সস্ত্রীক রশীদ করীম ও শামসুর রাহমান

সস্ত্রীক রশীদ করীম ও শামসুর রাহমান

রশীদ করীম একজন বড় মাপের লেখক

স্মরণ

শামসুর রাহমান

প্রকাশিত : নভেম্বর ২৫, ২০১৮

কথাসাহিত্যিক রশীদ করীমের সপ্তম মৃত্যুদিন আগামীকাল। ২০১১ সালের ২৬ নভেম্বর তিনি মারা যান। বাংলাদেশের কথাসাহিত্য যেসব লেখকের হাতে পূর্ণতা পেয়েছে, রশীদ করীম তাদের একজন। মুসলমান মধ্যবিত্ত সমাজের অন্তরমহলের গল্প তিনি সাবলিল ভঙ্গিমায় এঁকেছেন তার সাহিত্যে। রশীদ করীমকে নিয়ে চমৎকার একটি গদ্য লিখেছিলেন বাংলাদেশের প্রধান কবি শামসুর রাহমান। গদ্যটি প্রকাশের মাধ্যমে ছাড়পত্র স্মরণ করছে রশীদ করীমকে।  

জীবন যেন এক তেজী ঘোড়ার মতো ছুটে চলেছে। চোখের পলক পড়তে না পড়তেই দেখছি, আমার নিজের জীবন ঝুঁকে পড়েছে গোধূলির দিকে। ছেলেবেলা, কৈশোর, যৌবন— কিছুই নেই আর। কিছুই কি নেই? আছে কিছু স্মৃতি, কিন্তু স্মৃতিও ক্রমান্বয়ে ধূসর হয়ে আসছে। আগেকার সেই উদ্যম-উদ্দীপনা, এখন যেন বেতো ঘোড়ার মতো ঝিমুচ্ছে কিংবা ধুঁকছে। আগে হরহামেশা রিকশায় সৈয়দ আওলাদ হোসেন লেন থেকে এসে ধানমন্ডিতে রশীদ করীমের বাসায় কলিং বেল টিপতাম কিংবা ভরদুপুরে হাজির হতাম তাঁর কাছে ক্যালট্যাক্স অফিসে। না যেতে পারলে মনের ভেতর কেমন অস্থিরতা বোধ করতাম। তিনিও আমার ডেরায় আসতেন মাঝে মাঝে। গোড়ার দিকে রিকশায়, পরবর্তীকালে যখন ক্যালট্যাক্স তেল কোম্পানির বড় কর্তা হলেন তখন আসতেন মোটরকার হাঁকিয়ে। তবে মেজাজে ছিল না বড় কর্তামির কোনো ঢং, যদিও কালেভদ্রে তাঁর মেজাজের হাল্কা তাপ আগেও কিছু ভোগ করেছিলাম এবং এখনো করি। মিথ্যা উচ্চারণ করব না, রশীদ করীমের চরিত্রের যে ঔদার্য এবং মাধুর্য আমি নিয়মিত উপভোগ করেছি সুখাদ্যের সঙ্গে তা’ খুব সহজলভ্য নয়।

আমার পরম সৌভাগ্য, আমি রশীদ করীমের মতো একজন বন্ধু পেয়েছি। তিনি আমার চার পাঁচজন অকৃত্রিম বন্ধুদের একজন। দু’জন বন্ধু হাসান হাফিজুর রহমান এবং তরিকুল আলমকে আগেই হারিয়েছি। কোন কোন বন্ধুর কপটতা আমাকে মর্মাহত করেছে। কপট বন্ধুর চেয়ে শত্রুকে বরং মেনে নেওয়া যায়। কারণ তার শত্রুতা বিষয়ে আমি সচেতন, তার আচরণ আমাকে আহত করে না। যারা আমারর প্রাণ হরণ করতে চায় আমাকে পুরোপুরি না জেনেই, তাদের কথা এখানে টেনে আনার প্রয়োজন বোধ করি না।

