যুদ্ধবিরোধী কবিতা

পর্ব ৩

অনুবাদ: রথো রাফি

প্রকাশিত : জুন ০১, ২০১৮

২০১৪ সালে যখন ফিলিস্তিনের ওপর ইসরায়েল জলস্থলআকাশ থেকে বোমাবর্ষণ করছিল, সারাবিশ্বে ইসরায়েলি বর্বরতার যখন ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছিল, সেসময়েই এ কবিতাগুলো ভাষান্তর করেছিলেন নব্বই দশকের মেধাবী কবি রথো রাফি। কিন্তু এরপর কবিতাগুলো কোথাও তিনি প্রকাশ করেননি। ছাড়পত্রের পাঠকদের জন্যে ধারাবাহিকভাবে কবিতাগুলো প্রকাশ করা হলো:

 

ফাদিল আল আজাওয়ি (ইরাক:১৯৪০)

সবই তো প্রমাণ হলো শেষে

কীসের অপেক্ষায় আছি আমরা?
সবই তো প্রমাণ হলো শেষে।
হঠাৎ করে চাঁদ নিভে গেল
আর প্রণয়পাত্র গেল বাড়ি পথে ফিরে,
যুদ্ধও তো হলো শেষ
আর শবদেহগুলোও নিয়ে গেছি কবরখানায়।
রক্তে ভেজা হাতগুলোও তো
আমরা ধুয়ে ফেললাম নদীতে।
আকাশ কালো করে ফেললো ভারি মেঘ,
বাতাসও তাদের তাড়িয়ে দিলো দূরে।
ঠাণ্ডামরা বাসস্টপে দাঁড়িয়ে রইলাম আমরা
চলে গেছে শেষ বাসও আর অন্ধকারে পরিত্যক্ত আমরা।
কিছুই করার নেই ওই আকাশগঙ্গার পথ ধরে
পুনরায় পায়ে হাঁটা ছাড়া।

রাতে কখনো রাতকে বিশ্বাস করো না!
তো কীসের অপেক্ষায় এখানে আছি আমরা?

অহারন শাবতাই (ইসরায়েল, ১৯৩৯)

২০০৬

অনেক বই
অনেক কবিতার সংকলন
প্রকাশ হলো ২০০৬ এ
আর বইমেলায়
তাকে-তাকে রাখা হলো সাজিয়ে।
অল্প কয়টা আমি ঘেঁটে দেখি,
আর পৃষ্ঠা ১১ থেকে
পৃষ্ঠা ৩০ পর্যন্ত
পৃষ্ঠা ৮০ পর্যন্ত
পৃষ্ঠা ৩০৮ পর্যন্ত
প্রতিটি পৃষ্ঠায়
একটাই
মাত্র একটাই বাক্য:
গাজার মা শিশুরা
খাবার খুঁজছে
আবর্জনার স্তূপে।

মাহমুদ দারবিশ (ফিলিস্তিন, ১৯৪২)

বলি নম্বর ৪৮

তারা চাঁদ ও গোলাপের একদলা মাংস দেখতে পেল তার বুকে
আর তাকে পাথরের উপরে ফেলে দেয়া হলো।
তার পকেটে কয়েকটা পয়সা পেল তারা,
একটা ম্যাচ, ভ্রমণের পাসবই
আর তার তরুণ বাহুতে আঁকা উল্কি।

মায়ের পেট পুড়তো তার জন্য
বছরের পর বছর কত হাহাকার করতেন তাকে ভেবে
তার চোখের গর্ত থেকে গজালো কাঁটাঝোপ
আর ঘন হয়ে এলো অন্ধকার।

তার ভাই যখন বড় হলো
শহরের বাজারে কাজের খুঁজে ছুটতে লাগলো
তাকেও তারা জেলে পুরলো:
সে ভ্রমণের পাসবই সঙ্গে নিয়ে ঘুরতো।
রাস্তার উপরে সে বয়ে বেড়াতো সাকুল্যে আবর্জনার একটা ঝুড়ি
আর কিছু বাকসো।
দেশের হে প্রিয় শিশুরা, আর তাই
সঙ্গত কারণেই চাঁদটাও গেল মরে

পরিচয়পত্র

লিখে রাখুন
    আমি আরব একজন
আর আমার কার্ডের সংখ্যা পঞ্চাশ হাজার
আট ছেলেমেয়ে আমার
আর নবম শিশুটি আসছে গ্রীষ্মের পরেই।
তা নিয়ে রাগ দেখানোর কী আছে?

