‘মেয়েমানুষরে যে গড়াইছে, সে বড় কারিগর’

মাজেদা মুজিব

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১৯, ২০১৮

মেয়েমানুষরে যে এমন সৌন্দর্য দিয়া গড়াইছে সে বড়ই কারিগর গো মনোহর!

কারিগরের প্রশংসা করে মানুষ। সময় ও পরিস্থিতিতে সৌন্দর্যের ধারণা পালটে তবু কারিগর প্রশংসা পান। মেয়েমানুষের শরীর, সৌন্দর্যময় গড়ন উপন্যাসটির উপজীব্য হতে পারতো, কিন্তু কারিগর মেয়েমানুষরে বাইরে নিয়ে এসেছেন। জীবন যেমন তেমন করে নির্মাণ করেছেন। গভীর গভীরতর জীবনের কাছে এনেছেন। হেলায় ছেড়ে দেয়ার কিছু নাই ,কুড়িয়ে নেয়া শিখিয়েছেন জীবনের সব রসদ। ফেলে দেয়া যায় না কিছুই, সবই মূল্যবান।
মাহমুদুল হক ‘মাটির জাহাজ’ উপন্যাসটি সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে লিখেছেন। অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও ক্রমবর্ধমান দারিদ্র উপন্যাসের সর্বত্র পরিলক্ষিত হয়। কাজের সন্ধানে শহরে ভিড় জমাচ্ছে মানুষ। একবেলা খাবারের বিনিময়ে দিনমান কাজ করছে। গজিয়ে উঠছে দালাল ও ফড়িয়া। অন্যসব পণ্যের মতো গ্রামাঞ্চলের এক মেয়েও ভাতের অভাবে বিক্রি হচ্ছে। বিক্রি হওয়া মেয়েমানুষের জীবনালেখ্য `মাটির জাহাজ` উপন্যাসটি।

মনোহর জয়নালকে মেয়েমানুষের সন্ধান দেয়। নৌকায় করে নিয়ে যায় সেই জায়গাগুলোতে, যেখানে মেয়ের বাবা, ভাই, প্রতারক প্রেমিক বিক্রি করে দিয়ে গেছে মেয়েমানুষগুলোকে। জীবন সেখানে থেমে থাকেনি। যে জয়নাল মনোহরের কাছে মেয়েমানুষের গড়ন নিয়ে উচ্ছ্বাস করে, নিখুঁত বিশ্লেষণ করে শরীরের ভাজে সৌন্দর্য খোঁজে, সেই জয়নাল তাদের বিক্রি করার ব্যবসা করে।
আলমাছি নামের মেয়েটি তার কেউ নয়, তবু ঘরের মানুষ। রেঁধে দেয় সে। যত্ন করে খাওয়ায়। জয়নালের কাছে আবদার করে এটা সেটা। সংসারে নারী তার পুরুষের কাছে যেমন, তেমনই তাদের আচরিত জীবন। মনোহরের সাথে এ ঘাট ও ঘাটে সে খুঁজে বেড়ায় ছিন্নমূল মেয়েমানুষকে। ডিভোর্সি কুসুম নজরে আসে মনোহরের। নৌকার পাটাতনে কয়েক রাত-দিন অপেক্ষা করার পরেও কুসুমকে না পেয়ে অন্য মেয়েকে খুঁজতে যায় তারা। অন্ধকার রাতে মরা মানুষের গন্ধ উপেক্ষা করে হেনা নামের মেয়েটিকে লুকিয়ে নিয়ে আসতে গিয়ে ধরা পরে যায় একদল ছেলের হাতে। রক্তাক্ত অবস্থায় সকালে সে নিজেকে আবিষ্কার করে নৌকার পাটাতনে। মনে পড়ে তার আগেরবার বাসা উচ্ছেদের সময় আলমাছি তাকে আগলে রেখেছিল। তাকে বাঁচিয়েছিল। বিভূঁইয়ে তার আলমাছির মুখ মনে পড়ে। নারীর মাতৃরূপের কাছে জয়নাল নত হয়। নারীর বহুরূপী রূপ আবিষ্কৃত হয় তার কাছে।
জয়নাল ছেড়ে দিতে চায় তার এ পেশা। ছেড়ে দিয়ে তার আর করার কিছু নাই। আর কিছু করে জীবিকা নির্বাহ করতে সে শেখেনি।

কুসুমকে নিয়ে ফিরছে। মনোহর বলে যাচ্ছে কোনও দিন যেন ভাতের খোটা না দেয় সে কুসুমকে। আবছা আলোয় জয়নাল বুঝতে পারে, ঘোমটা দেয়া কুসুমের মনোহর চোখ ভিজে যাচ্ছে অভাবের নোনতাজলে।

ঔপন্যাসিক মাহমুদুল হক প্রায় চল্লিশ বছর আগের এক সময় ও সমাজকে তুলে ধরেছেন `মাটির জাহাজ` উপন্যাসে। অর্থনৈতিক চালচিত্র যতটা বদলে গেছে তা সমতা আনেনি বরং পার্থক্যকে করে তোলেছে আরও প্রবল। নারী তার বৈরি পরিবেশে যাপন করে চলেছে এক বন্দিজীবন। মাহমুদুল হক অসাধারণ ভাষাদক্ষতায় উপন্যাসের পরতে পরতে যে নারীজীবন দেখিয়েছেন, সে জীবন যেন মানুষের জীবন পায়।

একুশে বইমেলা ২০১৮