রংবাজ

উপন্যাস ৩

আশিকুজ্জামান টুলু

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ১৯, ২০১৮

সন্ধ্যায় বাবু বাসায় ফিরল তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে। রোকেয়া দৌড়ে যায় বাবুর ঘরে, মামা, মামা জানেন আইজকা কী হইছে? নানিরে কিসমইত্তা গাইল্লাইয়া থয় নাই, মা বাপ তুইলা গাইল্লাইছে। সারাদিন পানি ছাড়ে নাই, আমরা কিচ্ছু রানতে পারি নাই।

বাবু বলল, আম্মারে ডাক। রোকেয়া চলে যায় বাবুর মাকে ডাকতে। বাবু রাগে ফেটে পড়ে, সাথে ওর বন্ধুরাও।
বাবু: হালারে আইজকা মাইরাই ফালামু।
রিপন: হালারে নিচে ডাক চটকনা দিমু।
বাবু: নারে আইজকা ওরে আমি খাইছি, ওর কত সাহস হইছে, আম্মারে গাইল্লাইছে।

বাবুর আম্মা আসেন। বাবু বলল, মা কি হইছিল? কিসমত শুনলাম তোমারে গালি দিছে?
বাবুর মা: বাদ দে, ওইটা একটা ইতর।
বাবু: মা কও কী হইছে। আজকে ওরে আমি ছাড়ুম না।
বাবুর মা: এই গণ্ডগোল করিস নাতো।

বাবু কথা না শুনে খোলা উঠোনটায় গিয়ে ওদের জালানার দিকে মুখ উঁচিয়ে চিৎকার করতে থাকে কিসমত কিসমত বলে। ওর চিৎকার শুনে বাড়িঅলী চলে আসে জানালায়, সাথে কিসমত ও শাফিনাও। শুরু হয়ে যায় অস্বাভাবিক চিৎকার চ্যাঁচামেচি। আসে পাশের বাড়ি থেকে সবাই উঁকিঝুঁকি দিতে থাকে। শফিকও উঁকি দেয় তিনতলা থেকে। বাবু গালাগালি শুরু করে দিয়েছে এরই মধ্যে। কিসমতও কম যায় না, মুখে যা আসছে তাই বলতে শুরু করেছে। এর মধ্যে বাবুর বন্ধুরা এসে যোগ দিয়েছে বাবুর সাথে।

বাবু: ওয় কুত্তার বাচ্চা কিসমোইত্তা, তোর সাহস বাইড়া গেছে। তুই আমার মারে গাইল্লাইছস। তোরে আমি খায়া ফালামু।
রিপন: কিসমোইত্তা, তুই অনেক বাড়ছস। তোরে আমি শেষ কইরা ফালামু জানোয়ারের বাচ্চা। তোরে আমি গুল্লি করুম, তোর গোয়ায় নল ঠ্যাকামু আর গুল্লি বাইর হইবো মাথা দিয়া কুত্তার বাচ্চা। তুই আমারে চিনোছ নাই।
বাবু: ওয় রিপন, তুই না, ওরে গুলি করুম আমি। আমি তোরে শেষ কইরা ফালামু, মনে রাখিস আইজকার দিনটা। তোর লাশ না ফালাইলে আমার নাম বাবু না।
কিসমত: তোরা অনেক বাইড়া গেছস। তোগো ডিবি দিয়া ধরামু, খাঁড়া। তোগো লাত্থাইয়া বাইর করুম এক মাসের মইদ্যে।
বাবু: ওয় তুই নিচে আয়, জানালায় খাঁড়ায়া খাঁড়ায়া বদি আওয়াজ না দিয়া নিচে আয় সাহস থাকলে।
বাড়িঅলী: ও নিচে আসলে কি করবি তোরা? উসে কেয়া মার ডালেগা? তুঝে মায় থানে ভেজুঙ্গি, তুঝে ম্যায় আন্দার কার দুঙ্গি।
রিপন: ওয় মাউড়ার বাচ্চা, ওয় রাজাকার, এহনও গলা কমে নাই? এহনও এত সাহস? কিসমোইত্তার সাহসে লাফাস বুড়ির বাচ্চা। তোর জামাইরেতো আমরা খায়া ফালামু, তারপর তুই যাবি কই?
শাফিনা: তুমলোক তো জানোয়ার কি আওলাদ, তু কেয়া কার লেগা মেরে সহারকো? আরে ওহি তুঝকো দেখ লেগা।

