়াটে কাচঘেরা দালান, ক্রমবর্ধমান ইজারাভিত্তিক উন্নতির প্রতিশ্রুতি আর ছয়-লেনের রাস্তার ধারে শপিংমলগুলোর জন্ম হয়েছে। অপরদিকে মৃত্যু হচ্ছে পুরনো ব্লমিংটনের। সাথে তৈরি হচ্ছে শহরের দুটো সাধারণ শ্রেণি-সংস্কৃতির মাঝে বিস্তর ফাঁরাক। যেটিকে রূপক অর্থে চাইলে ‘এসইউভি গাড়ি আর পিকআপ ট্রাক’- এর মাঝে যেমনটা পার্থক্য, তার সাথে তুলনা করা যায়।
 
 
শীত এখানে অভিশাপের মত হানা দেয়। কিন্তু গরমকালের মাসগুলোতে ব্লুমিংটন যেন সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চলে পরিণত হয়। শুধু পার্থক্য হলো এখানে সাগরের বদলে আপনি শস্যখেতের দেখা পাবেন, যা রীতিমতো ভূমিকে ছিঁড়েফেটে চর্তুদিকে জন্মাতে থাকে। গ্রীষ্মে এখানে সবুজের উৎসব চলে। রাস্তার চারধারে অসংখ্য সবুজ গাছের দেখা মিলবে। এলাকাভিত্তিক পার্ক আর গলফ কোর্সেও এত এত সবুজ রং চোখে পড়বে; মনে হবে চোখ বাঁচাতে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিতে হতে পারে। এছাড়া বেষ্টনী ছাপিয়ে বেড়ে উঠা ঘাসের লনগুলো তো আছেই। এখানকার মানুষের বোধকরি লন-এর প্রতি বিশেষ দূর্বলতা আছে। আমার প্রতিবেশীরা যতটা ঘনঘন শেভ করে, তারচেয়ে অনেক বেশিবার লনের ঘাস কাটার সম্ভাবনা আছে। সত্যি বলতে গেলে, এটা কিছুটা গা ছমছমে লাগে। বিশেষতঃ যখন অধিক তাপমাত্রার সময়গুলোতে সবাই ঘরে থাকে আর এই সমস্ত সবুজ গাছপালা গরমে সেদ্ধ হয়।
 
 
আরও অনেক মিডওয়েস্ট শহরের মত, ব্লুমিংটন চার পেইজ টেলিফোনবুকের পাতা সম্বলিত চার্চ দিয়ে যাচ্ছেতাই অবস্থা। একেশ্বরবাদী থেকে শুরু করে ড্যাবড্যাবে চোখের পূজারী, সবই এখানে পাওয়া যায়। এমনকি আজ্ঞেয়বাদীদের জন্যও একটি চার্চের দেখা মিলবে। আমার মনে হচ্ছে, চার্চের দিকটা বাদ দিলে; সামরিক প্রদর্শনী, আতসবাজি পোড়ানোর উৎসব আর কয়েকটি কর্ণ ফেস্টিভাল বাদে অন্য কোন সামাজিক আনুষ্ঠানিকতা চোখে পড়বে না। সবারই তাদের পরিবার, প্রতিবেশী আর যথেষ্ট বন্ধুবান্ধব নিয়ে বসবাস করে। যেমনটা নিউ ইয়র্কের লোকেরাও করে থাকে। ওরা গলফ খেলে, আড্ডা দেয় আর সিনেমায় যায়, সেই সাথে ভীতিকর, বিস্ময়জাগানিয়া পরিমাণে টেলিভিশন দেখে। আমি শুধু বাচ্চাদের কথা বলতে যাচ্ছি না। এটা যদিও স্বাভাবিক এবং একই সাথে মনে রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন, বাইরের দুনিয়ার ছোঁয়া এখানে পুরোপুরি টেলিভিশনকেন্দ্রিক। উদাহরণস্বরূপ, এখানে নিউ ইয়র্কের চালচলন অন্য সব জায়গার মত এখানেও খুঁজে পাওয়া যাবে। কিন্তু সমস্যা হলো এই “খুঁজে পাওয়া” ব্যাপারটা ঘটবে টেলিভিশন থেকে। ইস্ট কোস্ট থেকে ব্লুমিংটনের টেলিভিশন সেটগুলো তুলনামূলক বেশী সামাজিক। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে দেখা, ইস্ট কোস্টের লোকেরা প্রতিনিয়ত বেরিয়ে পড়ে অন্য লোকদের সাথে আড্ডা দিতে। অপরদিকে ব্লুমিংটনের মানুষজন পার্টি বা বাইরের কারো সাথে মেশার ঝোঁক না দেখিয়ে বরং পরিচিত কিছু মানুষ একত্রিত হয়ে কারো ঘরে এটাসেটা দেখে।
 
 
এখানে কোন টেলিভিশনবিহীন ঘর খুঁজে পাওয়া দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। সেসাথে যাদের টেলিভিশন আছে, তাঁদের ঘরে উঁকিঝুঁকি দিয়ে চিরস্থায়ী আসন গেড়ে বসা অতিথি হবার সযোগ নেয়া সম্ভব। এসকল লোকেরা হয়তো বোঝে না আপনি কেন টেলিভিশন সেট রাখতে চাচ্ছেন না; কিন্তু যখনই আপনার দরকার পড়বে, রাস্তায় হুমড়ি খেড়ে পড়া লোকের দিকে বাড়িয়ে দেয়া হাতের মত সহজাত ভঙ্গীতে আপনাকে তাঁদের নিজেদের টেলিভিশন ব্যবহার করার জন্য আমন্ত্রণ জানাবে। ২০০০ সালের নির্বাচনের সময়কার মত এটিও টেলিভশন দেখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ সময়। আপনাকে পরিচিত কাউকে শুধু বলতে হবে “আমার কোন টেলিভিশন সেট নেই”। আর সাথেসাথে শুনবেন, “সমস্যা নেই, চলে এসো আমার এখানে”
 
 
*কিছু মানুষের কথা বাদ দিলে, এখানকার স্থানীয় উচ্চারনভঙ্গী দক্ষিণাঞ্চলীয় নয় বরং অনেকটা গ্রাম্য। অপরদিকে কর্পোরেটের সাথে সংযুক্ত লোকজনের কোন বিশেষ উচ্চারণের ধরনই নেই। (মিসেস ব্রাসিরোর কথায়, “স্টেট ফার্মের লোকেরা টেলিভিশনে দেখানো মানুষদের মত কথা বলে”)
 
*এখানে “কথোপকথন” শব্দের আঞ্চলিক মানে হল, “দেখা করা”
 
 
 
(চলবে)