মুক্তিযুদ্ধের সময়কার মতো কিছু একটার প্রমাদ গুনছে অনেকে

রিফাত বিন সালাম

প্রকাশিত : আগস্ট ০৫, ২০১৮

উড়তে মানা ইচ্ছেডানারা যখন নিজেদের উচ্ছ্বলতায় অবাধ স্বাধীনতা অর্জন করে এবং থেমে না থেকে নিয়ম ভাঙার গান গেয়ে আরো আরো স্বাধীনতা অর্জন করতে থাকে, তখন সেই গান গাওয়ার শেষে কারোর জন্য ভোরের আকাশ অপেক্ষা করে থাকে, আর কেউবা পতনের দিন গোনে।

বাংলাদেশের অফুরান প্রাণশক্তিতে ভরপুর স্কুলপড়ুয়া কিশোর-কিশোরীদের বর্তমান বিদ্রোহে অসংখ্য অগণিত মানুষ ভবিষ্যতের সেই ভোরের আকাশেরই ঝলক দেখছে হয়তো। শুরুটা হয়েছিল একের পর এক সড়ক দুর্ঘটনায় স্কুলপড়ুয়াসহ অনেকের মৃত্যুমিছিলের বিচার চেয়ে। দাবি আকারে এই স্বতঃস্ফূর্ত বিদ্রোহ থেকে প্রাথমিকভাবে উঠে আসে রাস্তা মেরামতি বা ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের দিকটি। কিন্তু ক্ষোভ যত ধূমায়িত হয় ততই পরিবহন ব্যবস্থার এহেন বেহাল দশাকে ঘিরে নেতা-মন্ত্রী-আমলা-পুলিশের দ্বিচারিতা-দুর্নীতি-নিপীড়ন-অপক্ষমতায়নের বিভীষিকাময় চক্করটি সামনে এসে পড়ে। বস্তুত বয়সে কাঁচা কিশোর-কিশোরীরা রাষ্ট্রব্যবস্থার বেহাল দশাটিকেই তাদের অসীম উদ্ভাবনীশক্তি দিয়ে খুব সহজেই টার্গেট ক`রে ফেলে।

বিদ্রোহের মুক্তিযুদ্ধসম তেজ, অদম্য হার-না-মানা স্পৃহা আর সমবেতভাবে তাক-লাগিয়ে-দেয়া নতুন কিছু করতে চাওয়া তাদের শ্লোগানে, পোস্টারে, বক্তব্যে, কর্মকাণ্ডে বারেবার প্রতিফলিত হতে থাকে। মনে করিয়ে দিয়ে যায় `হোক কলরব`-এর সেই যৌবনের প্রবল উচ্ছ্বাসের দিনগুলি। ‘নয় টাকায় এক জিবি চাই না, নিরাপদ সড়ক চাই’, ‘আম্মুর নির্দেশ, গায়ে গুলি না নিয়ে বাসায় ফিরবি না’, ‘যদি তুমি ভয় পাও তবে তুমি শেষ/যদি তুমি রুখে দাঁড়াও তুমিই বাংলাদেশ’, ‘রাস্তা বন্ধ, রাষ্ট্র মেরামতির কাজ চলছে’, ‘হয়নি বলে আর হবে না, আমরা বলি `বাদ দে`/ লক্ষ্য তরুণ চেঁচিয়ে বলে, পাপ সরাবো হাত দে’, ‘শিক্ষকের বেতের বাড়ি নিষেধ যেই দেশে/ পুলিশের হাতে লাঠি কেন সেই দেশে?’ ইত্যাদি পোস্টার মানুষের মগজে-মননে হৈচৈ ফেল দিয়েছে এরই মধ্যে।

কার্যত রাষ্ট্রব্যবস্থাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে জনপ্রতিনিধিদের সপ্তাহে অন্তত তিনদিন গণ-পরিবহনে যাতায়াতের দাবি করা, নিজেরা হাত লাগিয়ে ভাঙা রাস্তা মেরামত করা, নিজেদের সীমিত জ্ঞান নিয়ে শহর-মহানগরের ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করা, পুলিশ-বিচারক-জনপ্রতিনিধিসহ সকলের মোটরগাড়ি আটকে লাইসেন্স চেক করা, লাইসেন্স না থাকলে বিশেষ করে নেতা-মন্ত্রী-পুলিশ-আমলাদের গাড়ি আটক করা, অ্যাম্বুলেন্সের জন্য আলাদা রাস্তা করে দেয়া, রিক্সাচালক অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে নিজেরাই রিক্সা চালিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া ইত্যাদি সবাইকেই তীব্র আলোড়িত ক`রে ফেলেছে। টিসি দেয়ার হুমকি তারা ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছে। অভিভাবকসহ সমাজের আর পাঁচজন সাধারণ মেহনতি মানুষ কিশোরদের এই `অসম্ভব`কে ছোঁয়ার উত্তাপ নিচ্ছে।

