রংবাজ

উপন্যাস ১১

আশিকুজ্জামান টুলু

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২৮, ২০১৮

গোপাল আরেকটা বড় কাজ দিয়েছে বাবুকে। বাবু এক সপ্তাহ ধরে শুধু বিষয়টা নিয়ে ভেবে চলেছে আদৌ করবে কিনা কাজটা। এখন পর্যন্ত হ্যাঁ বলেনি গোপালকে। কাজটায় বিশাল একটা রিস্ক আছে। এই রিস্কটা থেকে বাঁচার জন্য দেশের বাইরে কমসেকম বছরখানেক থাকতে হতে পারে। বাবু মনে মনে শুধু অঙ্ক কষতে থাকে। কাজটা বর্তমান সরকার দলের অ্যাসাইনমেন্ট। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছে, কাজ ঠিকমতো শেষ হলে আগের কেসের শাস্তি, ফাঁসি বা যাবজ্জীবন থেকে দশ বছরে নামিয়ে এনে দেবে এবং নতুন কাজের জন্যও তেমন কোনো রিস্ক থাকবে না। ও ভাবতে থাকে, যদি এক বছর বাইরে থাকে এবং এই সরকার সামনের নির্বাচনে পরিবর্তন হয়ে যায়, তাহলে ওর আমও যাবে, ছালাও যাবে। তবে একবছরের আগেই যদি ওর শাস্তির একটা ফাইনালাইজড রেজাল্ট পেয়ে যায়, তাহলে আর কোনো টেনশন নাই। গোপালের এই অফার না নিয়েও কোনো পথ নাই ওর। কারণ তাহলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কোনো হেল্পই করবে না কেসের ব্যাপারে। চোখের সামনে ফাঁসি হয়ে যাবে। জীবনের এক ক্রান্তি লগনে এসে দাঁড়িয়েছে ও। ভীষণ টেনশনে ভুগছে। এতদিন যা করেছে, তা ওর সাগরেদ দিয়েই হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এবারের কাজটা ভীষণ রিস্কি এবং নিজেকেই করতে হবে। হয়তো একজন বা দুজন থাকতে পারে ওর সঙ্গী হিসাবে। অনেক ভেবে চিন্তে শেষপর্যন্ত নিয়ে নেয় ও কাজটা।

সন্ধ্যা থেকেই আজ বেশ শীত পড়েছে। ওয়াইজঘাট রোডে বুলবুল অ্যাকাডেমির গেটের পাশের দোকানদার কুদ্দুস আলী টিমটিমে হারিকেন জ্বালিয়ে এখনও জেগে জেগে দোকানদারি করে চলেছে। দোকানের বেঞ্চে চাদর মুড়ি দিয়ে বসে আছে দুজন পাড়ার গরিব প্রতিবেশী। টুকটাক কথার কলকাকলিতে চলছে ওদের মধ্যে। সাধারণত শীতের দিনে সন্ধ্যা হলেই দোকানটা বন্ধ করে দেয় কুদ্দুস। গতকাল বউ গিয়েছে বাপের বাড়ি তাই আজ একটু বেশীক্ষণ নাগাদ জেগে থাকা আর কি। ভালই লাগে ওর এভাবে অলস রাতে টিমটিমে হারিকেনের আলোয় বসে কারো সাথে সুখদুঃখের আলাপচারিতা। দূর থেকে একটা রিক্সা আসতে দেখা যায়, রিক্সার নিচে ঝুলানো ও জ্বালানো হারিকেন বাতাসে আর ঝাঁকুনিতে দুলছে। রিক্সাটা এসে কুদ্দুসের দোকানের সামনে দাঁড়ায়। রিক্সা থেকে নামে হিরন। কুদ্দুসের কাছে আসতেই কুদ্দুস সালাম দিয়ে বলে, হিরন ভাই সালামালাইকুম।

বেঞ্চে বসে থাকা লোকদুটো বেঞ্চ থেকে উঠে একটু পাশে সরে দাঁড়ায় হিরণকে দেখে। ওরাও সালাম দেয় হিরনকে। হিরন সালামের উত্তর না দিয়ে কুদ্দুসকে লক্ষ্য করে বলে ওঠে, এক প্যাকেট ফাইভ ফাইভ দে। কুদ্দুস এগিয়ে দেয় ফাইভ ফাইভের প্যাকেটটা। হিরন কথা না বলে হাতে সিগারেটটা নিয়ে পয়সা দিয়ে রিক্সায় গিয়ে ওঠে। রিক্সাটা টুং টুং করে দুটো বেল বাজিয়ে হারিকেনটা দুলিয়ে দুলিয়ে ধীরে ধীরে অন্ধকারে হারিয়ে যায়। ঠাণ্ডা রাতে আবার জমে ওঠে কুদ্দুসের কথোকপতন।

হিরন ইসলামপুর এলাকার ত্রাস। ওকে একনামে সবাই চেনে। অসম্ভব সাহসী ছেলে। শুধু ইসলামপুরের নয়, ও পুরনো ঢাকায় খুব পাওয়ারফুল। ইসলামপুর, তাঁতিবাজার ও শাঁখারি বাজারের যতগুলো সোনার দোকান আছে সবগুলো থেকে ও মাসিক হারে চাঁদা আদায় করে। তাছাড়া জগন্নাথ কলেজেও রয়েছে ওর ভীষণ প্রভাব। ভিপি, জিএসরা এসে ওকে প্রতিদিন সালাম দিয়ে যায়। ওর সাপোর্ট ছাড়া কেউ জগন্নাথের ভিপি বা জি এস হতে পারে না। হিরনের গড ফাদার পুরান ঢাকার নাদির আর জামসেদ, যাদের নাম শোনা মাত্র বাঘ আর গরু এক ঘাটে পানি খায়। অস্বাভাবিক প্রভাব এই দুই নামকরা লোকের। এদের ছায়া আছে বলেই আজ হিরনকে ছুঁয়ে দেখার মতো কেউ নেই।

