অঙ্কনঃ রিফাহ সানজিদা

অঙ্কনঃ রিফাহ সানজিদা

শবদাহ

রিফাহ সানজিদা

প্রকাশিত : মার্চ ২২, ২০১৮

বিকেলে ছাদের টবগুলোতে ধীরে ধীরে ফুলের গাছগুলো নুয়ে আসতে থাকে। দিনের আলো কমে আসতেই ছাদজুড়ে একটা হালকা শূন্যতা নামে। বাড়ির লোকজন রোদে শুকানো কাপড় নিয়ে যায় বলে বোধহয় ওরকম শূন্য দেখায় ছাদখানা।

সেরকম একটা শূন্য ছাদে মালতি ওঠে। কাপড় নাড়তে নাড়তে সূর্যের ডুবে যাওয়া দ্যাখে। বেলাশেষের ম্লান আলোয় মালতিকে সুন্দর দ্যাখায়। এ কথা অবশ্যি মালতি জানে না। তার দু`চোখ কেবল আকাশের সীমানা যতদূর যায়, সেদিকে নিরন্তর শেষ খুঁজে বেড়ায়।

এতদিন যে আশায় দিন কেটেছে, সেসব আশা আর নেই। ভালোবাসার নিগূঢ়তম টানও নেই কারও জন্য। এখন কেবল নিজের জন্য বেঁচে থাকার পালা। যে মানুষ অন্যের জন্য বেঁচে থাকে, মিছেমিছি বেলাশেষে তাকে ঠকতে হয়। ঠকে ঠকে এই সে শিখেছে। সুবলের মৃত্যু নিশ্চিত, একথা কতবারই না আত্মীয়-স্বজন তাকে বুঝিয়েছে। অথচ সে কীনা বোকার মতো মহামতি সাজতে গিয়েছিল মৃত মানুষের জন্য ভালোবাসা পুষে।

সুবল দাদা বেঁচে আছে মালতি। বিয়েও করেছে এক রমণীকে। দু’বাচ্চা আছে তাদের। এ কথাটা এসে যেদিন সুবলের ভাই নিজে বলে গেল, মালতি খুশি হলো নাকি দুঃখ পেল, কেউ জানে না। মালতির সেদিন মনে পড়লো, তার ঠাকুমার কথা। তিনি দাঁতমুখ খিঁচিয়ে সমস্ত ঘৃণা এক করে বলতেন, অমনি করে তোমার এত বিধবা সাজতি হবি না, বে করেছে তোমারে? দ্যাহো গিয়ে কার পাল্লু ধইরে সংসার কত্তিছে হারামজাদা। এসব শুনে খুব কাঁদত মালতি। আর শাপ দিতো বুড়িকে। যে নিজে এক নারী হয়ে অন্য নারীর ত্যাগ বুঝতে চাইলো না!

এখন দ্যাখো, বুড়ির কথাই ঠিক হলো। না, ঘেন্না সে করে না সুবলকে। একবার জানাতে তো পারতো কেবল, সে বেঁচে আছে। ওপারে কাজ করতে গিয়েছিল সুবল। কারখানায় আগুন লেগে কত মানুষ মরলো! তখন সবাই ধরে নিলো, সুবলও মরে গেল বুঝি। তার কোনো খোঁজ আজ অব্দি পাওয়া যে গেল না। আর এখন জানা গেল, সে সেদিন হাজিরই হয়নি কারখানায়। পুড়ে মরবে কী করে! নিজেই ভাইকে খবরখানা দিয়েছে বছর তিনেক পর। এতটা নির্দয় কী করে হলো সুবল?

ভালো হয়েছে। পোড়া কপাল কেবল আমারই ছিল! সুবল সে আগুনে পুড়ে মরবে কেন? মালতি ভাবে। মালতি যে মানুষের জন্য এত ত্যাগ স্বীকার করতে চাইলো, সে কীনা একটা দুর্ঘটনা কাজে লাগিয়ে তার কাছ থেকে মুক্তি পেতে চাইছিল?

রিক্ত চোখে মালতি চেয়ে থাকে শূন্য ছাদখানায়। আজ নিজেকে ভারমুক্ত মনে হচ্ছে তার। এত বছর যে ভালোবাসা অন্তর্দহনে তাকে পুড়িয়ে মারছিল, আজ সেটা উবে গেছে মুহূর্তে। সুবল একটা চিঠি দিয়েছে ভাইয়ের হাতে। মালতি সেটা পড়ার প্রয়োজন অনুভব করে না। টুকরো করা চিঠিটা এখন পুড়িয়ে ফেলবে সে। সুবলের শবদাহ করবে চিঠিটা পুড়িয়ে। যাতে আর কোনোদিন সুবলের আত্মা তাকে জ্বালাতে না আসে।