লোকটা

রুদ্র আরিফ

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ০৯, ২০১৮

জ্যামে ফেঁসে যাওয়া দুপুরে সিগারেট বাড়িয়ে দেয়ার মুহূর্তে, কিংবা সিগন্যাল পেরিয়ে ফাঁকা রাস্তায় সাই-সাই ছুটে যাওয়ায় সময় বাসের বডিকে থাপড়াতে থাপড়াতে, যে পুলকে ড্রাইভারকে হেল্পার ডাক দেয়, সেই ফূর্তিতে লোকটাকে আমি ওস্তাদ ডাকি। আড়ালে-আবডালে ডাকি, মুরুব্বি, দাড়িঅলা... আরও কত কি!

১৪ বছর ধরে, এ শহরে, এক আদি ও অকৃত্রিম প্রশ্রয়বৃক্ষ তিনি। সুযোগ পেলেই পাশে বসে থাকি, মুহূর্ত থেকে টানা কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত; স্বভাবতই তিনি চুপচাপ, হাফ-টাক মাথা চুলকান মাঝে মাঝে, একটা-দুটা শব্দ/বাক্য বলেন; আর আমি নিরন্তর বকবক, বকবক, বকবক...!

ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে প্রথম কবিতার বইটা বের হলো ফেরদৌস মাহমুদের, ২০০৬ সালে, ‘সাতশো ট্রেন এক যাত্রী’। প্রকাশক আমরাই, লিটলম্যাগ `জেব্রা`। প্রচ্ছদ কে করবে? ওস্তাদ আছে না! কিন্তু তিনি তো প্রচ্ছদ আঁকেন না! আঁকেন নাই আগে, ইচ্ছাও নাই আঁকার! বললাম, ‘ওস্তাদ...!’ এঁকে দিলেন। বন্ধু বাপ্পির (বিজয় আহমেদ) প্রথম কবিতার বই ২০০৮ সালে, ‘সার্কাস তাঁবুর গান’। অর্ধেক প্রকাশক `জেব্রা`ই, তবে ছাপা হলো আরেক প্রতিষ্ঠানের নামে। প্রচ্ছদ কে করবে? ‘ওস্তাদ...!’ বন্ধু তামের কবিরের প্রথম বই, গল্পের, ‘যাদুকরের জন্মদিনে’; তা-ও একই তরিকায়! প্রচ্ছদ? ‘ওস্তাদ...!’

এরপর আমার প্রথম বইটা, ‘ওপেন এয়ার কনসার্টের কবিতা’; ২০০৯ সালে `ঐতিহ্য` ছাপল। এটার প্রচ্ছদ করা তো ওস্তাদের `নৈতিক` দায়িত্ব, নাকি? পরের দুই কবিতার বইয়ে আর ওস্তাদকে জ্বালাইলাম না; অন্য দুই বড়ভাই-বড়বোন আর্টিস্ট প্রচ্ছদ এঁকে দিলেন। ২০১২`তে `ভাষাচিত্র` থেকে ‘র‌্যাম্পমডেলের বাথটাবে অন্ধ কচ্ছপ’ আর ২০১৫`তে `চৈতন্য` থেকে ‘হাড়ের গ্যারেজ’ এরপর, অনেকটাই অটোমেটিক, তিন বছর করে ব্যবধানে তিন ফর্মার চতুর্থ পাণ্ডুলিপিটি ২০১৮`তেই তো বের হবার কথা। হলো না! কেন? পাণ্ডুলিপি ওস্তাদের দরবারে, চিরকুট-সহ, পাঠিয়ে রাখলাম ২০১৭`র মাঝামাঝি।

ভয়াবহ ভেজালে/ব্যস্ততায় তিনি, জানিই তো; তবু বইমেলা ঘনিয়ে এলে হাঁক দিলাম, ‘ওস্তাদ...!’ জবাব দিলেন, ‘কইছি না, পারুম না! আমার আশা করলে দাঁড়ায়া থাক!’ থাকলাম! বইমেলার শেষদিকে ওস্তাদ জিজ্ঞাসিলেন, ‘তোমার বইটা কারা (প্রকাশক) করছে?’ বললাম, ‘প্রচ্ছদ ছাড়া কেমনে?!’ ওস্তাদ শরমিন্দা হইলেন খুব। তার শরমিন্দা মুখ দেখলে আমার ফূর্তি বাড়ে; দেখতে ক্লাসে পারা-অঙ্ক-ভুল-করে-ফেলা ক্লাস টু-থ্রির বাচ্চাদের মতো বেকুব-বেকুব সে মুখ! বললাম, ‘টেনশন নিয়েন না!’

তবু ওস্তাদ টেনশন নিলেন, তবু ঠিক মুড ও সময় পাচ্ছিলেন না! আর আমি তো সদ্য-প্রতিবেশী হওয়ার ফলে প্রায় প্রতিদিনই উঁকিঝুঁকি ও মুচকি হাসি মারি! আজকে ওস্তাদ হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন, জ্বালাতন থেকে! প্রচ্ছদটা এঁকে ফেলেছেন তিনি, আমাকে দিয়েও দিছেন। আহ, কী তাগড়া!

ছোটবেলায় দেখা ‘পাপাই’ কার্টুনের মতো মনে মনে ডাকলাম, ‘ওহ, পাপাই’, মানে, ‘ওহ, ওস্তাদ...!’

লেখক: কবি ও গণমাধ্যমকর্মী