বন্ধু রশীদ করীমকে আমি প্রথমে দেখি প্রায় সাড়ে চার দশক আগে, যখন আমি কাব্যলক্ষ্মীর সঙ্গে প্রেমের আদিপর্বে বেদম হাবুডুবু খাচ্ছি, যখন আমি একজন অবিবেচক, অপরিণামদর্শী যৌবনের জ্বলজ্বলে প্রান্তরে পা রাখা এক তরুণ। মনে মনে সারাক্ষণ কবিতার নানা পঙক্তি আওড়াচ্ছি, ভেসে বেড়াচ্ছি মেঘে মেঘে, নিজের অলিখিত কবিতার কোন পঙক্তি কিংবা পঙক্তির টুকরো গুণগুণিয়ে চলেছে সবার অলক্ষ্যে। রশীদ করীমের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা কবি আবুল হোসেনের আজিমপুর কলোনির সরকারি ফ্ল্যাটে। ফ্ল্যাটটি যতদূর মনে পড়ছে, একতলা ছিল। কলিং বেল টিপে ভেতরে প্রবেশাধিকার পেয়ে ঢোকার পরই চোখে পড়ল একজন সুদর্শন যুবক, যিনি আমার চেয়ে চার-পাঁচ বছরের বড়, সাবানের ফেনাশোভিত গন্ডদেশে সেফটি রেজার চালাচ্ছেন আক্রমণের চালে। বেশ মজা লাগল। আবুল হোসেন পরিচয় করিয়ে দিলেন আমাদের। জানতে পারলাম, তিনিই রশীদ করীম। লেখক এবং একটি তেল কোম্পানিতে কর্মরত।

এখানে একটি মজার ঘটনার কথা উল্লেখ করতে চাই। রশীদ করীমের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার আগে আমি অল্প স্বল্প নামে একটি গল্প পড়েছিলাম হয় মোহাম্মদী নয় তো সওগাত-এর কোনো একটি সংখ্যায়। গল্পটি পড়ে আমি আমার ক্লাসফ্রেন্ড সাবের রেজা করিমকে তারিফ করেছিলাম। ভেবেছিলাম, সেই গল্প ওরই লেখা। সাবের রেজা করিম, যে পরে সিএসপি হয়ে একজন দক্ষ, কৃতী সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে দেশ ও জাতির সেবা করেছে সর্বান্তকরণে। সাবের রেজা আমার ভুল শুধরে দিয়ে বলল, ‘গল্পটি আমার লেখা নয়, প্রকৃত লেখকের নাম রশীদ করীম।’ যা হোক, গল্পটি সেকালে কেন আমার ভাল লেগেছিল, এখন আর মনে নেই। তবে রশীদ করীম এখন গল্পটিকে খারিজ করতেই ব্যস্ত হয়ে উঠবেন, মনে করি। কারণ সেকালেই অল্প স্বল্প গল্পকে বাজে গল্প বলে নাকচ করে দিয়েছিলেন। সেই গল্পের কথা থাক। আবুল হোসেনের আজিমপুরের ফ্ল্যাটে সেদিন রশীদ করীম আমার সঙ্গে অল্প স্বল্প গল্প করাতো দুরের বিষয়, একটি কী দু’টি বাক্য মাত্র খরচ করেছিলেন, যদিও কার্পণ্য তাঁর স্বাভাবে নেই। আমি নিজে অত্যন্ত স্বল্পভাষী, ইচ্ছে করে নয়, বাকপটু নয় বলেই। কারো সঙ্গেই বেশি কথা বলতে পারি না, এমনকি ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সঙ্গেও নয়। কেমন এক ধরনের আড়ষ্টতা, জড়তা আমাকে দখল করে ফেলে। কিন্তু যিনি ভালো কথা বলতে পারেন, যেমন রশীদ করীম এবং আরো কেউ কেউ। তাঁদের কথা শুনতে পছন্দ করি, রীতিমতো কান পেতে রাখি।

