রংবাজ

উপন্যাস ১২

আশিকুজ্জামান টুলু

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২৯, ২০১৮

শুধু রুম ভাড়া দিয়ে চলছিল না ওর। সত্তর দশকের শেষ দিক থেকে পুষ্পবালা দেবী নতুন একটা ব্যবসার সন্ধান পায় তার এক ভাড়াটিয়ার মাধ্যমে। ভাড়াটিয়া ছোকড়া সিনেমায় নাচের মেয়ে সাপ্লাই দিতো। ও একদিন এসে পুষ্পবালা দেবীকে এই ব্যবসার বুদ্ধিটা দেয় এবং ঐ প্রথম কাস্টোমার নিয়ে আসে। ব্যবসাটা হলো মদের। দর্শনা, কেরু, চোলাই, বিদেশি সব ধরনের মদের স্টক পুষ্পবালা দেবীর বাসায় রাখা আছে। দোতলার একটা ঘর মদ পরিবেশনার জন্য নির্ধারিত করা আছে। জানাশোনা কাস্টোমারদেরই শুধু অ্যাক্সেস এই মদখানায়। কাস্টোমার এলে তাদের পছন্দমতো মদ পুষ্পবালা দেবী গ্লাসে ঢেলে পরিবেশন করে। কাস্টোমার নিশ্চিন্তে বসে মদ খায় রাত নাগাদ। পুলিশকে পয়সা দেয়া হয় বিধায় কোনো ধরনের সমস্যা হয় না। বিভিন্ন পেশার লোকের এখানে আসা-যাওয়া। সিনেমার ডিরেক্টর থেকে শুরু করে নামকরা রংবাজ, সবাই আসে পুষ্পবালার মদালয়ে। ৬৫ বছর বয়স্ক পুষ্পবালাকে নিয়ে অন্য কোনো ঝামেলা হয় না। সবাই তাকে দিদি বলেই ডাকে।

বাসাটা কমসেকম ১০০ থেকে ১৫০ বছর পুরনো। বাসার ভিতরে ঢুকতে হয় খুব চাপা একটা গলি হয়ে। ঐ গলি ঘেঁষে রয়েছে যুগ যুগ ধরে বয়ে যাওয়া অযত্নে লালিত নর্দমা, স্যাওলা পড়ে সবুজ হয়ে গিয়েছে নর্দমার সিমেন্ট করা ধারগুলো। এই গলিটা দুই বাড়ির মাঝখানে অবস্থিত। খুব বেশী হলে তিন হাত চওড়া হবে গলিটা। দুজন পাশাপাশি পার হতে গেলেই লেগে যায় যানজট। দুপাশে দুইটা পুরনো বিল্ডিং, দুইটাই মিনিমাম ১৫০ বছর পুরনো হবে। সিমেন্ট অনেক আগেই খসে পড়ে ইট গুলি বেরিয়ে গেছে ৭৪ এর মনন্থরে দুর্ভিক্ষের কোনো তরুণের দাঁতের মতো। লাল ইট আর লাল সুরকী, বলে দেয় কোন এক সময় এখানে চলেছে কোন মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তের যত্নে বেড়ে ওঠা সংসার, চলেছে বাইজীদের হৃদয়কাড়া গানের আসর, কতজন মন হারিয়েছে এখানে এসে। আজ সে আসর আর নেই, নেই সেই সময়কার আড়ম্বর, নেই সেই সাজ সাজ রব, নেই সুরের ঐক্যতান। এখন এই ইমারতগুলি শুধুই টাইরেনাসোরাসের ফসিল ছাড়া আর কিছুই না। হয়তো কোনদিন কোন এক অজানা ঝাকিতে হয়ে যাবে ময়েনজোদাড়ো।