আরও লিখে রাখুন।
    আমি আরব একজন
কঠোরশ্রমী কমরেডদের সঙ্গে কোয়ারিতে পাথর কাটি।
আমার আট ছেলেপিলে
তাদের জন্য যেভাবেই পারি রুটির টুকরো বাঁচিয়ে রাখি,
পাথর কুঁদে
জামাকাপড় আর বইখাতা কিনি
তবু আপনার দরজায় এসে ভিক্ষে করি না,
    আপানার দরজার চৌকাঠে এসে মাথা নোয়াই না।
    তা নিয়ে রাগ দেখানোর কী আছে?

আরও লিখে রাখুন।
    আমি আরব একজন।
আমার নামের সামনে কোনো খেতাব নেই,
যেখানে সবকিছু ক্ষোভের ঘূর্ণি-স্রোতে পাক খায়
সেখানে আমি বড়ো ধৈর্যধরা মানুষ।
    আমার শেকড়
    শক্ত করে গেঁথে গেছে সময়েরও জন্মের আগে
    যুগটা পুজিবাদী হওয়ার আগেই
    সাইপ্রেস আর জলপাই গাছগুলোরও আগে,
    আগাছা বাড়বাড়ন্ত হওয়ারও আগে।
আমার বাবা চাষাপরিবারেরই একজন
    অভিজাত বা ডাকসাইটে কেউ নয়।
আর আমার বাবার বাবা ছিলেন চাষা
    কোনো যোগসূত্র বা বংশপঞ্জি নেই!
অক্ষরজ্ঞানের আগেই আমাকে
    ধারণা দিয়েছেন ওই দাম্ভিক সূর্যটা সম্পর্কে
আর আমার বাড়িটা আসলে দরোয়ানেরই একটি ঘর।
    নলখাগড়া ও বেতের বেড়া দেয়া।
আমার কুলজি কি তুষ্ট করলো আপনাকে?
    আমি একটা নাম যার কোন খেতাব নেই।

লিখে রাখুন।
    আমি আরব একজন।
চুলের রং ঘন কালো।
চোখের রং বাদামি।
সনাক্তকারী চিহ্ন:
    মাথার উপর কেফিয়ের ঠিক উপরে যে ’ইকাল শিরাটি
    যেই ছুঁতে যায় তাকেই খাঁমচে দেয়।
ঠিকানা:
    এক গ্রাম থেকে এসেছি, প্রত্যন্ত এলাকা, ভুলে গেছি
    গ্রামের অলিগলির কোনও নাম নেই
    আর সব মানুষই মাঠে-ময়দানে আর পাথরের কোয়ারিতে।
    তা নিয়ে রাগ দেখানোর কী আছে, বলুন?

লিখে রাখুন।
    একজন আরব আমি।
আপনি আমার পিতৃপুরুষের আঙুর বাগান ছিনিয়ে নিয়েছেন
    আর কেড়ে নিয়েছেন জমিজমা
    ছেলেপিলেদের নিয়ে যাতে আবাদ করতাম আমি,
    আর আপনি আমাদের জন্য আমাদের নাতিপুতিদের জন্য
    কিছুই রাখেননি, এইসব পাথুরে পাহাড় ছাড়া।
    আপনার সরকার তাও কি ছিনিয়ে নেবে
    আপনার সরকার যেমনটা বলে থাকে?

তাহলে!
    প্রথম পৃষ্ঠার একেবারে ওপরে লিখে রাখুন:
    মানুষকে আমি ঘেন্না করি না,
    কারো সম্পত্তিতে আমি নাকও গলাই না।
আর তারপরও যদি আমাকে উপোসই করতে হয়
    দখলদারদের মাংস চিবিয়ে খাব আমি।
    আমার ক্ষুধা আর আমার ক্রোধের হাত থেকে
    সাবধান, খুব সাবধান!

চলবে