শক্ত মাটি

প্রবাসকথন

আশিকুজ্জামান টুলু

প্রকাশিত : আগস্ট ১০, ২০১৮

প্রথম ভালোলাগা, প্রথম প্রেম, প্রথম প্রত্যাখ্যান, প্রথম কষ্ট, প্রথম রিয়েলাইজেশন, প্রথম বিদেশ যাত্রা— এই বিষয়গুলো মনে গেঁথে যায় সুঁই হয়ে, আর বের হয় না। আজ বিশ বছর হতে চললো ক্যানাডা আসা, এই বিশ বছরের বেশিররভাগ দিনগুলো ভুলে গিয়েছি। কিন্তু প্রথমদিনের প্রতিটা ঘটনা একেবারে পানির মতো পরিষ্কারভাবে মনে আছে।

এয়ারপোর্টে নেমে কেমন একটা আজব ফিলিং হলো। এক আত্মীয়া এসেছিলেন আমাকে নিতে এবং সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন একজন সাদা ছেলেকে। সাদা ছেলেটাকে আমার বাক্সগুলো ধরতে দিতে দ্বিধা হলো। মনে হলো, ও যদি আমার বাক্স ধরে কিছু মনে করে। অথচ ও কিন্তু খুবই আশ্চর্য হলো ওকে ধরতে না দেয়াতে এবং আশ্চর্য হয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, তোমার বাক্সের মধ্যে কি আছে?

আমি কিছু বলিনি ওকে। সাত সাতটা ভারি বাক্স নিজে ধরে নামালাম। যে আমি ঢাকাতে একটা দশ কেজি ওজনের কীবোর্ডও একদিনও সেটআপ করার জন্যও বক্স থেকে বের করে স্ট্যান্ডে ওঠাইনি। আত্মীয়ার ক্যাডিলাকে উঠে কী যে ভালো লাগলো! কারণ কালো ক্যাডিলাক বরাবরই আমার প্রিয় গাড়ি। আগে যখন শো করতে অ্যামেরিকা আসতাম তখন কয়েকবার চড়েছি।

পৌঁছে গেলাম ওনার বাসায়। বিকেল হয়ে গিয়েছিল বলে কোথাও যেতে পারিনি সেদিন। তবুও বাসার বাইরে এসে দাঁড়ালাম। ওনার বাসা থেকে কিউ ই ডাব্লিউ হাইওয়েটা দেখা যায়। তাকিয়ে থাকলাম কিউ ই ডাব্লিউর দিকে। সাঁই সাঁই করে গাড়িগুলো ছুঁটে চলেছে। কোনো থামাথামি নাই। গোনাও সম্ভব না। একের পর এক গাড়ি। শুধু গাড়ি। আমি পরে আছি ফুলশার্ট আর একটা সোয়েটার, তবুও ঠাণ্ডা লাগছে। সব কিছুকে অসম্ভব পর পর লাগছে। কেমন যেন দম বন্ধ করা অনুভুতি। কোনোদিনও কারো বাসায় থাকিনি এর আগে। তাই কেমন যেন দ্বিধা মনটাকে দুর্বল করে দিয়েছে। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আত্মবিশ্বাসী কোনো শব্দ গলা দিয়ে বের হচ্ছে না। মনটা একেবারে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে আছে। কোনো সাহস নাই, কোনো শক্তি নাই। সাধারণ গলায় কথা বলার মতো মন নাই। কেমন এক আজব ফিলিং। কিছুক্ষণ দাঁড়ানোর পর চারদিকটা অন্ধকার হয়ে এলো, কখন যে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে, বুঝিনি। আস্তে আস্তে বাসায় এসে ঢুকলাম।

এর আগে বিদেশ বেশ অনেকবার যাওয়া পড়েছে প্রোগ্রাম করতে, কিন্তু এরকম ফিলিং কোনোদিনও হয় নাই। আমি ঠিক লিখে বোঝাতে পারবো না, কেমন সেই অনুভূতি! ওই অনুভূতিটা সারাজীবনের জন্য মনের কোনো এক গোপন কুঠুরিতে লুকানো থাকে। মাঝে মাঝে কোনো অন্ধকার রজনীতে কিংবা বৃষ্টিঝরা গভীর রাতে ফিরে আসে এক পশলা কষ্টের শিশির নিয়ে। টুপটাপ পড়তে থাকে মনের আঙিনাজুড়ে। কেউ বোঝে না, কিন্তু আমি ভীষণভাবে ফিল করতে পারি। চোখ বন্ধ করে মনটাকে এলিয়ে দেই ওই ছেঁড়া ছেঁড়া ভেজা কষ্টগুলোর কাছে। মনটাকে একেবারে ভিজিয়ে দেই আর আমি ভিজতে থাকি ব্যথাভরা আনন্দতে।

