শব্দগুলোকে জীবন ও সাহিত্যের সাথে যুক্ত করতে চেয়েছি

পর্ব ১৪

প্রকাশিত : জুন ১১, ২০১৮

মেহেদী উল্লাহ বর্তমান প্রজন্মের একজন মেধাবী গল্পকার। তার ভাষা যেমন কারুকাজময়, তেমনই চিন্তায় রয়েছে প্রথা ভেঙে নতুন কিছু তৈরির আয়োজন। গেল মেলায় প্রকাশিত হয়েছে প্রথম উপন্যাস গোসলের পুকুরসমূহ। প্রকাশিত গল্পের বই চারটি। স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন জেমকন তরুণ কথাসাহিত্য পুরস্কার ২০১৩। কবি ও কথাসাহিত্যিক আবু তাহের সরফরাজ তার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গপসপ করেছেন। প্রতি শনিবার ধারাবাহিকভাবে সেসব কথামালা প্রকাশ করা হবে:

সরফরাজ: আপনার গল্পগ্রন্থগুলোর নামকরণে আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহারের পেছনে বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য আছে?
মেহেদী: আমার লেখালেখির শুরুর দিকটায় আমি একেরপর গল্প লিখে যাচ্ছিলাম। আমার লিখিত গল্পের অর্ধেকই লেখালেখি শুরুর প্রথম চার-পাঁচ বছরের মধ্যে লেখা। প্রথম বইয়ের পাণ্ডুলিপি করার আগে আমার মনে হলো, একটা বিশেষ থিম বজায় রেখে বইটা করব, মানে গল্পগুলোর মধ্যে বিশেষ এক ঐক্য খোঁজার চেষ্টা। দেখলাম, মৃত্যু নিয়ে বেশ কয়েকটি গল্প আছে। সেই গল্পগুলোই স্থান পেল পাণ্ডুলিপিতে। বিপত্তি বাঁধল, নাম খুঁজে পাচ্ছিলাম না। কয়েকবার নাম পরিবর্তন করেছি। শেষপর্যন্ত `তিরোধানের মুসাবিদা` চূড়ান্ত হয়। আমি একবারও ভাবিনি, শব্দগুলো ফারসি বা আরবি, এসব নিয়ে। আমি দেখেছি, এগুলোর ব্যবহার বাংলাদেশে আছে কীনা। শব্দের প্রবণতাই এমন, এগুলো পরিভ্রমণরত, সঞ্চরণতত্ত্ব মেনে চলে। একটি শব্দ সময়ে একটি শব্দ বিভিন্ন দেশে প্রচলিত থাকে বা বিভিন্নকালে একটি শব্দ ভিন্ন ভিন্ন দেশে প্রচলিত থাকে। এটাই শব্দের ছড়িয়ে পড়ার তত্ত্ব। বাংলা ভাষার প্রায় সব শব্দই ভিন্ন ভাষার আগত শব্দ। এগুলো এসে এমনভাবে মিশেছে, উচ্চারিত হয়েছে মানুষের মুখে মুখে, এমনকি ভাষার রাজনীতির মধ্যে পড়ে গেছে হাজার হাজার নিরীহ শব্দ, অভিধান থেকে বাদ দেয়া হয়েছে সংস্কৃতকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে। `তিরোধান` শব্দটি মৃত্যু অর্থে ব্যবহৃত, কিন্তু মহিমান্বিত বা যে মৃত্যুগুলোকে ফোকাস করা যাচ্ছে সেই ওজনও সে বহন করছে, অন্য শব্দে আমি মৃত্যুর যে মিনিং ক্রিয়েট করেছি সেই এসেন্স পাচ্ছিলাম না। আর মুসাবিদা মানে খসড়া। এটি আমাদের আদালতের বেশ সুপ্রচলিত শব্দ। মৃত্যুর খসড়া ব্যাপারটি বোঝানোর জন্য এর চেয়ে ভালো শব্দদ্বয় বোধহয় নাই, মানে আমার ভালো লাগেনি। তৈমুর রেজার প্রস্তাবিত নামটি আমি চিন্তা-বিবেচনা করেই গ্রহণ করি। অন্যান্য সময়ের মতো সেবারও তিনি আমার চিন্তাকে উস্কে দিয়েছিলেন, যেটা আমার ক্ষেত্রে তার দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে, কেননা আমি সেই দায়িত্ব তাকে দিয়েছিলাম, তিনি নিয়েছিলেন, এটা তার উদারতা, নিজের চিন্তার জন্য যেমন তিনি খাটাখাটনি করেছেন সীমাহীন, তেমনি আমাদের চিন্তার উন্নতির জন্যও ছিল তার বিশেষ শ্রম। যাই হোক, `রিসতা`র নামকরণের বেলায়ও একই কথা। দ্বিতীয় বইয়ের গল্পগুলোর বিষয় সম্পর্ক। আমি এমন শব্দ খুঁজছিলাম যেটা আমাকে সম্পর্ক বাচকতাও এনে দেবে আবার শৈল্পিকও, এছাড়া যুতসই তো বটেই। নোয়াখালিতে `রিসতা` বেশ মাহাত্ম্যযুক্ত শব্দ। বিয়ের সম্বন্ধে এই শব্দটির প্রয়োগ দেখা যায়। আমার মায়ের বাড়ি নোয়াখালি, ফলে সেখানকার ভাষাই আমার মাতৃভাষা। নোয়াখালিতে সম্পর্ক বিষয়ক এমন একটি শব্দ পেয়ে যাওয়ায় আমি মিস করতে চাচ্ছিলাম না। এটি মূলে ফারসি না আরবি তাও ভাবিনি। ভেবেছি, আমার মাতৃভাষার শব্দ এটি। উচ্চারণগত ভাবেও হিসাব মিলিয়েছি, সেখানে শব্দটি `স` রেখেই উচ্চারিত, মূল ভাষায় উচ্চারণ `শ`, এবং রিশতে। ফলে `রিসতা` বাংলা ভাষার শব্দ হিসাবেই অভিধানে থাকবে।