রিপন: ওয় ছেড়ি বাংলায় ক। থাকস বাংলাদেশ আর কথা কস উর্দু। শালার মাউড়ার গুষ্টি কিলাই।
সাবু: ওয় কিসমোইত্তা, তোর ডর লাগতাছে না? কাগো চেতাইছস তুই তো ভালো কইরা জানোস। তুই তো আর রাস্তায় বাইরাইতে পারবি না।
কিসমত: তোগো সবার নামে আমি জিডি করুম, যাবি কই তোরা।

ঝগড়া চলতে থাকে পূর্ণোদ্দমে। একসময় দুপক্ষই ক্লান্ত হয়ে যায়। থেমে যায় ঝগড়া। তিনতলার শফিকের পুরো বিষয়টা ভালো লাগে না। ও ভীষণ বিরক্ত হয়। শাফিনাকে কেউ কিছু বললে ওর কেন যেন সহ্য হয় না। ওর অসম্ভব ভালো লাগে শাফিনাকে। অন্যান্য ভাড়াটিয়ারাও ভীষণ বিরক্ত হয়, কারণ ওরাও পানির কষ্টে দিনাতিপাত করে বাবুদের মতো।

বাবু, সাবু ও রিপনসহ সব কয়টা বন্ধু ওরা অসম্ভব ভালো ছাত্র। বাবু মেট্রিকের টেস্ট পরীক্ষায় খুব ভালো করেছে। রিপনেরও খুব ভালো মার্ক্স ছিল টেস্টে। সাবু গতবার আর্টস থেকে মেট্রিক পাশ করেছে ফার্স্ট ডিভিশন ও ৩টা লেটার নিয়ে। বাকিরাও প্রত্যেকে খুবই ভালো ছাত্র। রিপনের নানা মিনিস্টার। সাবুর বাবা পুরানো জাঁদরেল সেক্রেটারি। বাবুর বাবা নামকরা ব্যাবসায়ী। নিজের ধানমণ্ডির বাড়িটা ভাড়া দিয়ে পুরান ঢাকায় থাকেন যুগ যুগ ধরে। বাবুসহ ওর বন্ধুরা প্রত্যেকে ভালো ফ্যামিলির ছেলে। দেখতে ওদের একটু রাফ লাগলেও ভালো ওরা, শুধু দুষ্টামি না করলে ওদের পেট ভরে না। আর মাত্র ১০ দিন বাকি ওদের মেট্রিক পরীক্ষার। এ কারণে ওরা ওদের মারপিটের প্রোগ্রামটা পণ্ড করলো, আর তাছাড়া ঈদের দিনে মারপিট বিষয়টা ঠিক ভালো ঠেকলো না ওদের কাছে । ভালোয় ভালোয় ঈদ হয়ে গেল। ঈদের ঠিক ৩ দিন পরের কথা। রাত হয়ে গিয়েছে বনগ্রাম রোডে, রাত ৮টা। টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। স্যাঁতস্যাঁতে কাদায় ভরে আছে রাস্তা। রোডের দুপাশের বহু পুরানো ছোট্ট ছোট্ট বাসায় রাস্তার পাশের ঘরগুলোতে টিমটিমে বাতি জ্বলছে। ছোট ছোট জানালা দিয়ে ফালি ফালি বাতির বিম বাইরে রাস্তায় এসে পড়েছে। কী ইচ্ছা করে ঐ ছোট্ট জানালা দিয়ে ভিতরে তাকিয়ে দেখতে– ওরা কি করছে, কি খাচ্ছে, কি দেখছে। বাসাগুলো ভীষণ ছোট আর পুরানো। মাত্র ১২ কি ১৪ ফিট চওড়া আর হয়তো ৪০ ফিট লম্বা, খয়ে যাওয়া লাল লাল ইট দাত বের করে আছে। বনগ্রামে জনতা ব্যাংকের মোড় থেকে একটু ভিতরে ঢুকলেই হাতের বাঁয়ে সাব্বান খানের পাঞ্জাবী সেলাই করার দোকান, খুব ভালো সেলাই করে এরা। শোনা যায় ওখানে নায়করাজ রাজ্জাক পাঞ্জাবি বানাতে আসেন রাতের আঁধারে। বিসিসি রোড আর বনগ্রামের মোড়ের একেবারে ২০ গজ দূরে বিসিসি রোডে সোহেল রানার বাসা। সোহেল রানা তার বিরাট শেভ্রলেট গাড়িতে সকালে শুটিঙে যান আর গভীর রাতে ফেরেন। উনি নকল চুল পরেন। সবাই তাকিয়ে থাকে ওনার গাড়ীর দিকে, বেশ রাশভারী লোক, অযথা কথা বলেন না।

চলবে