লালনের গানের খাতা

সিনা হাসান

প্রকাশিত : অক্টোবর ১০, ২০১৮

লালন প্রতিষ্ঠানিক লেখাপড়া শেখেননি এবং কোনো গানও নিজের হাতে লিখে যাননি। তাঁর গান সাধারণত লিখে রাখতেন তার ভক্ত মনিরুদ্দিন শাহ। উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য তাঁর ‘বাংলার বাউল ও বাউল গানে’ লিখেছেন, ‘১৯২৫ সালে ওই অঞ্চলের বিখ্যাত লালনশাহী মতের ফকির হীরু শাহের সঙ্গে বাড়ি হইতে দশ মাইল হাঁটিয়া লালনের ছেঁউড়িয়া আখড়ায় উপস্থিত হই।... ওই সময়ে আশ্রমে রক্ষিত একখানা পুরানো গানের খাতা দেখি। উহা নানা প্রকারের ভুলে এমন ভর্তি যে, প্রকৃত পাঠোদ্ধার করা বহু বিবেচনা ও সময় সাপেক্ষ। আশ্রমের কর্তৃপক্ষরা বলেন, সাঁইজীর আসল খাতা শিলাইদহের ‘রবিবাবু মহাশয়’ লইয়া গিয়াছেন।’ (চক্রবর্তী ১৯৯২)

শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্র ভবনে আছে লালনগীতির দুটি পুরাতন খাতা। দুটিরই উপরে পেন্সিল দিয়ে লেখা আছে, Songsof Lalon Fakir, Collected by Raindranath। মোট গানের সংখ্যা ২৮০। অনেকে বলেন, এই খাতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর এস্টেটের কর্মচারী বামাচরণ ভট্টাচার্য্যকে দিয়ে নকল করিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু কেউ কেউ যেমন সুধীর চক্রবর্তী এটিকে নকল মানতে নারাজ এভাবে:
এক. গানগুলো পেছন দিক থেকে লেখা যা মুসলমানের রীতি। আর বামাচরণ মুসলমান ছিলেন না।
দুই. বামাচরণ শিক্ষিত ছিলেন, ওই খাতার বানান ভুলগুলো তাঁর করার কথা ছিল না।

ফকির লালন সাঁই দেশকাল এবং শিল্প বইয়ে শক্তিনাথ ঝা লেখেন, ‘রবীন্দ্র-ভবনে রাখা খাতাগুলো ভিন্ন উৎস থেকে সংগ্রহ করা, অর্থাৎ যে খাতা রবীন্দ্রনাথ আখড়া থেকে নিয়ে গিয়েছেন সেইখাতা নয়।’ শক্তিনাথ ঝা রবীন্দ্র ভবনে এ দুটি ছাড়াও আরো একটি খাতা খুঁজে পেয়েছেন। কিন্তু ফরহাদ মজহার ১২৯৯ বাংলা সালে জগৎ বিশ্বাস লালনের মূল খাতা থেকে অনুলিপি করেন বলে উল্লেখ করেন। আরো বলেন, এ খাতার মালিক ছিল ভোলাই শাহ। আবার কেউ কেউ আসল খাতা আদৌ আছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। যেমন ফরহাদ মজহার ‘সাঁইজীর দৈন্যগান’ বইয়ে, ‘এই বিষয়ে আরো গবেষণা হওয়া দরকার এবং ‘আসল খাতা’ আদৌ আছে কিনা সেই প্রশ্নেরও মীমাংসা হওয়া দরকার।’