কালক্রমে রশীদ করীমের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়েছে। অল্প স্বল্প গল্পটির পরিণতি যাই হোক, এখন তিনি বাংলা সাহিত্যের একজন শীর্ষস্থানীয় কথাশিল্পী। তারুণ্যের প্রথম প্রহরেই তিনি উৎকৃষ্ট ছোটগল্প লিখে বুদ্ধদেব বসু, আবু সায়ীদ আইয়ুব এবং সঞ্জয় ভট্টাচার্যের মতো প্রথম সারির লেখকদের দৃষ্টি কেড়েছিলেন। তাঁরা মুগ্ধ হন রশীদ করীমের গল্প পড়ে। এই ঘটনার ক’দিন পরে উৎসাহিত উদ্দীপিত তরুণ লেখকটির আরও একটি কি দু’টি লেখা পড়ে আবু সয়ীদ আইয়ুব তাঁর বিরক্তি মিশ্রিত অপছন্দের কথা জানালেন লেখককে। আবু সয়ীদ আইয়ুবের সাহিত্যিক মতামতের প্রতি আরো অনেকেরই মতো রশীদ করীমের গভীর শ্রদ্ধা ছিল। আইয়ুবের মৌখিক সমালোচনা শুনে তরুণ লেখক লেখাই বন্ধ করে দিলেন। এরপর যতদিন তিনি কলকাতাবাসী ছিলেন ততদিন তাঁর কলম থেকে আর কোনো সৃজনশীল রচনাই নিঃসৃত হয়নি। আইয়ুবের সমালোচনা তাঁকে সাময়িকভাবে হতোদ্যাম করেছিল ঠিকই, কিন্তু তিনি সেই অসামান্য বুদ্ধিদীপ্ত চিন্তাবিদ, প্রাবন্ধিক এবং রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞের প্রতি অনুরাগ কিংবা শ্রদ্ধা হারাননি।

আইয়ুবের সেকালের সমালোচনাকে মিথ্যা প্রমাণ করে রশীদ করীম আজ বাংলা সাহিত্যে তাঁর আসনটি পাকা করে ফেলেছেন। এ জন্যে তিনি ঢের শ্রম স্বীকার করেছেন, কয়েকটি অসামান্য উপন্যাস লিখতে হয়েছে তাঁকে, নির্মাণ করতে হয়েছে আশ্চর্য সুন্দর গদ্যশৈলী। উত্তম পুরুষ তাঁর প্রথম উপন্যাস। তারপর একে একে তিনি লিখেছেন প্রসন্ন পাষাণ, আমার যত গ্লানি, প্রেম একটি লাল গোলাপ, সাধারণ লোকের কাহিনী, একালের রূপকথা, সোনার পাথরবাটি, বড়ই নিঃসঙ্গ, মায়ের কাছে যাচ্ছি, চিনি না, পদতলে রক্ত এবং লাঞ্চবক্স-এর মতো উপন্যাস।

উত্তম পুরুষ এবং প্রসন্ন পাষাণ প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশিষ্ট লেখক ও সমালোচকগণ ঔপন্যাসিক রশীদ করীমের দিলখোলা তারিফ করেছেন। কিন্তু আমার যত গ্লানি প্রকাশিত হওয়ার পরেই রশীদ করীমের সৃজনশীলতা নতুন বাঁক নিল। তিনি মধ্যবিত্ত মুসলিম সমাজ ও মানসের অসাধারণ রূপকার তো বটেই, তাঁর রচনারীতি তাঁকে বিশিষ্টদের মধ্যেও অধিক বিশিষ্ট করে তোলে। এরপর থেকে তিনি আর ফিরে তাকাননি, এগিয়ে গেছেন ক্রমাগত। আমার সমান্য মতে, আমার যত গ্লানি, বড়ই নিঃসঙ্গ এবং মায়ের কাছে যাচ্ছি-র মতো উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে বিরল। এ জন্যই অন্নদাশঙ্করের মতো প্রবীণ এবং প্রধান কথাশিল্পী, সমরেশ বসুর মতো প্রতিভাবান ঔপন্যাসিক, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো অসাধারণ সব্যসাচী লেখক রশীদ করীমের উপন্যাসের প্রচুর কদর করেছেন। আমার মনে পড়ছে, আনন্দবাজার পত্রিকায় একটি লেখায় খ্যাতিমান কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় আমার যত গ্লানিকে বছরের সেরা বাংলা উপন্যাস বলেছিলেন।

