মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও কিছু কথা

স্মরণ

শরিফ সাইদুর

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ১১, ২০১৮

কথিত আছে, একবার জিন্নাহ ট্রেনে করে বোম্বাই থেকে দিল্লি যাচ্ছিলেন। চড়েছিলেন প্রথম শ্রেণির বগিতে। কিন্তু সেই বগিতে জিন্নাহ ছাড়া আর কেউ ছিল না। স্বভাবসিদ্ধভাবে জিন্নাহ পত্রিকা পড়ায় নিমগ্ন ছিলেন। এ সময় এক সুন্দরী মহিলা উঠে পরে জিন্নাহের কামরায়। ট্রেন চলছে চলছে... জিন্নাহ পত্রিকায় মগ্ন।
আচনক সে সুন্দরী বলল, তোমার কাছে যা টাকা পয়সা আছে তা দিয়ে দাও। আর না হলে ট্রেনের শিকল টেনে ট্রেন থামিয়ে তোমার নামে শ্লীলতাহানির অভিযোগ আনবো।
কয়েকবার এই কথা বললেও জিন্নাহ সুন্দরীর কথায় কর্ণপাত না করে পত্রিকাই পড়তে থাকেন। সুন্দরী মহিলা বিরক্ত হয়ে জিন্নাহের সামনে এসে চেঁচিয়ে বলে।
জিন্নাহ কানে হাত দিয়ে দেখিয়ে বুঝিয়ে দেন তিনি কিছু শুনতে পান না। তিনি বধির। কিছু বলার থাকলে লিখে দেয়ার জন্য।
বুকপকেট থেকে কলম বের করে পত্রিকার একটু সাদা অংশে লিখে দিতে বলেন।
মহিলাও জিন্নাহের কথা মতো বধির ভেবে লিখে দেয়। লিখে দিলে জিন্নাহ তা পকেটে ঢুকান। তারপর শিকল টেনে ট্রেন থামান। সিকিউরিটি আসলে জিন্নাহ লেখা তাদের হাতে দেয় এবং মহিলাটিকে ধরিয়ে দেন।

গুজরাটের পেনেলি নামক এক গ্রামের প্রেমজি শুরু করেন মাছের ব্যবসা। প্রেমজি যে হিন্দু বংশের ছিলেন সে বংশের হিন্দুরা নিরামিশাষী ছিলো। যথারীতি প্রেমজি নিরামিশাষী সমাজের বিরাগভাজন হয়। একসময় প্রেমজি মাছ ব্যাবসা ত্যাগ করলেও সমাজ করেনি তাকে আর গ্রহণ। অতপর সমাজ থেকে ব্রাত্য হয়ে চারপুত্র নিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। সেই চারপুত্রের একজন জিন্নাহের পিতা পুঞ্জলাল।

গুজরাট অধিবাসীদের অনেকেরই নিজের নামের সাথে যুক্ত থাকে বংশীয় পদবী বা পিতার নামের অংশ। যেমন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী নামের সাথে যুক্ত হয়েছে করমচাঁদ। অর্থাৎ করমচাদের পুত্র। গান্ধীও ছিলেন গুজরাটি। তেমনি পুঞ্জলাল ঝিনাভাইয় পুত্রের নাম রাখেন মোহাম্মদালী ঝিনাভাই। পরবর্তীতে ইংল্যান্ডী উচ্চারণে ঝিনাভাই হয় `জিনাভাই` তা থেকে জিনা ও পরে হসন্ত যোগ হয়ে `জিন্নাহ`

নেপোলিয়নের ডিকশনারিতে যেমন `ইম্পসিবল` নামক কোন শব্দ ছিল না, জিন্নাহের জীবনে `সরি` বলে কোন শব্দ ছিল না। তার ড্রাইভারের সূত্রে সাদাত মান্টো তা লিখেছেন। খুব শক্ত মনের ও কাঠখোট্টা টাইপের জিন্নাহ এর বিস্তারিত পরিচয় অনেকেই লিখেছেন। স্বাধীনতার পূর্বে বাংলাদেশী সাহিত্যিকগণ তার স্তুতিতে যা লিখেছেন তা জমা করলে `গীতবিতান` থেকেও বড় পুস্তক হবে।

