রংবাজ

উপন্যাস ১০

আশিকুজ্জামান টুলু

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২৭, ২০১৮

অনেক বেলা হয়ে গেছে। বাবু ঘুমাচ্ছে বেঘোরে। অনেক রাতে ফিরেছে ও। হঠাৎ ওর দরজায় নক। বাবু ধড়ফড় করে উঠে দরজা খুলে দেয়। সিমা ঢোকে ভিতরে। সবকটা জানালা বন্ধ, ঘরের ভিতরটা একেবারে অন্ধকার দিনের বেলাতেও। ফুলস্পিডে ফ্যান চলছে। বাবুর বদভ্যাস ফুলস্পিডে ফ্যান চালিয়ে ঘুমানো। বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টি, মাঝে মাঝে বজ্রপাতের আওয়াজ। চারদিকটা কেমন অন্ধকার। পাশের আজিজদের বাসার টিনের চালে ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে। ওরা বোধহয় ক্যাসেট প্লেয়ারে বাজাচ্ছে ঐ গানটা, আকাশ মেঘে ঢাকা, শাওন ধারা ঝরে...

সিমা বেশ খানিকটা ভিজে গিয়েছে রিকশা থেকে নামার সময়। বাবু আবার এসে বিছানায় শুয়ে পড়ে। সিমা বাবুর পায়ের দিকে বসে। ঘরের ভিতরের অন্ধকার, বাইরে বৃষ্টির প্রচণ্ড শব্দ, পাশের বাসার ‘আকাশ মেঘে ঢাকা’ গানটা আর সাথে বাবুর ঘরের পুরোনো মিল্লাত ফ্যানের একঘেয়ে ভনভন আওয়াজ সিমার মনকে কেমন একটা দুলুনির মধ্যে নিয়ে আসে। কেমন যেন লাগে ওর। কিচ্ছু বলে না সিমা, চুপ করে বসে থাকে। বাবু কোনো কথা না বলে ইশারায় ডাকে ওকে। সিমা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কিন্তু কাছে যায় না।

সিমা বলে, বাবু আমি আর পারছি না, আমি এত কথা শুনতে পারবো না। আমার আর সহ্য হচ্ছে না। আমাদের সারা পাড়ার লোকেরা তোমার ব্যাপারে অনেক কিছু বলেছে আমার বড় ভাইয়ের কাছে, পাশের বাসার আনটি গতকাল তোমার সব কীর্তি বলে দিয়েছে মাকে। মা আর আমাকে বের হতে দেবে না কাল থেকে।
বাবু বলে, ঠিক আছে, আর বাইর হইয়ো না, তাইলেই সব ঝামেলা শেষ।
সব কিছু নিয়ে ফাজলামি আমার ভালো লাগে না।
তো আমি কি করুম? আমারে কি করতে কইতেছ?
সিমা কাঁদতে শুরু করে।
কি হইছে? কানতেছ কেন?
সিমা কোনো কথা বলে না, শুধুই কেঁদে চলে। বাবুর অযথা কান্না ভালো লাগে না। ও বলে, আরে কি হইছে? এত কান্নার কি হইলো? কইলে কও, না কইলে যাইগা, আমার কাম আছে।

বাড়ির ভিতর থেকে বাবুর আম্মা এসে ঘরে ঢোকেন। সিমাকে দেখে বলেন, কি মা, কখন এসেছো? সিমা কান্না লুকিয়ে বলে, এইতো খালাম্মা, কিছুক্ষণ আগে।
বাবুর দিকে তাকিয়ে বাবুর মা বলেন, কিরে, কাল কখন ফিরছিলি?
অনেক রাতে।
আর কত জ্বলাবি তুই আমাকে বাবু? আমি তো আর পারছি না তোকে নিয়ে। সিমা, তুমি ওকে কিছু বলো না?
সিমা মাথা নিচু করে রাখে, কোনো কথা বলে না। বাবুর চোখে মুখে হেয়ালি, কোনো গুরুত্বই দেয় না মা বা সিমার কথায়। বাবু প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বার করে মুখে দিয়ে আগুন ধরিয়ে একটা সুখটান দেয়, ভুরভুর করে ধোঁয়া ছাড়ে মার মুখের দিকে। সিমা ওর এই আচরণ দেখে লিটারেলি হাঁ হয়ে যায়। এতবড় বেয়াদবি বাবু কিভাবে করছে মার সামনে! বাবু সিগারেট খাচ্ছে মার সামনে, ও কোনোদিন এটা চিন্তাও করতে পারে না। বাবু আবার সুখটান দেয় এবং এবারের ধোঁয়াটা সিমার মুখের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে মিটি মিটি হাসতে থাকে। বাবুর মা’র চেহারায় কোনো ভ্রূক্ষেপ নাই, উনি এক দৃষ্টিতে বাবুর দিকে অগ্নিবর্ষণ করতে থাকেন। বাবু আগে থেকেই মা’র সামনে সিগারেট খায় এই বিষয়টা সিমা জানতো না বিধায় ওর কাছে এরকম লেগেছে।

বাবুর মা সিমার দিকে তাকিয়ে বলেন, তুমি জানো ওর রেজাল্ট?
না খালাম্মা।
কেন, ও তোমাকে বলেনি?
না।
কিরে, ওকে বলিসনি তোর রেজাল্ট?
বাবু চুপ করে সিগারেট টানতে থাকে।
বাবুর মা সিমার দিকে তাকিয়ে বলেন, ও তো স্ট্যান্ড করেছে, টেনথ স্ট্যান্ড।

সিমার চেয়ার থেকে পড়ে যাওয়ার জোগাড় হয়, ওর চোখদুটো কপালে উঠে যায়। ও আশ্চর্য হয়ে বাবুকে জিজ্ঞাসা করে, তুমি টেনথ হইছ?
আবার নীরবতা কিছুক্ষণের জন্য। কারো মুখে কোন কথা নেই। একটু পরে সিমা আবার কথা বলে ওঠে, তুমি আমাকে একবারের জন্যেও তো বোললা না খবরটা!
বাবু এখনও নীরব, কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছে ও। সিমার আবার কান্না পায়, তবে এবার খুশির কান্না। ও কান্না লুকায় বাবুর মার কাছ থেকে। নীরবে কাঁদতে থাকে সিমা।

‘নাশতা খেতে আয় তোরা’ বলে বাবুর মা চলে যান। সিমা বাবুর দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, তারপর বলে, বাবু আমাকে তুমি ভুলে যাও। আমার সাথে তুমি আর যোগাযোগ করতে চেষ্টা কোরো না প্লিজ। আমি আর তোমার সাথে থাকতে পারবো না।
বাবু হঠাৎ একটু সিরিয়াস হয়ে সিমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে, কি বলতে চাচ্ছো তুমি?
তুমি আমাকে ভুলে যাও, আমার পক্ষে আর সম্ভব না।
আর সম্ভব না মানে? তোমার যা ইচ্ছা তাই কোরবা নাকি? তুমি কি খেলা পাইছ? ইচ্ছা হইলে আসবা, না ইচ্ছা হইলে ফালায়া চইলা যাইবা? নতুন কেউ জোগাড় হইছে নাকি?
তোমার লজ্জা করে না এই কথা বলতে? অসভ্য!
তাইলে পারবা না কেন? আমার লগে বেশি ঝামেলা কইরো না, নিজেই ঝামেলায় পইড়া যাইবা।
কী করবা তুমি আমাকে? গুলি করবা? করো গুলি, এখনি করো। আমিতো সেটাই চাই, আমাকে মেরে ফেলো তুমি, আমার জ্বালা সব শেষ হোক। আমার কপাল খুব খারাপ তোমার মতো একটা গুণ্ডাকে ভালবেসেছিলাম। শোনো বাবু, আই মিন ইট, আই ক্যান্ট স্টে এনিমোর, আই ওয়াণ্ট টু গেট রিড অফ ইউ।
ইফ ইউ ওয়ানা লিভ মি, জাস্ট লিভ বাট নেভার ট্রাই টু কামব্যাক এগেইন। আই উড রিয়েলি হেট টু সি ইউ কাম ব্যাক এন্ড ক্রাই এগেইন।
লুক, আই লাভ ইউ অ্যান্ড উইল বি লাভিং ইউ বাট ইউ উইল নেভার সি মি এগেইন। আই হ্যাভ মিনিমাম সেলফরেস্পেক্ট বাবু। তোমার জন্য আমি সব শেষ করেছি, আমি আর পারছি না। জাস্ট ফরগিভ মি।
বাবু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে না। এও কি সম্ভব সিমার দ্বারা? সিমা উঠে দাঁড়ায় এবং দরজার দিকে যেতে উদ্যত হয়, বাবু পথ আগলে দাঁড়ায়। সিমা বলে, প্লিজ যেতে দাও বাবু। আমাকে যেতে দাও আর মাফ করে দাও। আমি আর কোনোদিন তোমার মুখোমুখি হবো না।

বাবু ওকে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে ঠোঁট লাগিয়ে চুমু দিতে যায়, সিমা মুখ সরিয়ে নেয় এবং জোরে একটা ধাক্কা দেয় বাবুকে। বাবু প্রায় পড়ে যেতে যেতে নিজেকে সামলে নেয়। সিমা দরজা খুলে বেরিয়ে হনহন করে হাঁটা দেয়। বাবু লুঙ্গি পরা অবস্থায় সিমার পিছনে রওনা দেয়, হাতটা ধরে, সিমা আবার এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে চলার গতি বাড়িয়ে দেয়। বাবু কয়েকবার ডাকে ওকে সিমা সিমা বলে, সিমা মোটেই পিছনে তাকায় না। বাবু একসময় দাঁড়িয়ে যায়। সিমা কিছুদূর হেঁটে একটা রিক্সায় চেপে বসে। রিক্সাটা যোগিনগরের মোড়ে এসে ডানে ঘুরে ওয়ারীর দিকে চলে যায়। বাবুর পা আর চলে না, কেমন শূন্য লাগতে থাকে। বাবু সিমাকে খুব ভালো করে চেনে, সিমা একবার যা বলে, তা সে করেই ছাড়ে। বাবু বুঝে যায় সিমা চ্যাপ্টার ওর জীবন থেকে ইতি টানা হয়ে গেল।

চলবে