পরেরদিন সবচাইতে ভোরে আমার ঘুম ভাঙে, জেগে উঠি। জুতোটা পরে আবার বেরিয়ে এসে দাঁড়াই সামনের রাস্তায়। তখনও সাঁই সাঁই গাড়ির সারি নিরবিচ্ছিন্নভাবে চলছে। তাকিয়ে থাকি কিউ ই ডাব্লিউর দিকে। বাসার সামনের রাস্তাটা একেবারে ফাঁকা। অনেকদিন এত ফাঁকা রাস্তা দেখা হয় না। মনে হচ্ছিলো, যেন শহরে কারফিউ পড়েছে। ১৯৭১ সালের ঢাকা শহরের কারফিউর কথা মনে পড়ে যায়। আমার খুব ভালো লাগতো কারফিউ। সব ভাইবোনেরা বাসায় থাকতাম, সাথে আম্মা আব্বা। আমি লিয়াকতদের দোতলায় উঠে সামনের রেলিঙের ঘুলঘুলি দিয়ে হাজী ওসমান গনি রোডের কাফিউর নীরবতাটা দেখতাম। ঠিক ৬টায় কারফিউ পড়ে যেত, পাড়ার গনি মিয়ার দোকানটা বন্ধ করে গনি মিয়া মনে হয় ভিতরেই বাতি জ্বালিয়ে ডালভাত রাঁধতো আর রাত হলে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়তো। গনি মিয়ার পৃথিবীতে কেউ ছিল না। একেবারে একা বয়স্ক গনি মিয়া। ওই সময় একবার ঢাকার অবস্থা খুব খারাপ হলো। আমরা ঢাকা থেকে পালিয়ে গ্রামে চলে গেলাম।  তখন আর খবর রাখিনি গনি মিয়া কী ঢাকাতে ছিল, না পালিয়েছিল। বেশ কয়েক মাস পরে ঠিক স্বাধীনতার আগে আমরা ফিরে এসেছিলাম ঢাকাতে। এসে খবর পেয়েছিলাম, পাক আর্মিরা গনি মিয়াকে ওর দোকানেই গুলি করে হত্যা করেছিল। গনি মিয়ার আর কী, ঠিক অন্ধের কীবা দিন কিবা রাত্রির মতো। ত্রিভূবনে কেউ ছিল না গনি মিয়ার। এমনি শ্বাসকষ্টে ভুগতো দোকানে বসে বসে। আর্মিরা এসে ওর দোকানে, যেখানে ওর দিবারাত্রির হিসাব-নিকাশ চলতো, সেখানেই ওপেন হার্ট সার্জারিটা করে দিয়ে গিয়েছিল। ভালোই হয়েছিল, আর কষ্ট করতে হয় নাই বৃদ্ধ গনি মিয়াকে। দাফন কাফনের পয়সাও বেঁচে গিয়েছিল। পাকিস্থানিরা আমাদের কত উপকার করে গিয়েছে, এখনও ভুলতে পারি না। মাঝে মাঝেই তাই গেয়ে উঠি, পাকসার জামিন সাদ বাদ...

কথা বলতে বলতে মাঝে মাঝেই হারিয়ে যাই কোথায় যেন, জানি না এটা কীসের লক্ষণ! যাই হোক, খুব ভোরের বেলা বলে আবার ফিরে আসি ঘরের ভিতরে। আত্মীয়া খুব যত্নের সাথে সকালের নাস্তা দেন। দ্বিধার যাতনায় গলা দিয়ে নামতে চায় না নাস্তা। লজ্জায় মনের ভিতরটা কুঁকড়ে যায়। কষ্ট করে এক স্লাইস পাউরুটি কোনোরকমে গলাধকরণ করে এককাপ ধূমায়িত চা নিয়ে কিছুক্ষণ গল্প করি ওনার সাথে। কেমন যেন এক একলা জীবনের মুসাফির উনি। এসেছিলেন মনে হয় ষাটের দশকে, অনেক আগে ওনার স্বামী মারা গিয়েছেন। উনি এখন একেবারে একা, ভীষণ একা। অনেক গল্প করলাম। একসময় সকাল ৯টা বাজলো। আমি বেরিয়ে পড়লাম কোথাও যাব ভেবে।