আজ হিরনের গুরুত্বপূর্ণ একটা মিটিং বাবুর সাথে। খুব গোপন মিটিং যেহেতু কাজটা বড়। এর আগে দুবার কাজের খাতিরে বাবুর সাথে ওর দেখা হয়েছে, একটু সখ্যও হয়েছে। আজ হিরনের পরনে সাদা প্যান্ট এবং গ্রে রঙের ফিনফিনে শারটিনের সার্ট। পায়ে রাদু থেকে কেনা সাদা একজোড়া জুতা, প্যান্টের সাথে ম্যাচ করে জুতা পরেছে হিরন। খুব সৌখীন ছেলে এই হিরন, বনিএমের গান খুব পছন্দ ওর। খুব পার্টি করে বেড়ায়, মাঝে মাঝে নিজেও পার্টি থ্রো করে। ওদের পার্টি গুলি হয় ধানমণ্ডি এলাকায়। ওর কিছু মডার্ন বান্ধবী আছে যারা সুন্দর ড্যান্স করতে পারে। ওদের প্রিয় গান স্যাটারডে নাইট ফিবারের stayin’ alive. ডান্স পার্টিতে সারাক্ষণ বাজতে থাকে। মাঝে মাঝে বেজে ওঠে বিজিজ এর ট্রাজেডি অথবা বনিএমের রাসপুটিন অথবা ডোনা সামারের ইউ ক্যান রিং মাই বেল। হিরন পুরান ঢাকাতে থাকলেও ওর পার্টি করা বন্ধুদের বাস ধানমণ্ডি এলাকায়। পুরান ঢাকায় যতক্ষণ থাকে হিরন, ততক্ষণ ওর চেহারা এক আর পার্টিতে গেলেই এই হিরনই হয়ে যায় দিলদরদি অন্য মানুষ। দেদারসে বন্ধুদের জন্য টাকা খরচ করে। হিরনের মনটা আসলে আকাশের মতো বড় আর কলিজাটা ঠিক সিংহের মতো বিশাল, ভয় ডর বলে কিছুই নাই ওর শরীরে।

আজ ওদের মিটিং হবে শাঁখারি বাজারের ৪৭ নম্বর বাসার দোতলায় একটা ঘরে। এ বাসাটা পুষ্পবালা দেবীর। ১৯৪৭ এর পরেই পশ্চিমবঙ্গ থেকে চলে এসেছিল এদেশে। সাথে ছিল প্রাণপ্রিয় স্বামী আর গোটা চারেক শক্তসামর্থ্য ছেলেমেয়ে। ষাটের দশকের শেষের দিকে স্বামী স্বর্গবাসী হয়ে যাওয়ার পর ছেলেমেয়েগুলো মাকে একা ফেলে যে যার সুবিধা মতো প্রস্থান করে নিজ গন্তব্যে, একা পড়ে থাকে পুষ্পবালা দেবী। প্রথম স্বামীর সাথে এসে এ বাড়িতেই ভাড়াটে হিসাবে উঠেছিল পুষ্পবালা। তারপর থেকে ওখানেই গড়ে উঠেছিলো ওদের সুখের সংসার। বাড়ির মালিক নিঃসন্তান ঋতুরাজ চক্রবর্তী অনেক আগেই স্ত্রীকে হারিয়েছিলেন এবং আর কোনোদিন বিয়ে করেননি। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় ঋতুরাজ চক্রবর্তী পালিয়ে চলে যান কোলকাতা এবং যাওয়ার আগে বাড়িটির মালিকানা বুঝিয়ে দিয়ে যান পুষ্পবালা দেবীকে। স্বাধীনতার পরে ঋতুরাজ চক্রবর্তী স্বর্গবাসী হয়ে যান এবং পুষ্পবালা দেবী বাড়ির একমাত্র মালিক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় পুষ্পবালা জীবনের উপর ঝুঁকি নিয়ে মাটি কামড়ে পড়ে থাকে ঐ ৪৭ নম্বরে। স্বাধীনতার ঠিক আগে শুধুমাত্র মাস দুয়েকের জন্য বিক্রমপুরে পালিয়ে যায় এবং ফিরে আসে কাটায় কাটায় ১৮ই ডিসেম্বর। এসেই উঠে পড়ে ওর ৪৭ নম্বরে ।

তখন থেকে শুরু করে ওকে একা একা অনেক কষ্ট করতে হয়েছে নিজের পেট চালানোর জন্য। বাড়ির রুমগুলিকে আলাদা আলাদা করে ভাড়া দিয়ে চলতে শুরু করলো পুষ্পবালার বেঁচে থাকার সংগ্রাম। যখনি ছেলেমেয়েরা জানতে পারলো যে ঋতুরাজ চক্রবর্তী পুষ্পবালা দেবীকে বাড়িটি লিখে দিয়ে গিয়েছেন, সাথে সাথে ওরা এসে মায়ের পায়ে নতুন করে তৈলমর্দন শুরু করে দিলো। পুষ্পবালা দেবী ভুলে যায়নি তাকে একা ফেলে যাওয়ার কথা তাই মোটেও পাত্তা দেয় নাই ওদের সকাল বিকাল তৈলমর্দন।

চলবে