রংবাজ

উপন্যাস ৯

আশিকুজ্জামান টুলু

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২৬, ২০১৮

বাবু ওর পাড়াতে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করে। যখনি ও বের হয়, পাড়ার দোকানদার থেকে শুরু করে সবাই, এমনকি পাড়ার সবচাইতে বাজে ছেলে বাবুল, যাকে সবাই ভীষণ ভয় পায়, যাকে ও কিছুদিন আগে মারতে চেয়েছিল, সেও বাবুকে দেখা মাত্র সালাম দেয়, সরে দাঁড়ায়। বাবু আশ্চর্য হয়ে যায় সবার আচরণে। কেমন একটা ভালোলাগাও ওকে পেয়ে বসে। কেমন যেন বুক ফুলে ওঠে পাড়াতে চলার সময়। পাশের পাড়ার জগলু (বাবুর একটু বড় হবে), নামকরা রংবাজ, যাকে দেখলে সারা পাড়া কাঁপে, সে একদিন বাবুর বাসায় এসে উপস্থিত। ওকে ডেকে পাঠায় বাইরে, বাবু যায়। বাবুকে বাইকে উঠিয়ে নিয়ে যায় ওয়ারীর সুপার স্টারে। প্রচুর খাওয়া দাওয়া করায়। যেকোনো দরকারে ও বাবুর পাশে আছে বলে আশ্বাস দেয়। ওকে অফার দেয় একসাথে কাজ করার জন্য। শুধু বাবু নয়, রিপন, সাবু সবারই কদর ভীষণভাবে বেড়ে যায় বাবুদের পাড়াতে। যখন বাবু, রিপন, সাবু একসাথে পাড়ার রাস্তায় হাঁটে, মুহুর্মুহু ‘সালাম ভাই’ ‘সালাম বস’ ‘গুরু সালাম’ এইধরনের কথায় ওদের কান আর মন ভরে যায়। কোথা থেকে এক অমোঘ শক্তি ওদের সারা চেতনাকে ঘিরে ফেলতে থাকে ধীরে ধীরে।

একধরনের আধিপত্ত, একধরনের অথোরিটির গৌরব মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলে ক্রমেই। কাউকে আর ভয় লাগে না। উপরের তলার বাড়িঅলী, শাফিনা, বাড়িঅলীর ছেলে, কেউ আর চোখ তুলে বাবুর দিকে তাকায় না। শুধু বাড়িঅলী নয়, সাড়া পাড়া টানটান হয়ে যায় বাবুর ব্যাপারে। যে দোকানদার ৯০ টাকার বেশি বাকি হলেই বলতো, ‘আর বাকি দেওন যাইবো না’, সে এখন বলে, ‘বাবু ভাই, যত লাগে নিয়া যাবেন, পয়সা নিয়া চিন্তাই কইরেন না, আপনে আমার বড় ভাই।’ ওইরকম বয়স্ক লোকের মুখে বড় ভাই ডাক শুনে একটু অস্বস্তি লাগে। তবুও কেন যেন মন চায়, ডাকুক না বড় ভাই, কী আসে যায়!

খুব তাড়াতাড়ি বাবুর মধ্যে একটা বিরাট চেঞ্জ আসে। বাবুর সাথে আশেপাশের পাড়ার যত রংবাজ ছেলেপেলে, সবার সাথে পরিচয় হয়। সবাই ওকে নিয়ে পার্টি দেয়। সবাই ওকে আলাদাভাবে সম্মান করে। বাই ডিফল্ট কখন যেন বাবু রংবাজ উপাধি বিনাকষ্টে, বিনাশ্রমে অর্জন করে আশপাশের সব ইয়াং রংবাজদের মধ্যে। তবে ওর স্ট্যাটাসটা বেশ হাই হিসাবে পরিগণিত হয়। কারণ ওর বয়সী কোনো রংবাজই একটাও মার্ডার কেসের আসামি হতে পারেনি। অথচ বাবু মার্ডার কেসের আসামি। শুধু তাই নয়, একেবারে এক নম্বর আসামি। শাস্তি হলে একবারে হাইওয়ে টু হ্যাভেন। এই লাক্সারি আশপাশের আর কোনো রংবাজেরই নাই। ওরা রংবাজি করার জন্য কত কাঠখড় পুড়িয়ে, ট্যাক্স দিয়ে, এর ওর মাথা ফাটিয়ে, দুই চারটা বাড়ি দখল করে, চাঁদাবাজি ছিনতাই করে তবেই দুই চারটা সালাম পায় এবং সবাইকে গালাগালি করে ভয় জিইয়ে রাখে। অথচ বাবু একেবারে বর্ণ রংবাজ। ওর এসব কিছুই করতে হলো না, জাস্ট তিনটা গুলি বুক বরাবর করেই সবচাইতে হাই স্ট্যাটাসটা পেয়ে গেল। কী লাকি! একে ট্যালেন্ট বলে না তো কাকে বলে?

