রংবাজ

উপন্যাস ১৩

আশিকুজ্জামান টুলু

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১৮

রাত প্রায় দুটো ছুঁই ছুঁই। পুষ্পবালা দেবী বুড়ো মানুষ, এত রাত জাগতে পারে না। কাস্টমার রাত ১২টার পরে আর অ্যালাও করে না। কিন্তু বাবু-হিরনের ব্যাপারটা ভিন্ন, আজ ওদের কারণেই নিশ্চিন্তে ব্যবসা করে দুপয়সা রোজগার করছে সে। সেকারণেই ওদের কোনো টাইম নাই। যতক্ষণ ইচ্ছা থাকতে পারে ওরা। সাধারণত বাবুরা এলে রাত ১টার পর পুষ্পবালা দেবী আরও কিছু মাল ওদের ঘরে যোগান দিয়ে ওনার নিজের ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। আজও তাই হয়েছে, পুষ্পবালা ঘুমিয়ে পড়েছে নতুন দুইটা মাল দিয়ে। ইতিমধ্যে হিরন এতই খেয়ে ফেলেছে যে, সে রীতিমতো বেহুঁশ হয়ে বিছানায় এলিয়ে পড়েছে। বাবু দরদর করে ঘামছে। কাল্লু আর ইকবাল পাথরের মতো শক্ত হয়ে বসে আছে পাশাপাশি দুটো চেয়ারে। কারো মুখে কথা নাই। চোখ স্থির হয়ে আছে বাবুর দিকে। ঘরটা খুব বেশি বড় না। অনেক পুরানো দিনের জানালা, মেঝের এক ফিট উপর শুরু হয়ে বেশ ফিট ছয়েক গিয়ে শেষ হয়েছে। বাড়ির ছাদ প্রায় ১৪/১৫ ফিট ওপরে। পুরানো দিনের ছাদগুলি বেশ ওপরে হতো। জানালার উপর ও নিচের অংশটুকু দুইভাগে ভাগ করা মাঝখানে একটা কাঠের রেলিং দিয়ে। মোটা মোটা শিক দেয়া ঐ রেলিং ভেদ করে। ছাদ থেকে লম্বা তারে ঝুলে আছে কম পাওয়ারের বাল্ব। মদ খাওয়ার সময় সবাই একটু আলো-আঁধারিতে খেতে পছন্দ করে বলে কম পাওয়ারের বাল্ব লাগানো। বাবু কাল্লুকে ইশারা দেয় জানালাগুলো বন্ধ করতে। কাল্লু বিদ্যুৎ গতিতে উঠে জানালাগুলো বন্ধ করে দেয়। বাবুর স্থির দৃষ্টি গিয়ে পড়ে ইকবালের দিকে। ইকবাল দাঁড়িয়ে যায়, হাতদুটো মৃদু কাঁপছে ওর। সার্টটা উঠিয়ে কোমর থেকে বের করে আনে একটা লোডেড রিভলভার। কাল্লু দ্রুত গতিতে হিরনের কাছে গিয়ে হিরণকে জাগানোর চেষ্টা করে বেশ জোরে জোরে ধাক্কা দিয়ে, কিন্তু হিরন একেবারেই বেহুঁশ হয়ে পড়ায় কোনো নড়াচড়া বা সাড়াশব্দ করে না। এবার কাল্লু একটা বালিশ নিয়ে দ্রুততার সাথে হিরনের মুখে চেপে ধরে। বাবু বলে ওঠে, ওয় খাড়া, আমারে বাইরে যাইতে দে।

এই বলেই বাবু মুহূর্তের মধ্যে দরজা খুলে বাইরে এসে ঘরের সাথে সরু বারান্দায় দাড়ায় এবং চারিদিকে তাকিয়ে দেখতে চেষ্টা করে কেউ কি জেগে আছে কিনা সারা বাড়িতে। নাহ, কেউ জেগে নাই, অনেকদুরে কোথায় যেন মাইকে ওয়াজ মহফিল চলছে। রাস্তার লাইটপোস্টের টিমটিমে কম পাওয়ারের আলোকে ঘিরে হাজার হাজার পোকার প্রলয় নাচন আর জনশূন্য শাঁখারি বাজারের রাস্তা রাতটাকে অনেক রহস্যময় করে তুলেছে। একটা রিক্সাও নাই রাস্তায়। বাড়ির সামনের ড্রেনটা ঘেসে বাবুর বাইক ও কাল্লুদের বাইক দুটো দাঁড় করানো। বাবু মৃদু কাঁপছে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে খুব চাপা কয়েকটা গুলির আওয়াজ হলো ঘরের ভিতর থেকে। পরিষ্কার বোঝা গেলো যে সাইলেন্সার ব্যবহার করা হয়েছে। বাবুর কাছে মনে হলো ওর মাথার ভিতরের একটা রগ কেউ টেনে ছিঁড়ে ফেললো। ভীষণ গা গুলিয়ে বমি এলো কেন যেন। হন্তদন্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো কাল্লু ও ইকবাল। ওদের সার্টে রক্ত, থর থর করে কাঁপছে ওরা। বাবু জিজ্ঞাসা করলো, কি? শেষ?
ইকবাল: হ, শেষ।