`স্কুল -কলেজের এইরকম শিক্ষাব্যবস্থায় পড়ে কী হবে, ছাত্ররা দেশ চালাবে`- এরকম বার্তা অনেকের চোখে আনন্দের জল এনে দিয়েছে। আর সবচেয়ে বিখ্যাত হয়ে গেছে তাদের সেই দিগন্তভেদী শ্লোগান, `আমার ভাইয়ের রক্ত লাল/পুলিশ কোন চ্যাটের বাল?` এরকম একটা স্বতঃস্ফূর্ততাকে কোনো কায়েমি শক্তিই চাইলেও ছুঁতে পারছে না। তা সে আওয়ামী লীগই হোক কিংবা বিএনপি। এমনকি কোনোরকম মৌলবাদী শক্তিও ধারে-কাছে ঘেঁষতে পারছে না। অতএব রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নামিয়ে আনো...

আন্দোলন কোথায় গিয়ে শেষপর্যন্ত পৌঁছোবে, তা নিয়ে আশঙ্কা নানাজনেরই থাকতে পারে। সে তো ভবিষ্যৎ, যা আমরা কেউই জানি না। কিন্তু তা’বলে এ আন্দোলনের প্রতিস্পর্ধাকে শুরু থেকেই সন্দেহের চোখে দেখলে তার সম্ভাবনাটিকেই নষ্ট করে ফেলার পথ প্রশস্ত হবে। যেভাবে তিন-চারদিন আগে আন্দোলনরত এক পড়ুয়ার ওপর দিয়ে ট্রাক চালিয়ে দেয়া হয়েছে, যেভাবে চব্বিশ ঘণ্টায় পুলিশ, গুণ্ডা, র‌্যাব, আওয়ামী লীগ ক্যাডার ও ছাত্রলীগকে দিয়ে খুন-রেপ-চোখ উপড়ে নেয়া-অঙ্গহানি ঘটানো ইত্যাদি ভয়ঙ্কর সন্ত্রাস নামিয়ে আনা হয়েছে; এই কিশোর-কিশোরীদের ওপর তা এককথায় অবর্ণনীয়। শাসকশ্রেণির এই নখ-দাঁত বের করে হামলে পড়া এবং তাতে বেশিররভাগ বড় মিডিয়ার ব্ল্যাক আউট করা ইতিহাসের বীভৎস দিনগুলির কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ভয়াবহতার মতো কিছু একটার প্রমাদ গুনছে অনেকেই।

আমরা, কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা বাংলাদেশের শাসকশ্রেণিকে সোজাসাপ্টা জানিয়ে দিতে চাই যে, এই কিশোর ভাইবোনেরা আমাদের গর্ব তথা বাঙালির গর্ব তথা সমগ্র সমাজের মেহনতি আমমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা। এই ভাইবোনেদের মারাত্মক যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে দাবানল সীমানার এপারেও ছড়িয়ে পড়বে। মনে রাখবেন, বাংলার মানুষের রক্তে লেখা আছে বঙ্গভঙ্গ রুখে দেয়ার ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ জেতার ইতিহাস, স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে সমগ্র সমাজব্যবস্থা বদল করার আহ্বানের ইতিহাস।

কিশোর বাহিনীর এই মরণপণ লড়ে যাওয়া আসলে আমাদেরই লড়াই। কোনো কাঁটাতারের বেড়া এই দাবানলকে আটকাতে পারবে না। `চলুক গুলি টিয়ার গ্যাস/পাশে আছি বাংলাদেশ`- এই ব্যানারসহ মিছিল করে এই বার্তা আমরা পৌঁছে দেব কলকাতার `বাংলাদেশ হাই-কমিশনারেট`-এ। জমায়েত স্থল: পার্ক সার্কাস সাতমাথার মোড়। দিন: সোমবার (৬ অগাস্ট, ২০১৮)। সময়: বেলা দুটো।

লেখক: কবি, কলামিস্ট, কার্টুনিস্ট ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী