মোহিনী

পাপিয়া জেরীন

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৯

চিত্রা পূর্ণামি— না কী যেন এই সময়টা! পাতায় রোদ আটকে আছে, সরছে না। ধুলা উড়ছে। দুপাশে মানুষসমান ঘাস। ঘাস নড়ে উঠছে, সবুজের ভেতর শরীরের বাঁক। পেটিকোট বুক পর্যন্ত বেঁধে পুকুরে নেমে গেছে কয়েকজন। দুয়েকজন ঘাটলায় শরীর মাজছে। রোমশ পায়ে রুপার নূপুর খলবল করছে ওদের। বিশ্বনাথন গুনগুন করতে করতে ঘুরে দাঁড়ায়—  

শান্তা কারম ভূজগ শয়নম
পদ্মনাভম সুরেশম্..

ওদিকটায় গাড়িবহর দেখা যাচ্ছে। আইয়াপ্পা আসার কথা, কিন্তু আজকে তো না! আজকে তো নবম দিন। টেম্পলের পেছনে কয়েকটা ছেলে চূড়ান্ত মাতাল, ওদের হাবভাবও ভালো না। প্রচুর পুলিশ মোতায়েন হয়েছে, কিন্তু তারপরও...। একটু দূরেই সারি সারি চুড়ির দোকান, হলুদ থালি ঝুলে আছ। দোকানিরা শুকনো মুখে বেচাবিক্রি করছে। কেউ কেউ মুঠি চেপে ধরে চুড়ি পরাচ্ছে হাতগুলিতে। ঘোর কৃষ্ণবর্ণ চুলে মোগরা, মোগরায় ভ্রমর। বিশ্বনাথন বুকে দীর্ঘশ্বাস চেপে রাখে। ওর মেয়ে ইন্দু সেইদিন ম্যানার্স শিখিয়ে দিলো— বাবা, সাবধান! ওদের কখনও জিজ্ঞেস করবে না, এইটা সত্যিকারের চুল কীনা।

বিশ্বনাথন উইগ চেনে, এখানে অনেকেই উইগ পরা, ইয়াং যারা তাদের কারো কারো চুল রিবন্ডিং করা। অনেকেই ইমপ্লান্ট করা বুক এক্সপোজ করছে। কুভাগামের বাসিন্দাদের চোখে বিস্ময়। আধমরা বুড়োদেরও ঠেলে সরানো যাচ্ছে না। তারা হয়তো ভেবে নিয়েছে, সরল নারীরূপে আর কীইবা আছে। কেউ কেউ জঙ্গলের দিকে যাচ্ছে, পেছনে উৎসাহী খদ্দের। সারা বছর ঝিমিয়ে থাকা এই এলাকা এখন গরম।

মোহিনীর চারপাশে ভক্তরা, সেলফি তুলতে গিয়ে বারবার ঘাড়ের উপর চড়ে বসছে। মোহিনী এরপরও বিরক্ত না। টিভিতে ইন্টারভিউ গেছে তার। হিজরা জামাতের মা-বোন পাশেই আছে। যে পেটে ধরেছিল সে নিশ্চয়ই এতক্ষণে তার মিস কুভাগাম হবার খবর পেয়ে গেছে। প্রচুর ঘাম হচ্ছে, কাঞ্জীভরমের জরিদার ব্লাউজ চেপে ধরছে শরীরে। এখনও থালিই কেনা হয়নি। রীতি মেনে পুরোহিতরা, এলাকার বিশিষ্ট লোকজন এসে তাদের থালি দেখে যাবে, এইটাই নিয়ম। মোহিনী উঠে দাঁড়ায়, পেছন ফিরতেই বিশ্বনাথনের সাথে টক্কর খায়—
বিশ্বনাথন স্যার, আপনি!
হ্যাঁ মিস্ কুভাগাম, আমি...
আপনি কি আগেও এসেছেন? নাকি এবারই প্রথম।
না, এবারই।
স্যার, চলুন না ওদিকে। আমার থালি কেনা হয়নি এখনো।

চুড়িওয়ালা একগাছা সবুজ চুড়ি হাত টিপে টিপে ঢুকাচ্ছে। বিশ্বনাথান আহ্ আহ্ শব্দ বের করছে মুখ দিয়ে। মোহিনীর খুব হাসি পায় তার অবস্থা দেখে। বিউটি প্যাজেন্টে প্রথম দেখা এই বিশ্বনাথানের সাথে। সে কোনোভাবেই মানতে পারছিল না যে, মোহিনী ট্রান্সজেন্ডার। জাজ্ হিশেবে সে প্রশ্নও করতে পারছিল না, তোতলাচ্ছিল। আহা বেচারা!

স্যার, শুনেছি আপনার হোটেলদুটোয় ট্রান্সজেন্ডার এ্যালাউ করেন না। একটার নাম কনিস্ক হোটেল আর আরেকটার নাম কী যেন...
আন্নামালাই, আন্নামালাই।
বিশ্বনাথান ঢোঁক গেলে, কিছু বলতে গিয়েও আটকে যায়। ছোট বয়স থেকেই হিজরাদের খুব ভয় পেতো সে। ওর ছোটবোনকে মায়ের কাছ থেকে নিয়ে প্রায় দুইঘণ্টা পর ফেরত দিয়েছিল হিজরারা। এরপর যৌবনে এসে আরো কত অভিজ্ঞতা! খেয়াল করে দেখেছে বিশ্বনাথন, আর কাউকে না, ওকে দেখলেই হিজরাগুলি কেমন যেন ভায়োলেন্ট হয়ে যায়। বহুবার ওর মানিব্যাগ নিয়ে গেছে, আর দুতিনবার ওর পুরুষাঙ্গ ধরে যা-তা। অবশ্য, ভয়টা কেটেছে এখন।

বিশ্বনাথন জী, দিজ ইজ নট ফেয়ার। আমি কিন্তু ফেরার পথে ভিল্লুপুরামে আপনার হোটেলেই উঠবো।

বিশ্বনাথন কাঠের পুতুলের মতো মাথা নাড়ে। শরীর অবশ হয়ে আসে তার। মোহিনীকে একবার দেখে নেয় পুরোটা। কী ফেমিনিন!
দিন তো থালিটা পরিয়ে, আমি পারছি না।
মোহিনী, আপনি অন্য কাউকে দিয়ে পরান। এইটা তো একপ্রকার মঙ্গলসূত্রই।
মোহিনী মুখ কালো করে। এইখানে কে পরিয়ে দেবে? আশপাশে তো...

বিশ্বনাথন কী ভেবে, অথবা কিছু না ভেবেই হঠাৎ থালিটা পরিয়ে দেয়। কী হয় পরালে? একদিনের জন্যই তো। আর তাছাড়া বউ তো আর তার না, ইরাভানের।

আঠারোতম দিন। আজই মা কালীর পায়ে ইরাভান উৎসর্গ হবে। কুম্মী চলছে। দলকরে গান-নাচ করছে সবাই। মোহিনীর লম্বা বিনুনিতে সাপের মতো মোগরা দুলছে। নাচের তালে তার পেট থলথল করছে। শরীরের বাঁক বলে দিচ্ছে সে সত্যিকারের মোহিনী।

বিশ্বনাথন এ কয়দিন মোহিনীর পেছনে ছায়ার মতো ছিল। রাতে ওর সাথে পুকুরেও নেমেছে দু`বার, মশকরা করে বলেছে, ইরাভানকে বিয়ে করে আমার সাথে জলকেলি? দেবতার অভিশাপ নিও না, মেয়ে!

বিশ্বনাথনকে এইজন্যই ভালো লাগে মোহিনীর। ও যে পুরোটা নারী না— সেটা বিশ্বনাথন বারবার ভুলে যায়। মোহিনী কয়েকবার বলেছে, জিজ্ঞেস করেছে, অনুরোধও। কিন্তু বিশ্বনাথন বলেছে সে হেটরোসেক্সুয়্যাল। মোহিনী খুব সহজেই মেনে নিয়েছে, প্রত্যাখ্যাত হলো কীনা এ নিয়ে কোনো ডিলেমা নেই তার।

একজন বৃদ্ধমতো লোক এসে একটা কাঁচির ডাঁট দিয়ে মোহিনীর চুড়ি ভেঙে, থালি কেটে দিয়ে গেল। সবাই সিঁদুর মুছে, বুক চাপড়ে বিলাপ করছে। কুভাগামের পথে পথে রঙবেরঙের ভাঙা চুড়ি, আর ছেঁড়া ফুল। মোহিনী জানে না, এই কান্না কিসের। একরাতের জন্য সধবা হওয়ার? বৈধব্যের? নাকি এই অপূর্ণ শরীরের?

মোহিনী শাড়ি খুলে সাদা থান জড়িয়ে নেয় শরীরে। আশপাশে বিশ্বনাথনকে দেখা যাচ্ছে না। কোথায় গেল মানুষটা! কয়টা মাতাল ছেলে ওকে ফলো করছে, আজেবাজে কমেন্ট করছে—  মিস কুভাগাম, চলুন। আপনাকে আবার সধবা করে দিই।

সরে দাঁড়া, সবগুলোর বিচি থেঁতলে দেব।... বিশ্বনাথন... বিশ্বনাথন...

প্রচণ্ড ব্যথায় বিশ্বনাথন কুঁকড়ে ওঠে। কুভাগামে এসে শেষে পাটা গেল। অবশ্য মোহিনীকে কেউ ক্ষতি করতে পারেনি, এইটাই বড় কথা। বিশ্বনাথনের গাড়ি চলছে না। তামিল হিরো আইয়াপ্পার গাড়িবহরের কারণে বিশাল জ্যাম লেগে গেছে। মোহিনী বিশ্বনাথনের হাত ধরে আছে। সাদা থানে ওকে লাগছে উর্বশীর মতো।

খুব ব্যথা?
বিশ্বনাথন মাথা নাড়ে। মোহিনী, আমার মিডল নেইম কিন্তু ইরাভান।
আমার জন্য মাতালদের সাথে হাতাহাতি করতে হবে কেন! বিশ্বনাথনের গলা জড়িয়ে ধরে মোহিনী, ওর বুকে বিড়ালের মতো মুখ ঘষতে থাকে সে।
বিশ্বনাথন বাধা দেয় না। গুনগুন করতে থাকে—
পদ্মনাভম সুরেশম্
পদ্মনাভম সুরেশম্...