বাবু বিদ্যুৎ গতিতে ঘরে ঢুকে এবং হিরনের বিছানায় পড়ে থাকা দেহটার দিকে যায়। সারা বিছানায় রক্তের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। হিরনের মাথাটা ক্ষতবিক্ষত। মাথার পাশে পড়ে আছে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া বালিশ। বোঝা যাচ্ছে যে একেবারে জিরো রেঞ্জে মাথায় বালিশ চেপে ধরে গুলি করা হয়েহে যাতে শব্দও কম হয়। বাবু আর পারে না, ধপ করে মাটিতে বসে পড়ে এবং ভক করে বমি করে দেয় মেঝেতে। কাল্লু আর ইকবাল দৌড়ে আসে, বাবুকে ধরে ওঠায় এবং বলে, ভাই চলেন, আর দেরি করন যাইবো না। অসুবিধা হইয়া যাইবো।

ওরা তিনজন মুহূর্তের মধ্যে ঘর থেকে বেরিয়ে নিচে নেমে আসে। গলি থেকে বেরিয়ে চটপট বাইক দুটো স্টার্ট দেয় এবং দুটো বাইক দুদিকে চলে যায়। তাঁতিবাজার ও শাঁখারি বাজারের মোড়ের কাছে একটা কুকুর মরা কান্না কেদে ওঠে। কুকুরের রাতের কান্না খুব অলক্ষণে বলে শোনা যায়। বাবুর মাথায় ওসব কিছুই নাই, ও প্রচণ্ড গতিতে মোড় পেরিয়ে ইসলামপুরে উঠে বাঁয়ে মোড় নেয় এবং সদরঘাটের দিকে চলে যায়। ইসলামপুর রোডটা একেবারে ফাঁকা, সদরঘাটের কাছে ৩ জন টহল পুলিশকে একটা দোকানের রকে বসে ঝিমাতে দেখা যায়। ঐ রকের আরেক পাশে ঘুমিয়ে আছে আরও গোটা তিনেক খেটে খাওয়া ঘরবাড়ি বিহীন ভেসে বেড়ানো ক্লান্ত মানুষ। বাবুর বাইকের আওয়াজে কেউ জেগে ওঠে না, ভীষণ ক্লান্ত ওরা ঠিক বাবুর মতো। বাবু মনে মনে অনেক ক্লান্ত। আজকের ঘটনাটা ওর জীবনের সবচাইতে আশ্চর্য রকমের ঘটনা, যেটা কোনোদিন ও স্বপ্নেও দেখেনি। নিজেকে ভাবতে গিয়ে বাবুর কাছে খুব ঘেন্না লাগে, মনে হয় ও একটা নরকের কীট। মা’র চেহারাটা মনে পড়ে যায়, মনে পড়ে যায় ওর ছোটবেলা এবং তারপর বড় হয়ে ওঠা, প্রাণপ্রিয় বন্ধুরা। কোথায় যেন সবকিছু হারিয়ে গিয়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল ওর জীবনটা। ও চায় নাই এ জীবন, কোনদিনও চায় নাই। ও দ্রুতগতিতে বাইক চালিয়ে ভিক্টোরিয়া পার্ককে ডানে রেখে জনসন রোড হয়ে কোর্টের সামনে দিয়ে নওয়াবপুর রোডের দিকে যেতে থাকে। রথখোলা, বিসিসি রোড পার হয়ে কাপ্তান বাজারের কাছে এসে ও ডানে ঘুরে মোড়ের কাছে দাঁড়ায়। ওখানে আগে থেকেই ওর জন্য অপেক্ষা করছিলো একটা লাল রঙের ফিয়াট গাড়ি। বাইকটা ও রাস্তায় পার্ক করে গাড়িতে চেপে বসে। ড্রাইভার কিছু বলে না, গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দেয়। সবকিছু পূর্বপরিকল্পিত বিধায় সিকোয়েন্স অনুযায়ী একে একে সময়মত ঘটতে থাকে। একমাত্র গোপাল এবং বাবু ছাড়া আর কেউ জানে না ওর গন্তব্য। খুব খারাপ লাগে, আসার আগে মা’কে বলে আসতে পারেনি ও। আবার কবে দেখা হবে তা সে জানে না।