কিউ ই ডাব্লিউর পাস ঘেঁষে একটা রোড চলে গিয়েছে। এখন বুঝি যে, ওটাকে সার্ভিস রোড বলে। ওটা ধরেই অজানার উদ্দেশে হাঁটতে শুরু করে দিলাম। কেন যেন মনে হলো, আসার সময় ওখানে একটা বড় মার্কেট দেখেছিলাম। ওখানেই যাব ভেবে রওনা দিলাম। ঢাকাতে কোনোদিনও হাঁটা হয় নাই। এখানে হাঁটতে হবে। বের হওয়ার সময় ফর্মাল ড্রেস সু পরেই বেরিয়ে পড়েছিলাম, কেডস পরি নাই। হাঁটতে একটু কষ্ট হচ্ছে। জুতোটা কিনেছিলাম সিঙ্গাপুরের অর্চাড প্লাজা থেকে, খুব প্রিয় জুতাটা। হাঁটছি হাঁটছি এবং হাঁটছি। কোনো মার্কেটের নামগন্ধ নাই কোথাও। ফিরে যাওয়ারও উপায় নাই। কারণ বেশ খানিকটা চলে এসেছি। এখন ফিরে যাওয়ার কোনো মানেই হয় না। পায়ের স্পীডটা আরেকটু বাড়িয়ে দিলাম। আরও মাইল খানেক যাওয়ার পর দূরে মার্কেটটা দেখতে পেলাম। হাঁটার গতি না কমিয়ে হাঁটা চালিয়ে গেলাম। আরও মিনিট ১৫ পর পৌঁছে গেলাম মার্কেটে। মার্কেটের নাম ডিক্সি মল। মার্কেটের ভিতরে ঢুকে একটা জুতোর দোকানের সামনে দাঁড়ালাম। জুতোগুলি বেশি সুন্দর লাগলো না। লন্ডনের জুতো বেশি সুন্দর। পাশের গ্রোসারিতে গিয়ে একটা অরেঞ্জ ক্রাশ কিনলাম। মুখটা খুলে ঢক ঢক করে ১০ সেকেন্ডে ক্রাশটা শেষ করে ফেললাম। মার্কেটের মাঝখানে বেঞ্চ পাতা ছিল। মিনিট বিশেক উদ্দেশ্যবিহীন পথিকের মতো বসে রইলাম। দৃষ্টি ব্ল্যাঙ্ক, মনটা শূন্য, কেমন আজব লাগছে। হঠাৎ ইচ্ছা করলো ফিরে যেতে। ফেরার কথা মনে হতেই হাঁটার কথাটা মনে পড়ে খুব ভয় লাগলো। যে মানুষ ঢাকাতে তাজমহল রোড থেকে সলিমুল্লাহ রোড যেতেও তিন টাকা দিয়ে রিক্সায় চড়তো, তাকে যদি ক্যানাডার প্রথম দিন ছয় কিলোমিটার হাঁটতে হয়, তাহলে তার মন ও শরীরের অবস্থা কেমন হতে পারে!

মার্কেট থেকে বের হয়ে আবার হাঁটতে শুরু করলাম সেই পথ ধরে। একেকটা স্টেপকে মনে হচ্ছিলো অসম্ভব ভারি। ফর্মাল সু’এর ভিতর পা’টা ছিলে গিয়েছিল হাঁটতে হাঁটতে। ছেলা জায়গাটায় জ্বলছিল। হাঁটুটা ব্যথায় কাঁপছিল। পকেটে টাকা ছিল কিন্তু কিভাবে ট্যাক্সি ডাকবো বা বাসে চড়বো, জানি না। বাসস্ট্যান্ড কোথায় তাও জানি না। যেদিকে তাকাই, শুধু বিরানভূমি অথবা ফাঁকা রাস্তা, দুয়েকটা শশব্যাস্ত প্রাইভেট গাড়ি। ভীষণ অসহায় লাগলো নিজেকে, ভীষণ কান্না পেলো। হয়তো মনের অজান্তে দুয়েক ফোঁটা বেরিয়েও গিয়েছিল, কিন্তু তা কেউ দেখেনি বা জানেনি। একমাত্র আমি আজোবধি মনে রেখেছি খুব যতনে। এই একার কষ্টগুলি একান্তই একার। এরকম কিছু একান্তই একার কষ্ট বুকের খুব গহীনে বয়ে নিয়ে বেড়াই।

