রংবাজ

শেষ পর্ব

আশিকুজ্জামান টুলু

প্রকাশিত : অক্টোবর ০১, ২০১৮

দুইমাস পরের কথা। ১৩৬ নম্বর বনগ্রাম রোড সেজেছে নতুন সাজে। সারা বাড়ি মরিচ বাতি দিয়ে সাজানো হয়েছে। বিয়ের বিশাল একটা গেট করা হয়েছে। সারাবারিতে আনন্দের বন্যাধারা বয়ে চলছে। মাইকে জোরে জোরে বাজছে, আজা তুঝকো পুকারে মেরে গিত, ও মেরে মিতোয়া...

শাফিনাকে খুব সুন্দর লাগছে। অনেক বছর পর সাফিনা আবার বউ সেজেছে। জ্বলজ্বল করছে ওর রূপ আর বাঁধভাঙা যৌবন। চোখ সরানো দায়। একটু পরেই চলে আসবে বরযাত্রী, বাচ্চারা সবাই এসে গেটের ভিতরে কাঁচি আর ফিতা নিয়ে দাঁড়িয়ে। ওরা গেট ধরে পয়সা নেবে। মিনিট বিশেক পরে চলে এলো বরযাত্রী। চারদিকে হইচই আর পটকা ফুটানোর আওয়াজ। গাড়ি এসে গেটের সামনে থামা মাত্র এগিয়ে গিয়ে সবাই বরের গাড়ির দরজা খুলে দিলো। বরকে ধরে ধরে নামানো হলো গাড়ি থেকে। লজ্জায় বর মাথা নিচু করে রেখেছে। মনে মনে বর খুব খুশি, আগে মেয়ের বিয়ে ছিল তাতে কি, এরকম সুন্দরী তন্বী কয়জন মানুষের ভাগ্যে জোটে!

বর গাড়ি থেকে নেমে গেটের কাছে আসে এবং মাথা উঁচু করে দেখতে যায় কারা গেট ধরেছে। মাথা উঁচু করায় ওর চেহারাটা দেখা যায়, বর সেই চিরচেনা তিনতলার ভাড়াটিয়া শফিক। শফিকের খুব ভালো লাগতো শাফিনাকে, আজ সেই ভালোলাগার শর্তটা পূরণ  হলো। আর শফিককে পথ চেয়ে থাকতে হবে না শাফিনার, ওর নিজের সাম্রাজ্যে শাফিনা রানি হয়ে বসবে। আর ভাড়া দিতে হবে না শফিককে, এখন ও বাড়িঅলার মেয়ের জামাই, রাজকন্যা ও অর্ধেক রাজ্য এখন ওর এবং দুইদিন পর বাড়িঅলি অক্কা পেলে পুরো সাম্রাজ্য শফিকের। কী বিজয় উল্লাস, কী আনন্দ!

অনেকগুলো বছর কেটে গিয়েছে। বনগ্রাম আর সেই আগের বনগ্রাম নাই, হারিয়ে ফেলেছে তার ঐতিহ্য, তার সৌন্দর্য। অনেক নতুন ঘর ভাড়াটিয়া এসেছে। নতুন রূপে সেজেছে বনগ্রাম, নতুন নতুন দালানের বাহার। আগের সেই সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক কারো সাথে কারো নাই। সবাই ব্যাস্ত সবার নিজের জীবন নিয়ে। ১৩৬ নম্বর বনগ্রামের আগের জৌলুস আর নাই। রং চটে ইট খুলে খুলে পড়ছে ক্রমশই। পুরনো হয়ে গিয়েছে আস্তর, অযত্নে ইমারতটা ভুলে গিয়েছে তার আগের চেহারা। বাবুদের পরিবার ঐ বাসা ছেড়ে কোথায় চলে গিয়েছে, কেউ জানে না। বাড়িঅলি মারা গিয়েছে বেশ আগে। এখন ভগ্নপ্রায় সম্পূর্ণ সাম্রাজ্জের মালিক হয়েছে শফিক। অনেক বয়স হয়েছে শফিকের, সাফিনারও সেই সৌন্দর্য শুধুই ইতিহাস। শফিক-সাফিনা দুজনে দুজনার সাথে সেরকম কোনো বাক্যবিনিময় আর করে না, কেউ কারো দিকে এক নজর তাকায় না। কত বছর দুজনের দৃষ্টি বিনিময় হয় নাই, তা ওদেরও মনে নেই! মনে করেই বা কী হবে, এখনতো শুধু অপেক্ষা লাস্ট পিরিওডের ঘণ্টাটা বাজার। ওদের মনের ভিতরটা অনেক আগেই মরে গিয়েছে এখন শুধু শরীরটা অপেক্ষা করছে হিমশীতলের সাথে মিলনের জন্য। শফিক সাফিনার বিয়ের পরেই কিসমতের মৃত্যুটা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। সবাই কেমন যেন চুপ হয়ে যায় এ বিষয়টা নিয়ে, কেউ আর কিছু বলেনা, শুধু মনে মনে আওড়ায় কিসমতের নাম। এ বিষয়ে সাফিনা শফিকের এখন আর কথা হয় না। কিসমতের মৃত্যুর পর থেকে আজ অবধি আর কোনদিনও ওরা এ বিষয়ে কথা তোলেনি কিংবা কথা ওঠেনি, হয়তো ভয়ে, নয়তো সংকোচে অথবা অনুশোচনায়।

বনগ্রামে দিন আসে দিন যায়, রাত আসে রাত যায়, আসে না শুধু বাবু নামের ছোট্ট দুষ্টু ব্রিলিয়েন্ট ছেলেটা। বনগ্রামে বেড়ে ওঠা বাবু এখন কোনো এক দূর নক্ষত্রের ছায়াপথ ছাড়া আর কিছুই না। ওর চলে বেড়ানো পথ, ওর বলে বেড়ানো কথাগুলি বহু আগেই হারিয়ে গিয়েছে বনগ্রাম রোডের ধুলোবালিতে। কেউ মনে রাখেনি ওকে, ওর বন্ধুদেরকে, ওদের উচ্ছ্বলতাকে, ওদের উন্মাদনাকে।

এইতো জীবন, একভাবে আসে আর আরেকভাবে যায়। বাবু সম্বন্ধে খুব বেশি আর জানা যায় নাই। প্রথম শোনা গিয়েছিল, ও ব্যাংকক চলে গিয়েছিল, পরে খবর পাওয়া যায় যে, ওকে ঢাকার এক বন্ধু ম্যানিলাতে দেখেছে এবং সেখাকার বড় একটা মাফিয়া গ্যাং এর সদস্য ও। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত জানা গিয়েছে, বাবু আর বেঁচে নেই, ফিলিপিনো কোনো এক গ্যাং ফাইটে তার মৃত্যু হয়েছে এবং লাশ খুঁজে পাওয়া যায় নাই। এরপর আর কেউ কোনো খবর নেয় নাই বাবুর। কারণ প্রয়োজনতো অনেক আগেই ফুরিয়ে গিয়েছে।