এবারের কাজটাই ছিলো হিরণকে ফেলে দেয়া। হিরন একেবারেই বুঝতে পারে নাই বিষয়টা। হিরন ও হিরনের গডফাদার নাদির ও জামশেদের সাথে গোপালের চলে আসছে বহুদিনের নীরব শত্রুতা ইসলামপুর, শাখারি বাজার ও তাতিবাজারের সোনার দোকানের টোল নিয়ে। এই শত্রুতার শেষ জের গিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পর্যন্ত ঠেকেছে যেহেতু মাসিক এই বিশাল অঙ্কের টাকা বিলিবন্টনের ব্যাবস্থা পাড়ার একটা সাধারণ মাস্তানকে দিয়ে চালিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। গোপালের গড ফাদার সরকারি দলের ঊর্ব্বতন কর্মকর্তা অথচ হিরনের প্রচণ্ড প্রভাবের কারণে গোপাল বাহিনী কিছুতেই কিছু করতে পারছিলো না ইসলামপুর বেল্টটায়। যখন মার্কেটে বাবু চলে এলো গোপালের ডান হাত হিসাবে তখন গোপাল সবচাইতে সাধারণ সলিউশন বেছে নেয় এবং সেটা ছিলো হিরণকে গুটিবাজি করা। গোপাল এর মধ্যে খেয়াল করেছে বাবুর সাথে হিরনের সখ্য, ওটাকেই সে কাজে লাগানোর স্বপ্নে থাকে এবং শেষ আশ্রয় এই গুটিবাজি। গুটিবাজি বিষয়টা পুরানো ঢাকার বেশ পুরানো একটা রীতি যা এই ধরনের গদফাদারদের মধ্যে চলে আসছে। ভিকটিম কিছুতেই বুঝতে পারে না যে ওকেই অক্কা পেতে হবে এবং এমন একজনের হাতে অক্কাটা পেতে হবে যে ভিকটিমের স্বপ্নেও তাকে সন্দেহ হবে না। তবে গুটিবাজির সবচাইতে খারাপ দিক হচ্ছে, যাকে দিয়ে কাজটা করানো হয় তাকেই কাজ শেষে ফেলে দেয়া হয়। বাবুর ক্ষেত্রে গোপাল একটু দয়া করেছে ওকে দেশের বাইরে চলে যাওয়ার সুযোগ দিয়ে। গোপাল এও জানে যে, বাবুর হয়তোবা আর ফেরা হবে না কোনদিন।

এক সপ্তাহ পরের ঘটনা, রবিবার। বাবুর বড় ভাই সকাল বেলা অলস ভঙ্গীতে বসে পেপারে চোখ বুলাচ্ছেন। একটা খবরে এসে ওনার চোখ আঁটকে গেলো, উনি চিৎকার করে মা’কে ডাকলেন। বাবুর মা ছুটতে ছুটতে আসলেন। কাগজের খবরে চোখ বুলিয়ে উনি কান্নায় ভেঙে পড়লেন। এক সপ্তাহ ধরে বাবুর কোন খোঁজ খবর নাই, বাসায় তিন চারবার পুলিশ এসেছে। চারদিকে বিভিন্ন কানাঘুষা শোনা যাচ্ছে, বাবু নাকি আরেকটা মার্ডার করেছে শাখারি বাজারে। খবরের কাগজে খবরটা দেখে বাবুর মা শুধু কাঁদতে থাকেন আর চিৎকার করে বলেন, হায়রে বাবু, তুই এইটা কি করলি? তুই তো বেঁচে গিয়েছিলিরে বাবু, তুইতো সব শেষ করে দিলিরে বাবু...

দৈনিক বাংলার প্রথম পাতায় বড় বড় হরফে পুরোন ঢাকার দুজন বড় গুণ্ডা নাদির এবং জামসেদ সম্পর্কে খবর বেরিয়েছে। ওরা পুরনো কেসে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর আদালতে ওদের করা সব কয়টা মার্ডারের কথা স্বীকার করেছে। এই স্বীকারোক্তির মধ্যে বনগ্রামের কিসমত হত্যার দায়ভারও ওরা নিয়েছে। ওদের স্বীকারোক্তিতে ওরা বলেছে যে, বনগ্রামের হত্যাকাণ্ড একটি পরিকল্পিত হত্যা এবং ওরা এই হত্যা নেহায়েত পয়সার বিনিময়ে হিটম্যান হিসাবে করেছে, ব্যাক্তিগতভাবে ওদের সাথে কিসমতের পরিচয় বা শত্রুতা ছিল না। একারণে কিসমত হত্যায় বিচারাধীন প্রধান আসামী বাবুসহ আরও কয়েকজনেকে নির্দোষ সাব্যস্ত করে মামলা থেকে বেকসুর খালাস করে দেয়া হয়েছে।

চলবে