আজ হিরণদের মিটিং পুষ্পবালা দেবীর মদালয়ে হবে বিধায় অন্য কোন কাস্টোমারের আগমনে নিষেধাজ্ঞা জারি করে দিয়েছে পুষ্পবালা দেবী নিজেই। পুরো রাতের বিল আজ হিরন ও বাবু বহন করবে। হিরনের রিক্সা এসে দাঁড়ায় পুষ্পবালা দেবীর ৪৭ নম্বরে। রিক্সা থেকে নেমে ভাড়া দিয়ে বিদায় করে গলির ভিতর ঢুকে পড়ে হিরন। বাসার ভিতরে ঢুকে ভীষণ অন্ধকার সরু সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে যায় হিরন। ওকে দেখে পুষ্পবালা দেবী এগিয়ে এসে নিয়ে যায় ঐ ঘরে। খাটের উপর উঠে বসে হিরন। জিজ্ঞাসা করে, বাবু আস নাই?
পুষ্পবালা দেবী: না দাদা, উনিতো এখনও আসে নাই।
হিরন একটু চিন্তায় পড়ে, কেউ কি বুঝে ফেললো ওদের প্ল্যান? কেউ বুঝে ফেললে বাবু ওকে আগেই সাবধান করে দিতো। তাহলে দেরি করছে কেন বাবু ।
মিনিট বিশেক পরেই হন্তদন্ত হয়ে বাবু এসে ঘরে ঢোকে। বাবু ঘামছে, খুব অস্থির দেখাচ্ছে ওকে। হিরন ওকে জিজ্ঞাসা করে, কি হইছে? এনি প্রবলেম?
বাবু: না না, কিচ্ছু হয় নাই। গোপালদা’র বাসায় গেসিলাম, উনি একটু দেরি কইরা দিলো।
হিরন: ঠিক আছে, এহন বহো, একটু দম লইয়া লও। ওইদিকে সব ঠিক তো?
বাবু: হ হ সব ঠিক আছে, শুধু একটু প্ল্যানটা বদলাইছে। কাল্লু আর ইকবাল আইতাছে। ওরাও এই নতুন অপেরেশনটার মইদ্যে থাকবো।

হিরন: এইটা কি কইলা, গেটিস ঢুকাইসো কেন? কাল্লু ইকবালরে কি দরকার? খামোখা মানুষ বাড়াইতেসো কেন? আমরা দুইজনইতো এনাফ আছিলাম।
বাবু: আমি ঢুকাই নাই, গোপাল দা ঢুকাইসে।
৫ মিনিটের মধ্যে কাল্লু আর ইকবাল এসে ঢোকে ঘরে। বাবু ওদের বসতে ইশারা দেয়। পুষ্পবালা একটা হুইসকির নতুন বোতল এনে খুলে হিরণদের খাটের ওপর রাখে। সাথে করে বেশ কিছু গরম শিক কাবাব আর চানাচুর এনে পাশে রাখে। বাবু বোতল থেকে একটা গ্লাসে এক পেগ হুইস্কি ঢেলে হিরনের দিকে এগিয়ে দেয়। হিরন ড্রিংকটা হাতে নেয়, বাবু নিজের জন্য ঢালে একটা গ্লাসে, কাল্লু ও ইকবাল নিজেদের মতো নিয়ে নেয়। চারজন চিয়ার্স করে এক নিঃশ্বাসে গিলে ফেলে হুইস্কি।

হিরন: এবার বলো কামটা কি? শুধুতো বদি আওয়াজ দিয়া গত সাতদিন ভিজাইয়া রাখসো।
 বাবু: আরে এতো তাড়াহুড়ার কি আছে? একটু আরামসে বসি, একটু খাওয়া দাওয়া করি, আইজকা কথা শেষ না কইরা যামু না।
হিরন সম্মতি জানায় বাবুর কথায়। ওরা মদ খাওয়া শুরু করে, সাথে কাবাব আর চানাচুর। বিদেশী মাল পেয়ে হিরন টপা টপ ৩/৪ পেগ র মেরে দেয়। বাবু আরেকটা পেগ নিয়ে ধীরে সুস্থে খেতে থাকে রিল্যাক্সলি। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে হিরনের কথা জড়িয়ে যায় কারণ ইতিমধ্যে আরও ৩ পেগ খাওয়া হয়ে গিয়েছিলো ওর। বাবুর সাথে আসা কাল্লু ও ইকবাল খুব বেশী একটা খাওয়ার সুযোগ পায় নাই যেহেতু বড়রা খাচ্ছে এর মধ্যে এক ধরনের বেয়াদবি হয় বেশী বেশী মারলে। বাবুও মোটেই খেতে পারছে না আজ, ওর কি একটা টেনশন ওকে প্রচণ্ড রকম স্ট্রেসের মধ্যে রেখেছে। ও শুধু একটু পর পর একটা করে সিগারেট জালাচ্ছে আর টানছে পাগলের মতো। কাল্লু ইকবালের মুখেও কোন কথা নাই, চুপচাপ বসে আছে দূরে। আজ কথা এগোচ্ছে না যেহেতু হিরন অনেক বেশী খেয়ে ফেলেছে এবং অসংলগ্ন কথাবার্তা বলা শুরু করেছে।

চলবে