আমার বিশ্বাস, সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে কথাশিল্পী রশীদ করীমের খ্যাতির সীমানা প্রসারিত হতে থাকবে। সানন্দে বলছি, তিনি বর্তমানে নতুন লেখকদের মধ্যে সাড়া জাগিয়েছেন। অনেকেই তাঁর বইয়ের খোঁজ নিচ্ছেন, তার সম্পর্কে গবেষণা করছেন। তিনি শুধু শীর্ষস্থানীয় ঔপন্যাসিকই নন, উঁচু মানের ছোটগল্প রচয়িতা এবং প্রাবন্ধিক। সাহিত্য ও সমাজ বিষয়ে তাঁর মতামত অনেকের দৃষ্টি তো আকর্ষণ করেইছে, অত্যন্ত মুগ্ধও করেছে। তাঁর গদ্য সুখাদ্যের মতো, খাদ্যরসিকের মতো বলতে ইচ্ছে হয়, ‘আরও চাই, আরও চাই।’ তিনি তাঁর  এখন পর্যন্ত শেষ গ্রন্থ জীবন-মরণ-এর অতি সংক্ষিপ্ত ভূমিকায় বলেছেন, ‘এই আমার শেষ লেখা। ইংরেজিতে যাকে বলে সোয়ান সঙ মরাল সঙ্গীত।’ আমরা জানি, তিনি অসুস্থ তবু এ ধরনের বাক্য আমরা তাঁর কাছ থেকে আশা করি না। তাঁর স্মৃতিশক্তি এবং মেধা আগের মতোই প্রখর।

দুই.
রশীদ করীম, আমাদের অন্যতম প্রধান ঔপন্যাসিক, একটি সাহিত্যিক পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠেছেন। বাংলাদেশের খ্যাতিমান অধ্যাপক এবং সাহিত্যিক আবু রুশদ তার অগ্রজ। আবু রুশদের ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল সে আমলের অনেক লেখকের সঙ্গে। শওকত ওসমান, আবুল হোসেন, আহসান হাবীব, ফররুখ আহমদ তো তাঁর বন্ধুই ছিলেন। ফলে তাঁদের সঙ্গে রশীদ করীমেরও দেখাশোনা হতো। রশীদ করীম আবু সয়ীদ আইয়ুবেরও সাহচর্য পেয়েছিলেন। আইয়ুব তরুণ সবেমাত্র লিখতে শুরু করা রশীদ করীমের কোনও কোনও গল্পের তারিফ করেছিলেন। এই তরুণ গল্পকারের একটি ছোটগল্প পড়ে বুদ্ধদেব বসু এবং সঞ্চয় ভট্টাচার্যও মুগ্ধ হন। সঞ্জয় ভট্টাচার্য তাঁর বিখ্যাত পত্রিকা পূর্বাশায় গল্প লেখার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তবে এ কথাও বলেছিলেন যে, গল্পটি তাঁর পছন্দ না হলে তা মুদ্রিত হবে না। সেই গল্প অবশ্যি ছাপা হয়েছিল পূর্বাশায়। বুদ্ধদেব বসু রশীদ করীমের যে গল্প পড়ে মুগ্ধ হন তার নাম একটি মেয়ের আত্মকাহিনী।

