‘লেখারাম খেলে যা’ মনোজগতের সাইকিক জার্নি

মো. খালিদ সাইফুল্লা ফয়সল

প্রকাশিত : আগস্ট ০৫, ২০১৮

বাংলা সাহিত্যে সৈয়দ শামসুল হকের পরিচয় ‘সব্যসাচী লেখক’ হিসেবে। দীর্ঘ সাহিত্যজীবনে তিনি তার মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন কবিতা, গল্প, উপন্যাস এবং নাটকসহ শিল্প-সাহিত্যের নানা অঙ্গনে। বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের আবেগ-অনুভূতি-বিকার সবই খুব সহজ কথা ও ছন্দে উঠে এসেছে তার লেখনিতে। ‘খেলারাম খেলে যা’ উপন্যাসের প্রতিটি বস্তুকোণ মানব জীবনের প্রতিটি আঙ্গিককে ফুটিয়ে তুলেছে। বিশ্বসাহিত্যের সার্থক উপন্যাসগুলো সব সময় গল্পের আড়ালে গল্প বলে, বক্তব্যের আড়ালে থাকে আবিষ্কার করতে পারা এমন অনেক বক্তব্য।

বাবর আলী। সুন্দর নিপাট গোছানো মানুষ। কথার মায়াজাল বুনায় তার জুড়ি মেলা ভার। জীবন নিয়েও আপাত অর্থে তার কোনো টানাপোড়েন নেই। ব্যবসার টাকায় বেশ আয়েশে, নিশ্চিন্তিতে দিন কাটে তার। শিক্ষিত, সুদর্শন, অবিবাহিত, সুকথক, সমাজের অন্য দশজনের থেকে বিত্তবান, মাঝবয়সী এই বাবরের যেন কোনো দুঃখ নেই। পিছু টান নেই। মনে হয়, যেন নিজের শরীরের সুখের জন্য, শিশ্নের ইচ্ছেকে চরিতার্থ করবার জন্যেই সে কেবল উদগ্রীব।

বাবর শরীর চায়। কিন্ত সম্পর্কের বন্ধন চায় না। শরীর চিন্তার বাইরেও বিয়ে নিয়ে বাবরের আলাদা আরো ভাবনা আছে। বিয়ের বন্ধন চায় না বাবর। নতুন আরেকটি জীবন তৈরি করে তার উত্তরাধিকারও রেখে যেতে চায় না। সে ভালোবাসে অবাধ যৌনাচার। কচিকচি মেয়েদের সাথে বিছানায় যাবার জন্যে সে ব্যাকুল হয়ে থাকে। কিন্তু ধর্ষণ সে করে না। বহু বুদ্ধি খরচ করে, সময় খরচ করে, অর্থ খরচ করে কচি মেয়েদের মন সে জয় করে। কেননা বাবর জানে, মন জয় হলে শরীরটা জয় করা সহজ হয়; হয় আনন্দময়।

এমনি হীন, কামুক, লম্পট, দূরাচারী যে, তার কেন মাঝে মাঝে খুব একা একা লাগে? কেন তার কান্না কান্না পায়? কেন তার মনে হ,য় কী জানি কী নেই! কী যেন কী এক অদ্ভুত হাহাকার, শূন্যতা কেন তাকে আমূল গ্রাস করে নেয় বারবার?

যৌনতার আশ্রয় নিয়ে লেখক শেষপর্যন্ত কোথায় নিয়ে গেছেন, কোথায় নিয়ে যেতে চেয়েছেন, সেটাই মুখ্য। সত্যি বলতে, খেলারাম খেলে যা তো আসলে এক বাবরের আড়ালে দুই বাবরের গল্প। এক বাবর ইনোসেন্ট। আরেক বাবর কামকাতর। নারী তার কাছে প্রেমাষ্পদা নয়, শিশ্নের আনন্দের উৎসমাত্র।

নিজের ব্যক্তিগত পাঠ প্রতিক্রিয়া লিখতে গেলে বেশ দ্বিধায় পড়ে যাবো, কারণ এই উপন্যাস সব্যসাচী লেখক মানুষের সত্যতাকে আঙুল দিয়ে তুলে ধরেছেন। যৌনাচার, ভালোবাসা বিষয়গুলোকে তিনি স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন এখানে।

পাঠককে মাঝে মাঝে কনফিউজড করে দেবে দুই বাবরের বর্তমান বর্ণনা। খেলারাম খেলে যা উপন্যাসেও বাবরের মনের দুটো পার্ট। ইনোসেন্ট ও ডার্ক। ডার্ক পার্টটির ক্ষমতা প্রসারিত হবার সঙ্গে সঙ্গে ইনোসেন্ট পার্টটি ধীরে ধীরে আড়াল হতে-হতে বলতে গেলে একেবারে হারিয়েই গেছে বাবরের অস্তিত্ব থেকে।

কিন্তু মনোভ্রমণের মাধ্যমে লেখক সৈয়দ হক আমাদের দেখিয়েছেন যে, লম্পট বাবরের মাঝেও অন্য এক বাবর আছে— যে বর্ধমানের লেবু গাছটির কথা ভেবে বিষণ্ণ হয়, যে এলাকার কানা ফকিরটার কুশল জানতে চায়, যে অন্তহীনভাবে ডুবে আছে হারানোর বেদনায় ও হাহাকারে।

সমাজে থেকেও ট্রমার প্রভাবে কী করে একজন মানুষ হয়ে পড়ে সকল কিছুর প্রতি উদাসীন, অঙ্গীকারহীন, বিচ্ছিন্ন-পরোক্ষে তার এক সাইকো-অ্যানালাইসিস তুলে ধরেছেন সব্যসাচী লেখক। ঘটনার ঘাতে মানুষের মনোজগতের ভাঙচুর নিয়ে যে সাইকিক জার্নি তিনি তৈরি করেছেন ‘খেলারাম খেলে যা’ তে, তা হয়ে উঠেছে হৃদয়গ্রাহী।

অনন্যসাধারণ প্রভিতায় লেখা এ উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যে এক নতুন ধাপের জন্ম দিয়েছে, পাঠককে তাই বইটি পড়ার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।

একুশে বইমেলা ২০১৮