কাপ্তান বাজারের সজল আর ফজল, দুই ভাইয়ের সাথে বাবুর হয়ে যায় চরম হৃদ্যতা। সন্ধ্যা হলেই সজল ফজলদের পাড়ায় মাহবুব আলী মিলায়নাতনের মাঠে, অন্ধকারের মধ্যে বসে গাঁজার আসর। সজলদের নিয়ে আসা কাঠের পাটাতনের উপর একটা ছোট্ট কাঠের হাতলঅলা ছেনি দিয়ে গাজার গাছগুলি কুচি কুচি করে কেটে কল্কিতে ভরা হয়, একটু কালা মিশানো হয়। কালার আরেক নাম আফিম, একেবারে লবঙ্গর মতো গন্ধ। বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে চেপে চেপে গাঁজা ঢুকানো হয় কল্কিতে, তারপর কল্কিতে আগুন ধরানো হয়। সবাই চারদিকে গোল হয়ে বসে, চোখগুলো অন্ধকারের মধ্যে জ্বল জ্বল করতে থাকে, নেশা হওয়ার আগেই মাথাটা নেশার আশায় ঝিম ধরে যায়। কোনো এক বিন্দু থেকে শুরু হয় ক্লক বা অ্যানটি ক্লক ওয়াইজ স্বপ্নালোকের যাত্রা। কি এক অদ্ভুত জমানো নেশা, কেমন যেন হাল্কা করে দেয় মাথার ভেতরটা। তিন চারজন টানার পর কল্কিটা গরম হয়ে যায়, তখন প্রয়োজন হয় একটুকরা ত্যানা কল্কিকে পেঁচিয়ে ধরার জন্য। কেউ কেউ আবার পাকা গাঁজারু। একটানে কল্কি ফাটিয়ে দেয়, খুব নাম হয় এদের। তিন চারটা পাক যাওয়ার পর বিসিসি রোডের গ্রিন সুইট থেকে আনা বিশ্ববিখ্যাত জিলাপি খাওয়া শুরু হয়, কেউ খায় চড়া চিনির চা, কেউবা রসগোল্লা। সবকিছুর মজুত থাকে ওই আসরে। আসরের সব চাইতে ইউনিক বিষয় হচ্ছে, কেউ কাউকে ব্যাক্তিগতভাবে না চিনলেও ওই মুহূর্তে সবাই হয়ে যায় সবার জানি দোস্ত এবং এর চাইতেও আরও চমৎকার বিষয় হচ্ছে, ওখানে কেউ বা ট্যাক্সি চালক, কেউ বা কসাই, কেউ বা দোকানদার, কেউ বা কবি, কেউ বা সাহিত্যিক, কেউ বা বড় ব্যবসায়ী– একেবারে কমিউনিজম আর কি। ধনী-গরিবে কোনো ভেদাভেদ নাই গাঁজার আসরে। সবাই সমান। তবে ওই রতিক্রিয়া ওই পর্যন্তই, নেশা শেষ হলেই সবাই সেই আগের মানুষেই রূপান্তরিত হয়ে ফিরে যায় যার যার নীড়ে। কিন্তু যতক্ষণ ওখানে থাকে ততক্ষণ ওদের মন গেয়ে ওঠে, মনু মিয়ার গাঁজার নৌকা পাহাড় দিয়া যায়...

ধীরে ধীরে বাবুর মধ্যে বিরাট পরিবর্তন দেখা দেয়। এরই মধ্যে গোপাল জেল থেকে বেরিয়ে এসে বাবুকে খবর দেয়। বাবু দেখা করে, কয়েকটা অ্যাসাইনমেন্ট দেয় বাবুকে গোপাল। বাবুর প্রভাব প্রতিপত্তি এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে যে, কোনো কাজ ওর নিজেকে করতে হয় না, বহু সাগারেদ জোগাড় হয়েছে, ওরাই করে দেয় বসের কাজ একটু নেকনজরের আশায়। গোপালের মাধ্যমে পরিচয় হয় সুত্রাপুরের ওসির সাথে। ওখানে বসে চলে মদের আড্ডা, বড় বড় অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে আলোচনা। কয়েকটা থানার বড় বাবুদের সাথে হয়ে যায় সখ্য, ছোটখাটো মাস্তানদের থানা থেকে বের করতে বাবুর একটা ফোনই যথেষ্ট হয়ে যায়। হাতে আসতে থাকে অগণিত টাকা। মানবিকতা, মনসিকতা সব কিছুতে অমোঘ পরিবর্তন আসে ওর। ধীরে ধীরে বাবু তলিয়ে যেতে থাকে গভীর অন্ধকারে। অন্ধকারের জগতে ও হয়ে ওঠে উজ্জ্বল নক্ষত্র।

ওদিকে কোর্টে কেস চলতে থাকে, চার্জশীট দিয়ে দেয়ার কারণে বাবুর বাঁচার আর কোনো পথ থাকে না। হয় ফাঁসি নয় যাবজ্জীবন, যেকোনো একটা। যত বড় ধরনের প্রভাব সম্ভব, বাবু সবগুলিকেই কাজে লাগাতে চেষ্টা করে যাতে করে যাবজ্জীবনটা বহাল করতে পারে। ওর জন্য কয়েকজন মিনিস্টার হাত লাগান কেসে, রিপনের নানাও এগিয়ে আসেন বাবুরদের জন্য, সাথে সাবুর বাবা। সব ধরনের প্রভাব থাকার পরও কেসটা দুর্বল হয় না। কারণ কিসমতের বড়ভাই ছিল ইত্তেফাকের বেশ বড় গোছের সাংবাদিক। ওনার কারণেই বিষয়টা মিডিয়াতে সহজে কাভারেজ পেয়ে যায় এবং ধামাচাপা দেয়া একেবারে অসম্ভব হয়ে যায়। দিনে দিনে কেসটা খারাপ শেপ নেয়, সব কিছুই বাবুর এগেইনস্টে চলে যায়। মনে মনে বাবু প্রহর গুনতে থাকে ওইদিনটার যেদিন ফাঁসি অথবা যাবজ্জীবনটা ঘোষণা দেয়া হবে।

চলবে