এই ঘটনা হল প্রাক-পাকিস্তান আমলে এবং ঘটনাস্থল কলকাতা। পাকিস্তান সৃষ্টি হওযার পর অনেক বাঙালি মুসলমান লেখক ঠাঁইনাড়া হয়ে পূর্ব বাংলায় চলে এলেন। এলেন না কাজী আবদুল ওদুদ, আবু সয়ীদ আইয়ুব, সৈয়দ মুজতবা আলী এবং গোলাম কুদ্দুসের মতো কেউ কেউ। ঢাকায় থিতু হয়ে বসার পর আবার চঞ্চল হয়ে ওঠে রশীদ করীমের লেখনী। তিনি এবার উপন্যাস রচনায় মনোনিবেশ করলেন। কবি এবং সাড়া-জাগানো সাহিত্য সম্পাদক সিকান্দার আবু জাফরের সমকাল পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে ছাপা হতে লাগল রশীদ করীম-এর প্রথম উপন্যাস। কয়েক কিস্তি প্রকাশিত হওয়ার পর উপন্যাসের মুদ্রণ-গতি রুদ্ধ হল লেখকের ঔদাসীন্য কিংবা অবহেলার জন্যে নয়, সম্পাদকের অনাগ্রহের জন্যে।

রশীদ করীমের প্রথম উপন্যাস উত্তম পুরুষ-এর ভগ্নাংশ সমকাল-এ ছাপা হওয়া সত্ত্বেও তিনি দমে যাননি। উপন্যাস শেষ করতে পেরেছিলেন আখেরে। কারণ, লেখকের আত্মবিশ্বাস ছিল জোরালো। উত্তম পুরুষ পুস্তকাকারে প্রকাশিত হওয়ার পর সেটি আদমজী পুরস্কার পায়। কবুল করছি, এই বই আমাকে বিশেষ আকর্ষণ করতে পারেনি, যদিও বুঝতে পেরেছিলাম লেখকের মধ্যে সৃজনশীলতার ঝলক বিদ্যমান। এটি স্পষ্টতর হলো তার দ্বিতীয় উপন্যাস প্রসন্ন পাষাণ প্রকাশিত হওয়ার পর। যিনি জাত লেখক, তিনি কিছুকাল লেখার জগৎ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখলেও আবার দেদীপ্যমান হয়ে উঠতে পারেন, হয়ে উঠতে পারেন সৃজন মুখর। তার প্রথম দু’টি উপন্যাসে রশীদ করীম, আমার বিবেচনায় কী রচনাশৈলীতে, কী চরিত্রচিত্রণে যথেষ্ট আধুনিকতার পরিচয় দিতে পারেনি। কিন্তু সুখের বিষয়, তাঁর তৃতীয় উপন্যাস আমার যত গ্লানি প্রকাশিত হওয়ার পর আমরা একজন নতুন রশীদ করীমকে পেলাম, যিনি উঁচুদরের একজন প্রকৃত আধুনিক কথাশিল্পী। বহু প্রশংসিত এই সাড়া-জাগানো উপন্যাস আমার যত গ্লানি-র পর তিনি একের পর এক বেশ কয়েকটি উপন্যাস লিখে গেছেন শ্রম ও নিষ্ঠার সঙ্গে। তার প্রতিটি উপন্যাসই উৎকৃষ্ট, কিন্তু বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো— আমার যত গ্লানি, প্রেম একটি লাল গোলাপ, সোনার পাথরবাটি, একটি সাধারণ লোকের কাহিনী, মায়ের কাছে যাচ্ছি, বড়ই নিঃসঙ্গ এবং চিনি না!

বড়ই নিঃসঙ্গ উপন্যাসের নায়ক যে কোনও রেজিমেন্টেড সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের একটি যন্ত্রণাকাতর, অত্যন্ত অনুভূতিশীল চরিত্র। রশীদ করীম তার নায়কের চরিত্রকে এমন দক্ষতা ও যথার্থতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন যে, লেখকের অসামান্যতা নির্ভুলভাবে প্রমাণিত হয়। ঔপন্যাসিক রশীদ করীমের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো তার সংযম। একজন সাধারণ লেখক যেখানে বিশ-পঁচিশ পৃষ্ঠা ব্যয় করেন সেখানে তিনি এক আধ পাতায় সূচারুভাবে কাজটি সারতে পারেন। সচেতন পাঠক-পাঠিকা এই সংযমের পরিচয় রশীদ করীমের প্রতিটি উপন্যাসে লক্ষ্য করবেন আশা করি। কখনও কখনও একটি কি দু’টি বাক্যে তিনি নায়ক কিংবা নায়িকা অথবা কোনও গৌণ চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তোলেন। এটা কম কৃতিত্বের কথা নয়। তার উপন্যাসের পরিসমাপ্তি কীভাবে ঘটবে, তা আগে ভাগে বল খুবই মুশকিল। তিনি তার প্রায় প্রতিটি উপন্যাসে একটি চমক দিয়ে শেষ করেন।

