রাতের জিটি রোড

তুষার চক্রবর্তী

প্রকাশিত : আগস্ট ০৩, ২০১৮

রাতের হাওড়ার জিটি রোড। তখন খুব বেশি হলে এগারোটা বাজে। কোলাহলের শব্দ না থাকলেও, রাস্তায় তখনও দু’একটা গাড়ি চলাচল করছে। রাতের নিশাচররাও তখনও বেরোতে শুরু করেনি।

ভবানী হাওড়া থেকে বকুলতলা যাওয়ার শেষ বাসটা মিস করেছে। এর আগেও ভবানী এর চেয়েও দেরিতে বাস পেয়েছে। হয়তো শনিবার বলেই, সব বাসগুলো আজ তাড়াতাড়ি গুটিয়ে নিয়েছে। কী আর করা যায়! ভবানী হাঁটতে শুরু করে দিয়েছে। গাড়ির আওয়াজ পেলেই ভবানী পেছন ফিরে দেখছে কোনো বাস আসছে কীনা।

মাসের আঠাশ তারিখ। পকেট প্রায় ফাঁকা। তাই আর ট্যাক্সি নেয়ার কথা ভবানীর মাথায় আসেনি। ভবানী একটা প্রিন্টিং হাউসে চাকরি করে সালকিয়াতে। বহু বছর ধরে চাকরি করছে। অফিসে তার মাইনেই সব চেয়ে বেশি। বারো হাজার টাকা। কিন্তু এই বারো হাজারে কী আর হয়! তাই সন্ধে ছ’টা থেকে রাত দশটা অন্য আর একটা জায়গায় পার্ট টাইমে কাজ করে। সেখান থেকে হাজার পাঁচেক টাকা পায়। কোনোক্রমে সংসার চলে। পৈত্রিক বাড়িটা নেহাত আছে! যদিও ভাগের। আরো অনেক শরিক আছে সেই বাড়িতে।

ভবানী তার বউ আর এক মেয়ে আর এক ছেলে নিয়ে সেই ভাগের বাড়িতে থাকে। মেয়ে হাওড়া গার্লস কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে আর ছেলে থানা মাকুয়া স্কুলে ক্লাস নাইনে পড়ে। অন্যদিন ভবানী অফিস থেকে বেরনোর সময় মেয়ে কাবেরীকে ফোন করে। আজ খেয়াল হয়নি যে, মোবাইলটার চার্জ শেষ হযে গেছে। ফলে অফিসে আর চার্জে বসাতে পারেনি।

ভবানী জানে আজ কাবেরী আর ওর মা চিন্তায় থাকবে বাড়ি না পৌঁছনো পর্যন্ত। গাড়ির অপেক্ষায় হাঁটতে হাঁটতে ভবানী ট্রাম ডিপোর মোড় কখন যে পেরিয়ে গেছে, তা খেয়াল ছিল না। সমতল রাস্তা হলেও রাতের অন্ধকারে পথ চলা। তাই ভবানীর চোখ নিচে রাস্তার ওপর। হঠাৎ একটা শব্দে ভবানী চমকে উঠলো। আওয়াজটা সামনের দিকে থেকেই এসেছিল। ডিবি কলেজের ঠিক আগে যেখানে সেকন্ড হাওড়ার ব্রিজটা শেষ হয়ে জিটি রোডের ওপর দিয়ে গেছে, ঠিক সেখানটায় একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। গাড়িটা সাদা রঙের, তার ফলেই ভবানী এত দূর থেকেও দেখতে পাচ্ছে। ভবানী চোখের ওপর জোর দিয়ে আরো ভালো করে তাকায়।

ভবানীর মনে হলো, গাড়িটা থেকে যেন কাউকে রাস্তায় ফেলে দিয়েছে। ওই ফেলে দেয়ার আওয়াজটাই ভবানী পেয়েছিল। ভবানী কিছু বোঝার আগেই গাড়িটা টার্ন নিয়ে ঘুরে প্রচণ্ড স্পিডে ভবানীর গা ঘেঁষে হাওড়ার দিকে চলে গেল। ভবানী দ্রুত পা চালাতে থাকে। ঘড়ির দিকে দেখে, পৌনে বারোটা। ব্রিজটার নিচে এসে অল্প আলোয় ভবানী চমকে উঠলো। একটা অল্প বয়েসের মেয়ে সম্পূর্ণ উলঙ্গ অবস্থায় পড়ে রয়েছে। তার চুরিদারটা শরীরের ওপর ফেলে দিয়ে গেছে। ভবানী প্রথমে পাস কাটিয়ে এগোতে চাইলো। কিন্তু পারলো না। সে পিছিয়ে এসে মেয়েটির কাছে দাঁড়ালো। দেখলো মেয়েটির জ্ঞান আছে। সে ভবানীকে দেখে কিছু বলতে চাইছে, কিন্তু পারছে না। ভবানী দিশেহারা হয়ে পড়ে। শুধু মেয়েটিকে বলে, মা একটু অপেক্ষা করো, আমি গাড়ি ডাকছি।

মিনিট দুয়েকের মধ্যেই বেতাইতলার দিক থেকে একটা ট্যাক্সি এলো। ভবানী হাত দেখিয়ে দাঁড় করালো। ড্রাইভার গাড়ি থেকে নেবে ভবানীর মুখে সব শুনে বললো, দাদা, তারাহুড়ো করবেন না। আগে পুলিশ ডাকি, তারপর হসপিটাল। ট্যাক্সির ড্রাইভার পুলিশকে ফোন করলো। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই পুলিশ ভ্যান এসে গেল। সঙ্গে মহিলা পুলিশ। পুলিশ এসে সব দেখে ভবানীকে জেরা করতে লাগলো। কী নাম, কোথায় থাকা হয়, কী করো, এত রাত্রে রাস্তায় কেন, ইত্যাদি ইত্যাদি। ভবানী পকেট থেকে ভোটার কার্ডের জেরক্স কপিটা দেখার পর, তা থেকে এড্রেস লিখে নিয়ে ভবানীকে ছেড়ে দিলো। ভবানী যতক্ষণ না মেয়েটিকে নিয়ে পুলিশের গাড়ি হাওড়া হসপিটালের দিকে রওনা হলো, ততক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। গাড়ি চলে যেতে ভবানী আবার হাঁটতে শুরু করলো।

ভবানী যখন বাড়ি পৌঁছল তখন রাত প্রায় দুটো। দূর থেকেই ভবানী দেখলো, তাদের সেই বড় বাড়িটার তাদের অংশের দুটো ঘর আর বারান্দায় লাইট জ্বলছে। গেটের কাছে পা রাখতেই মা, ছেলে আর মেয়ে গেটের কাছে এসে গেল। কাবেরীর মা উৎকণ্ঠার সাথে জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছিল, এত দেরি কেন? ভবানী কাবেরীর মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে, শেষে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলো, মেয়েটার বয়েস তোর মতোই ছিল।