মুনাফা লোভি পুঁজিপতি

বৈতরণী হক

প্রকাশিত : মার্চ ১৪, ২০১৮

এইচএসসিতে পড়ার সময় সোসিওলজি বইতে অনেক সোজিওলজিস্টদের থিওরি পড়েছিলাম। মাঝে চলে গিয়েছে অনেকগুলো বছর আর বিষয়গুলো ঝালাই করে নেয়া হয়নি। তবে কিছু কিছু মনে তো আছেই। সেই আবছা জানা থেকে মনে পড়ে, ম্যাক্স ওয়েবার বলে একজনের কথা। তার মতে, সমাজে এমন কিছু পেশা থাকে যেগুলোর জন্য বেশি পারিশ্রমিক গুণতে হয় সবসময়েই। আমার চোখে এমন দুটি পেশা হলো বৈমানিক আর নৌপ্রকৌশলী পেশা। সহজে যাদের আমরা পাইলট এবং মেরিন ইঞ্জিনিয়ার বলে থাকি। খুব চ্যালেন্জিং পেশা। বিশাল আকাশ আর মহাগভীর মহাসমুদ্র নিয়ে তাদের কার্যক্রম। স্বাভাবিকভাবেই এসব পেশার মানুষদের আয়টাও তেমন হয়। যত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ তত বেশি আয়, এটাই তো হবে।

আমরা জানি, জাতিসংঘের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হলো International Labour Organization (ILO)। বিশ্বায়নের এই তুমুল ঝড়ে শ্রমিক অধিকার রক্ষা, মালিক-শ্রমিকদের মাঝে সামঞ্জস্যপূর্ণ বোঝাপড়া, জাতি-ধর্ম-গোত্র-বর্ণ ভেদে শ্রমিকদের মাঝে সমতা আনা প্রভৃতি নিয়ে কাজ করে আইএলও। সংস্থাটি সফল নাকি অসফল সে এক বিশাল তর্ক-বিতর্কের আলোচনা আর আমার আজকের লেখার বিষয় এটা নয়। আইএলও শ্রমিক অধিকার রক্ষা সনদের একটি হলো Maritime Labour Convention (MLC)। ২০০৬ সাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ পায় এমএলসি একটি পূর্ণাঙ্গ সনদ হিসেবে। আইএলও এর তত্ত্বাবধানে International Maritime Organization (IMO) সনদটি পাশ করার ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। সনদে নাবিকদের (অফিসার, ইঞ্জিনিয়ার, ক্যাডেট, ক্রু) জাহাজদের ভিতরে কাজের সুপরিবেশ, সমতাপূর্ণ ডিউটি টাইম, পারিশ্রমিক, ছুটিতে সুযোগ-সুবিধাসহ আরো অনেক বিষয়ে তাদের অধিকার রক্ষার কথা বলে হয়েছে। সবথেকে গুরুত্বের সাথে যে বিষয়টা এসেছে তা হচ্ছে, জাহাজ যান্ত্রিক ত্রুটিমুক্ত থাকা। জাহাজে এমন কোনও যান্ত্রিক ত্রুটি থাকা যাবে না যার দরুণ নাবিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। জাহাজ পোর্টে রেখে মেরামতের কাজ করা বা ত্রুটিপূর্ণ জাহাজ বসিয়ে দেয়া মানে মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যাওয়া। যারা এটা করে তারা ভিন্ন উন্নয়নশীল বা গরিব দেশ থেকে নাবিকদের নিয়োগ দেয় মোটা পারিশ্রমিকে। কখনো নাবিকরা জেনে যায় বা না জেনে যায় মোটা অংকের টাকা পাবার আশায়। কর্মক্ষেত্রে পরিবেশ অনুন্নত রেখে বেশি পারিশ্রমিকে শ্রমিক নিয়োগ দেয়াটাকে অর্থনীতির ভাষায় বলে Compensating wage differentials। বাংলাদেশ, ভারত ও ফিলিপাইনসহ বিশ্বের অনেক দেশ থেকে নাবিকরা বেশি আয় করতে যায় প্রতিকূল পরিবেশে। তাদের অনেকে এমএলসি সনদ সম্পর্কে হয়তো জানেই না। জাহাজ যদি হঠাৎ কোনও দেশের পোর্টে সুপারভাইজ হয় তখন সেই জাহাজের ত্রুটির দায়ভার কোম্পানির সাথে সাথে নাবিকদের ওপর বর্তায়। আর সমুদ্রের মাঝখানে মালবাহী, কেমিক্যাল, তেলবাহী জাহাজ বিস্ফোরণ হয়ে নাবিকদের মৃত্যুর ঘটনাও তো অহরহ ঘটছে।