রশীদ করীম শুধু ছোটগল্প, উপন্যাসই লেখেননি, তিনি নানা ধরনের প্রবন্ধ লিখেছেন, সংবাদপত্রের জন্যে কলাম লিখেছেন, বিদেশি কবিতার অনুবাদ করেছেন। তিনি যা-ই লিখেছেন তা-ই প্রশংসিত হয়েছে। তার সাহিত্য-বিষয়ক প্রবন্ধগুলো পড়লে বোঝা যায়, তিনি একজন সমঝদার সমালোচক, কবি-সাহিত্যিকদের বিষয়ে তার মতামত অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যথার্থ এবং সুবিবেচনাপ্রসূত। তার তিনটি প্রবন্ধের বই প্রকাশিত হয়েছে— আর এক দৃষ্টিকোণ, অতীত হয় নূতন পুনরায় এবং মনের গহনে তোমার মূরতিখানি। অত্যন্ত সুখপাঠ্য। তিনি কয়েকটি বিদেশি কবিতার অনবদ্য অনুবাদ করেছেন বাংলা ভাষায়। তিনি কেন যে আরও বেশি অনুবাদ করলেন না ভেবে আফসোস হয়। পাঠক-পাঠিকা বঞ্চিত হয়েছেন।

তিনি যে রুচিবান এবং পরিশীলিত মনের অধিকারী, এটা তার যে কোনও লেখা পড়লেই মনে হয়। শারীরিক কারণে তিনি এখন আর লিখতে-পড়তে পারছেন না। গত কয়েক বছর ধরে পক্ষাঘাতগ্রস্ত। অচল তার ডান হাত-পা।

রশীদ করীম যদি লেখক হিসেবে জেদী প্রকৃতির হতেন তাহলে আমরা তার অসুস্থতা সত্ত্বেও অন্তত আরও দুই-তিনটি উপন্যাস, কয়েকটি ছোটগল্প এবং কিছু প্রবন্ধ পেতাম। কিন্তু তিনি, বলতে কষ্ট হচ্ছে আমার, হাল ছেড়ে দিয়েছেন। তার মন ও মস্তিষ্ক এখন অত্যন্ত সজাগ। অনেক কিছু ভাবতে পারেন এখনও, কথা প্রসঙ্গে কোনও কোনও বিষয়ের অবতারণাও করেন। অথচ বাঁ হাত চালিয়ে লেখালেখি করবেন, এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিস্পৃহ। অন্তত মাঝে-মাঝে তার নিজস্ব স্টাইলে একটি কি দু’টি ছোট প্রবন্ধ লিখতে তো পারেন, সেখানে ঝলসে উঠবে তার উইট আর হিউমার। তার চিন্তাশক্তি স্বচ্ছ এবং প্রখর, কিছুটা অগ্রসরও বটে, ভাষা তীক্ষ্ণ, নির্ভার এবং বাগ্মিসম্মত। এরকম গুণ যে লেখকের আছে, যিনি একজন বড় মাপের লেখক, তিনি সৃষ্টির খরায় সময় বইয়ে দেবেন, এই ভয়ঙ্কর সত্য আমাকে উৎপীড়িত, বেদনার্ত করে। রশীদ করীম আমার বিরল ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন। আমার প্রিয় লেখকদের অন্যতম তিনি। সেজন্যেই তার লিখতে না পারায় আমার মন মাঝে মাঝে খারাপ হয়ে যায়। এই মন খারাপের কথা তাকে বলাও যায় না।