Lover by Navnath Chobhe

Lover by Navnath Chobhe

রোকসানা

নাঈমুল হাসান হিমেল

প্রকাশিত : জুলাই ২৮, ২০১৮

জানলার পাশে বসে আছে রোকসানা। গম্ভীর চেহারায় হাতে কফির মগ নিয়ে চিন্তায় মগ্ন। কাঠঠোকরা বাসা বাঁধার উপযুক্ত জায়গা খুঁজে পেয়েছে হয়তো। এক তালে ঠুকে যাচ্ছে পুরানো চৌকাঠে। রোকসানা তাকিয়ে আছে। কালো চুল তার উড়ছে সূতোর মতো দিকবিদিক।

দূরের ছাদের দিকে চোখ পড়ে। শৈশব ভেসে ওঠে তার চোখে। গম্ভীর চোখ আরও গম্ভীর হয়। ছড়িয়ে পড়ে সমস্ত দেহাবয়বে। এই বাড়িটা তার কাছে নতুন। সবে কয়েক দিন হলো এসেছে এ বাড়িতে। তিনতলা বাড়ির পুরোটাই ফাঁকা। কেয়ারটেকার থাকতে দিয়েছে তাকে।

সুখের বিনিমনে থাকার জায়গা। রোকসানার চাই থাকার জন্য ছাদ আর কেয়ারটেকারের চাই লোভ নিবারণের বস্তু। নিজেকে জীবন্ত পুতুল বানিয়ে মাথার উপর ছাদ খুঁজে নিয়েছে রোকসানা। আদি বিনিময় প্রথার পুনর্জন্ম। এমন পুনর্জন্ম এ শহরে প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে।

স্নিগ্ধ নিবাস নামের এই বাড়িটি গলির শেষ মাথায়। বাড়িটি নিজেকে আড়াল করে রাখতে পছন্দ করে কিংবা যিনি বানিয়েছেন তিনি হয়তো আড়াল পছন্দ করতেন। বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়ালেও হুট করে কেউ বুঝতে পারবে না যে, ভেতরে এক সুবিশাল অট্টালিকা রয়েছে। মোটা ইটের দেয়াল দিয়ে ঢাকা বাড়ি।

গেট পেরুলেই নুড়ি বসানো রাস্তা। কেউ হাঁটলে মনে হয় নূপুর পরে কেউ আসছে। রোকসানা মাঝে মাঝে হাঁটতে আসে এই পথে। নিজেকে এক বিত্তশালী রাজকন্যা হয়ে হয় তার। বন্দি রাজকন্যা। নুড়ি পথ পেরুলেই গাড়ি বারান্দা জলহস্তির পায়ের ছাপ বসানো পুরো বারান্দা। রোকসানা হাঁতে হাঁটতে বাড়ির পেছন দিকে চলে আসে। চোখ মেলে সে সব কিছু দেখে, কিন্ত দৃষ্টি তার কিছুই ছুঁয়ে দেখে না।

সাদা শুভ্র কয়েকটা বকফুল হাতে তুলে নেয় সে। ফুলগুলোকে ঘেন্না হয় তার। ছুড়ে ফেলে দেয়। গেট খোলার শব্দ হয়। আঁতকে ওঠে রোকসানা। কান খাড়া করে রোকসানা। সেই বিদঘুটে পায়ের আওয়াজ। আওয়াজটা এগিয়ে আসছে তার দিকে। এই লোকটা কিভাবে যেন টের পায় রোকসানার অবস্থান। অসংখ্যবার লুকাতে চেয়েছে সে পারেনি কুকুরের মতো শুকে শুকে চলে এসেছে তার কাছে।

ঘড়ঘরে গলায় ডাক ছাড়ে, রোকসানা... এই রোকসানা...
রোকসানা বের হয়। লোকটা সামনে এসে পড়ে। লোভি চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে। লালা ঝরে তার। এরপর ঝাপিয়ে পড়ে তার মাংসপিণ্ডে।

রোকসানা ভার সামলাতে পারে না। পড়ে যায়। নেকড়েটা আঁচড়ে খামছে তাকে টেনে নিয়ে যায় দোতলায়।

ইদানীং কেমন ইতস্তত লাগছে রোকসানার। আরও একজনের উপস্থিতি সে টের পাচ্ছে। কেউ তার দিতে নজর রাখছে। অপলক দৃষ্টিতে কেউ তাকিয়ে আছে তার দিকে। কিন্তু সে কাউকে খুঁজে পায় না। রোকসানা চিৎকার করে ডাকে। দৌড়ে খোঁজে। কই, কাউকে সে খুঁজে তো পায় না। ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করে রোকসানা, এই দেয়াল বেয়ে কারও আসা সম্ভব নয়। তাহলে কে দেখছে তাকে। প্রথম যখন সে টের পায় কেউ তার দিকে তাকিয়ে আছে, তখন নেকড়েটা তাকে আঁচড়ে খামছে একাকার করছে। রোকসানা তবু বলে, কেউ তাদের দেখছে।

কেয়ারটেকার খিস্তি করে ওঠে, চুপ কর মাগি।
তো, কী আর করার! সে চুপ করে যায়। কিন্তু আবার সে খেয়াল করে কেউ তাকে দেখছে। একসময়ে নেকড়েটা নেমে যায় তার শরীর থেকে। শার্ট পরতে পরতে হাতের তালু দিয়ে আঘাত করে রোকসানার নিতম্বে আর ভয়ংকর উল্লাস করে ওঠে। ব্যথায় ককিয়ে ওঠে রোকসানা।

ধীরে ধীরে শরীর ভারি হয়ে ওঠে তার। কেউ আসছে। তাকে আড়াল করতে হবে। নেকড়ের চোখ থেকে আড়াল করতে হবে। মাথার ভেতর একটা মৃদু ফিসফিস টের পায় রোকসানা, যেন কেউ কিছু বলছে। বেশ সতর্ক হয়ে বুঝার চেষ্টা করে সে, বুঝতে পারে না। যেন এক অচেনা সুর মাথার ভেতর থেকে আসছে।

রোকসানা ঘুমায় না। অন্ধকারে জেগে ওঠে তার সমস্ত দেহমন। দিনের আলো তাকে বিরক্ত করে, তাই তার কখনোই ঘুমানো হয় না। রোকসানা আরও মনোযোগী হয়। ফিসফিসে শব্দটা ক্রমশ্য তাকে আচ্ছন্ন করছে। এবার অবশ্যি ব্যাপারটা কিছুটা পরিষ্কার হয়। তার কাছে কিছু চাইছে কেউ। ফিসফিস করে চাইছে। বিনিময়ে রোকসানাও চায় কিছু। তারা রাজি হয়। রোকসানা বশ্যতা স্বীকার করে। আদেশ পালন করতে শুরু করে।

এই তো সেদিন দেহটুকুকে সে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে আবর্জনায়। কাঠের পুতুলটাকে যা তাকে আঁকড়ে ছিল। মাংসের স্তূপটা পড়ে আছে বকফুল গাছটার নিচে। সাদা ফুলে ঢাকা পড়েছে সেই নোংরা দেহটা। এটাই তো চেয়েছিল তারা। নির্ভার মুক্তির বিনিময়ে।

মুচকি হাসছে রোকসানা। নেকড়েটা তাকে খুঁজে পাচ্ছে না। পাগলের মতো খুঁজছে নেকড়েটা। আর খুঁজে পাবে না তাকে। রোকসানা আর পুতুল নয়। সে তার প্রাণ ফিরে পেয়েছে।