এবার আসি মূল প্রসঙ্গে। আমি জানি না জাহাজের নাবিকদের নিয়ে যেমন আইএলওর অধিকার সনদ আছে তেমনি উড়োজাহাজের ক্রুদের নিয়ে আছে কীনা। তাই সাধারণভাবেই ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করি। খবরে দেখলাম, সোমবারে কাঠমুন্ডুতে বাংলাদেশের প্রাইভেট বিমান সংস্থা ইউএস বাংলার একটি বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে। মারা গিয়েছে ক্যাপ্টেন আবিদ আর কো পাইলট পৃথুলা। ফেসবুকের বিভিন্ন পেইজ থেকে জানলাম ক্যাপ্টেন আবিদ দক্ষ পাইলট ছিলেন আর ৯০ এর দশক থেকে এ পেশায় আছেন। অপরদিকে মেয়েটি এ পেশায় নতুন। ‘ত্রিভুবন’ বিশ্বের একটি অন্যতম বিপজ্জনক বিমানবন্দর যেখানে অবতরণ করা বেশ কঠিন। সংবাদে দেখলাম, পৃথুলার মা কাঁদছে আর বলছে, কেউ নাকি এই বিমানে যেতে চায় না। কারণ এটি ত্রুটিপূর্ণ বিমান ছিল। টানা ছয় শিফটে কাজ করে এমন একটি ত্রুটিপূর্ণ বিমানে করে এমন গন্তব্যে পাঠানো আসলেই দুঃখজনক। মেয়েটির স্বজনরা বলছিল, বেশিরভাগ বিমান নাকি যান্ত্রিক ত্রুটিপূর্ণ।

বাংলাদেশে এখন মুড়ির টিনের মতো বেসরকারি বিমানগুলো চলে। ব্যাপারটা ইতিবাচক মনে হলেও ততটা সুখকর নয়। বিমানের টিকিটে যেভাবে ছাড় দেয় তাতে মনে হয় এটি একটি গায়েবি কন্ডাক্টর সার্ভিস কিংবা লোকাল বাস। মমতাজের গাওয়া সেই গানের মতো, আদর করে তুলে আর ঘাড় ধরে নামায়। পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজার এটি। অনেক অ্যাভিয়েশন স্কুল গড়ে উঠেছে, বের হচ্ছে অনেক পাইলট। তারা কাজ করছে কোথায়? এইসব ত্রুটুপূর্ণ বিমানে। তারা হয়তো জানছে, কাজ করা ঝুঁকিপূর্ণ। তাও জীবনের প্রয়োজনে সেই compensating wage differential থিওরিতে পড়ে যাচ্ছে তারা। এসব বিমান সংস্থা, জাহাজ মালিক কোম্পানিরা কারবার করে মিলিয়ন বিলিয়নের হিসেবে। মুনাভা লোভি মানুষগুলো টাকার লোভ দেখিয়ে কত বড় বিপদে ফেলছে সবাইকে, তার উদাহরণ তো আমরা দেখলাম। ক্রু ছিল চারজন, বাকিরা সবাই দেশি-বিদেশি প্যাসেঞ্জার। তাদের জীবনের সাথে জড়িত মানুষগুলোর কি হবে? যে কয়জন টাকা দিয়ে নেপাল থেকে এদেশে ডাক্তারি পড়তে এসেছিলো তাদের পরিবারের কি হবে? এমন তো হতে পারে, সহায় সম্বল বিক্রি করে পড়তে পাঠিয়েছে পরিবারের হাল ধরবে বলে। তাদের সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছে।

বিমান কেন বিধ্বস্ত হয়েছে সেটা তদন্তের ব্যাপার, সময়সাপেক্ষ তদন্ত বলে দেবে আসল কারণ। পাইলটদের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন নয়। প্রশ্ন হলো, আদৌ যান্ত্রিক ত্রুটিহীন ছিল কীনা সেই বিমানটি? সচেতন হতে হবে এমন সব পেশার মানুষদের। কারণ দিনের শেষে তারাও শ্রমিক আর খেটে খাওয়া মানুষ। এক শ্রেণির মানুষ তাদের জীবনকে বাজি ধরে মুনাফা করতে থাকে, সেটা তো মুখ বুজে সহ্য করা উচিত না। সনদ আছে আর তার কার্যকারিতা নির্ভর করে সব শ্রমজীবী মানুষের সচেতনতার ওপর। তবে এসবের মধ্যে কম হলেও ভালো কিছু উদাহরণ থাকে, সবার জন্য সেই উদাহরণগুলো হয়ে উঠুক অনুকরণীয়।