হয়ত জিন্নাহ প্রশংসার যোগ্য ছিলেন বলেই লিখেছেন। কিছু লিখলেই যে জিন্নাহের বোন ভাইয়ের প্রশংসাকারীদের বড় নজরানা দেবেন এমনও না। হাজার বছর পুরনো একটি মানচিত্র প্রয়োজনে বদলে দেয়া জিন্নাহ যেমন দক্ষ রাজনীতিবিদ ছিলেন তেমনি ছিলেন নামকরা ব্যারিস্টার। পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম ব্যতিক্রম ব্যক্তি হিসেবে জিন্নাহ মেট্রিক লেভেলের সার্টিফিকেট নিয়ে ব্যারিস্টারি করতে যান।

ব্যারিস্টার হিসেবে জিন্নাহ এমন ছিলেন যে ব্যারিস্টারি জীবনে কখনো কোন মামলা হারেন নি। শুধু শাতেমে রসুল রাজপালকে হত্যার দায়ে ইলমুদ্দিনকে যখন ফাঁসি দেয়া হয় তখন তিনি আপিলের রায় নিজের পক্ষে আনতে পারেননি। ইলমুদ্দিন নিজেই শাহাদাতের সুধা পান করতে চেয়েছেন, জিন্নাহর আর কিছু করার ছিল না বা ইলমুদ্দিনকের পক্ষে কোনো কূট যুক্তি দেয়ার।

একবার এক ইংরেজ জজ উনাকে এজলাসে সতর্ক করেন এই বলে, Mr Jinnah, remember that you are not addressing a third class magistrate. জিন্নাহর জবাব চাবুকের মতো আছড়ে পড়ল, My Lord, allow me to warn you that you are not addressing a third class pleader.

কেউ একজন তার মামলায় জিন্নাহকে উকিল নিয়োগ করে পাঁচ হাজার টাকা দিতে চাইলে জিন্নাহ বলেন, আমি এভাবে টাকা নেই না। যতদিন আদালতে উঠবো প্রতিদিন পাঁচশ টাকা ফিস। পরে সে মামলা জিন্নাহ তিন দিনেই জিতে যান। সে লোক পাঁচ হাজার টাকা দিতে চাইলেও জিন্নাহ পূর্ব ওয়াদামতো পনেরো শ` টাকাই নেন।

জওহারলাল নেহরুর ভক্তরা জিন্নাহকে হাফ এডুকেটেড ব্যারিস্টার তকমা দিলেও জিন্নাহ নেহরুর চেয়ে বেশ উচু স্তরের আইন ব্যবসায়ী ও নেতা ছিলেন। মতিলালের ছেলে হওয়ায় জওহারলাল যে সুবিধা ও অবস্থান পেয়েছিলেন জিন্নাহ তার কিছুই পাননি। তিনি নিজেই নিজের তুলনা। নিজেই নিজের অবস্থান তৈরি করেছেন। জিন্নাহ সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পেলেই বুঝা যায় আমাদের অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের মতো ব্যক্তিরা কেন শেষ বয়স পর্যন্ত এই নেতার প্রতি মুগ্ধ ছিলেন। কেন বঙ্গবন্ধুর মতো সে সময়ের ছাত্রনেতারা জিন্নাহের সৈনিক হিসেবে কাজ করেছেন।

জিন্নাহ কন্য দিনা ওয়াদিও বলেছেন, তার বাবার সাথে নেহরুর তুলনা চলে না। জিন্নাহ ভুল করেছেন কি ঠিক করেছেন তার বিচার লেখকরা করেছেন, করছেন বা করবেন। কিন্তু রাষ্ট্র নায়ক হিসেবে জিন্নাহ সুযোগ পাননি। যে পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখেছিলেন সে পাকিস্তানের মানচিত্রও পাননি আর পাননি হায়াত। লিখতে গেলে বহু কথাই এসে যায়। বাকি কথাগুলো তার জন্মদিনেই বলব। আজ জিন্নাহের ইন্তেকাল বার্ষিকী। ৭১ বছর বয়সে পাকিস্তান সৃষ্টির একবছর পরেই তিনি ইন্তেকাল করেন।