এছাড়াও আরো একটি বইয়ে লালনের আরেকটি খাতার কথা পাওয়া যায়, সেটি কোন খাতা তা বের করতে পারিনি। ফকির মন্টু শাহ ‘লালন সঙ্গীত’ বইয়ে আরেকটি খাতার উল্লেখ করেন, ভোলাই শাহের ভক্ত জহররুদ্দিন শাহের অছিয়ত (নির্দেশনা) অনুসারে বর্ধমানের মধুবন গ্রামের তাঁর কবরে তাঁর দেহের সাথে লালনের গানের খাতা পুঁতে দেয়া হয়।’ সরজমিনে মাঠে ঘুরে আরো একটি খাতার কথা জানা গেল তা ছিল ইব্রাহিম শাহের কাছে। ইব্রাহিম শাহ ফকির যখন মুত্যুবরণ করে তখন তাঁর ছেলে হোসেন শাহের বয়স সাত বছর। ১৯৩০ এর দশক। ইব্রাহিম শাহের সেই খাতাটি তখন হোসেন শাহ আগলে রাখতে চায় এবং মাকে বলে যে, ‘এ খাতা কাউকে দিও না’। কুষ্টিয়ার লাহিনী বটতলায় তাঁদের নিবাস ছিল। কিন্তু পরদিন রাতে ওই এলাকারই ‘মোশাররফ ফকির’ বা ‘মশা ফকির’ নামে একজন এসে হোসেন শাহের মাকে বলে, ওই খাতাটা ইব্রাহিম শাহ তাঁকেই দিয়ে যেতে চেয়েছিল। তিনি তিনশো টাকা বের করে বলেন, ‘ভাবি, এটা রাখেন, আর খাতাটা দেন, আমি তিনদিন পরই দিয়ে যাচ্ছি’। কিছুক্ষণ কথা বলায় মা সম্মত হন এবং খাতাটা বের করে হোসেন শাহকে বলেন সেটা মশা ফকিরকে দিতে। হোসেন শাহ তখন আর কোনো কথা বলেননি। তার ভাষায়, ‘লাল বাঁধাই করা, এই মোটা খাতা’ কাহিনিটা বলার সময় ‘আমি... নিজের হাতে.. ইসস... আমি কি ভুল করলাম’ বলে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন হোসেন শাহ্। পাশ থেকে ভক্তরা সান্ত্বনা দেয় ‘কতই আর বয়স ছিলো, আপনার বোঝার কথা না’।

হোসেন শাহ সেই খাতা আনতে তিনদিন পর আনতে গেলে মশা ফকির তাঁকে বলেন ১৫ দিন পরে আসতে। ১৫ দিন পর আবার গেলে সেদিনও মশা ফকির তাঁকে খাতাটা দেননি। তারপর আর অনেকদিন মশা ফকিরকে দেখা যায়নি। অনেকদিন পর কোনো এক বাজারে হোসেন শাহ সেই মশা ফকিরকে দেখতে পেলেই ছুটে গিয়ে ধরেন ‘আমার খাতা কই’ বলে। সেদিন মশা ফকির জানান যে তিনি ‘আনোয়ারুল করীম’ নামে কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের এক শিক্ষকের কাছে তেরশো টাকায় বিক্রি করে দিয়েছেন। তারপর হোসেন শাহের ভাষায়, ‘সেই খাতা কি আর পাওয়া যায়?’

পাশ থেকে রেজা ফকির বললেন, ‘আনোয়ারুল করীম হলেন লালন এর উপরে প্রথম ডক্টরেট করা’। হোসেন শাহের বর্তমান বয়স ৮৫ বছর। তিনি এখনো ‘আহারে আমি কি ভুল করলাম জীবনে’ বলে কাঁদেন। তিনি ‘লাল বাঁধাই করা, এই মোটা খাতা’ টিকে মনে করেন লালনের একটি মূল খাতা যা মনিরুদ্দিন শাহ লিখেছিল। এছাড়া ড. সৈয়দ আবুল আহসানের কাছে মনিরুদ্দিন শাহের লেখা লালনের ৫৩০টি গানের সূচিপত্র অংশটি আছে।

এসকল বিবেচনা করে যা পাওয়া যায় তা হচ্ছে:
এক. লালনের গানের খাতা লালনপন্থীদের কাছেই নেই। অর্থাৎ যারা লালনপন্থায় সাধনা করে তাদের কাছে নেই।
দুই. রবীন্দ্রনাথ প্রথম লালনের গানের খাতা লালনপন্থীদের কাছ থেকে বাইরে নিয়ে যান।
তিন. কোনো কোনো খাতার ফকিরদের কাছে ‘মূলখাতা’ বিবেচিত হলেও তার বিবরণ কোনো গবেষণায় পাওয়া যায়নি।

বর্তমানে লালনের দুটি খাতাই পৃথিবীর বুকে আছে। শক্তিনাথ ঝাঁ যে দুটো খুঁজে পান। এদুটোর ছবি তোলার ইচ্ছে আমার ছিল। কিন্তু এদুটো শান্তিনিকেতনের ’নন্দন’ মিউজিয়ামে (অফিসিয়াল ও প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত) সংরক্ষিত। এর ভেতরে প্রবেশ করতে পারিনি, খাতার ছবিও তুলতে পারিনি।

একটা বিষয় পরিষ্কার যে, লালন বলেছেন, ‘সিনার ভেদ জানে না সফিন ‘ মানে হৃদয়ের কথা গ্রন্থ জানে না। গান আর গানের খাতায় লক্ষ্য যোজন ফারাক। কিন্তু এই খাতাকে ঘিরে কি পরিবেশন ও রাজনীতি হয় তা গবেষক হিসেবে লক্ষ্য করা আমার কাজ।