হাঁটতে হাঁটতে একটা স্টেশনের মতো জায়গায় এসে দাঁড়ালাম। মনে হলো, এটা যদি স্টেশন হয় তাহলে একটা ট্রেনে চেপে বসবো। আর পারবো না এক পাও হাঁটতে। বিশাল বড় একটা পারকিং লট, হাঁটতে হাঁটতে পারকিং লট পেরিয়ে স্টেশনের দরজার দিকে এগোতে থাকলাম। একটা বিষয় খেয়াল করলাম, পারকিংয়ের পাকা সিমেন্ট ভেদ করে উইড (একরকমের জংলা ছোট ছোট গাছ) হয়ে গিয়েছে। অবশেষে স্টেশনের গেটে গিয়ে পৌঁছলাম। গেট খুলে ভিতরে ঢুকে দেখি, একেবারে পরিত্যক্ত একটা স্টেশন। কোনো জনমানুষের চিহ্ন মাত্র নাই। ঘুরে দাঁড়িয়ে পারকিং লটের সাইজটা দেখে আবার কান্না পেল। আর পারি না হাঁটতে, পা চলে না। জুতোর ভিতর পা ছিলে গিয়ে ভীষণ জ্বলছে। জুতো খুলে হাতে নিয়ে খালি পায়ে হাঁটাও সম্ভব না। জীবনেও খালি পায়ে হাঁটি নাই। এতক্ষণ ধরে কিলোমিটারের পর কিলোমিটার হাঁটছি, তবুও ভুলক্রমেও একটা মানুষকে দেখি নাই হেঁটে যেতে। বারবার মনে হচ্ছিলো,  এদেশে কি কেউ হাঁটে না? পারকিং একসময় শেষ হলো। মনটাকে আবার শক্ত করে বাঁধলাম, যেভাবেই হোক বাসায় পৌঁছতে হবে। আমিতো নিজে থেকেই এ কষ্টকে বেছে নিয়েছি, জোর করে তো কেউ আমাকে ক্যানাডা পাঠায় নাই। নিজের ইচ্ছাতেই এই নির্বাসনে এসেছিলাম। সুতরাং হাঁটতে আমাকে হবেই।

মনকে এই বলে সান্তনা দিলাম যে, এ আর কী টুলু, তোমাকে প্রতিদিন ১৫ কিলোমিটার হাঁটতে হবে এখন থেকে। এবং অনেক অনেক কষ্ট করতে হবে। এখানে রুকি সালমা বা মনোয়ারাও নাই অথবা খলিল ফারুক বা মোনতাজও নাই, এখানে হলো হিজ হিজ হুজ হুজ। হার হার হুর হুর। আবার হাঁটতে থাকলাম কিউ ই ডাব্লিউর ধার ঘেঁষে। গাড়িগুলো ছুটে চলে সাঁই সাঁই করে। গাড়িগুলোকে দেখে মনে হয়, কেউ কারো আপন না এরা। খুব পর পর, মনটা বড় শক্ত। হাঁটতে হাঁটতে একসময় দূর থেকে বাসাটা চোখে পড়ে যায়। মনের ভিতরটায় খুশির বন্যা বয়ে যায়। আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাওয়ার জোগাড় হয়। আমি পেরেছি, আমি পেরেছি, এতগুলি কিলোমিটারের কাছে আমি হার মানিনি, ভেঙে পড়িনি। আমাকে কিলোমিটারগুলো হারিয়ে দিতে পারেনি। দাঁড়িয়ে যাই একটু বিশ্রাম নেয়ার জন্য। দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকি, সোনার দেশ ক্যানাডার মাটি অনেক অনেক শক্ত। নরম কঞ্চি দিয়ে এ মাটি নিড়ানো মোটেই সম্ভব নয়। ভীষণ শক্ত মন লাগবে এই মাটিতে ফসল ফলাতে।

লেখক: কণ্ঠশিল্পী