সরফরাজ: `রিসতা`য় সম্পর্কের ধরন কেমন? মানে, কিসের সম্পর্ক, কেমন সম্পর্কের প্রসঙ্গ?
মেহেদী:  মজার ব্যাপার হচ্ছে, পূর্ববাংলার সংখ্যাগরিষ্ট মানুষের যে সত্যিকার পরিচয় বাংলা সাহিত্যে তুলে ধরা হয়নি, সেই মানুষদের একুশ শতকে এসে ঘরে-বাইরে নানা রকম দ্বান্দ্বিক সম্পর্কে বন্দি করা হয়েছে— গণজাগরণ-হেফাজত, মুক্তিযোদ্ধা-ইসলামপন্থি, আস্তিক-ব্লগার, বৌদ্ধ-মুসলমান। মোটকথা, সব দ্বন্দ্ব যেন ইসলামকে ঘিরেই তৈরি। এই দ্বন্দ্বগুলোকেই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ফোকাস করা হচ্ছে আন্তার্জাতিক মিডিয়ায়। সে মোতাবেক গড়ে ওঠছে বাংলাদেশের ইমেজ। যা স্বাধীন জাতির জন্য হতাশাজনক। অথচ এর বাইরেও সম্পর্ক আছে এখানকার মানুষদের মধ্যে, পরিবর্তিত মধ্যবিত্তের মধ্যে, যারা একটি মুক্তিযুদ্ধের পর বদলে নিয়েছে নিজেদের। যারা চায় না তাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে কোনো গোষ্ঠী ইসলাম বনাম অন্যকিছু করে না তুলুক। এই মানুষরা এদেশে ছিল, আছে, থাকবে। এই শহরেই তাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের পর দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের জীবন-যাপন, সম্পর্কের পরিবর্তন ইত্যাদি নিয়েই ‘রিসতা’। এদেশে সম্পর্কের স্রোত কত দিকে কত বিচিত্ররূপে ধাবিত! শুধু ইসলাম বনাম কিছু একটা নয়। বইটিতে নাগরিক মধ্যবিত্তের বদলে যাওয়া রিসতা বা সম্পর্কের ভিন্ন আখ্যান রয়েছে। পুঁজিবাদী বিশ্বে একুশ শতকে প্রতিটি সম্পর্কে যুক্ত হয়েছে নতুন ও পরিবর্তিত মাত্রা। রাষ্ট্র-সরকার, সমাজ-পরিবার, জীবন-সংস্কৃতি, স্বামী-স্ত্রী, প্রেমিক-প্রেমিকা, বন্ধুত্ব ইত্যাদি সম্পর্কে লেগেছে নতুন সময়ের হাওয়া। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, বিশেষ করে ফেসবুক। গল্পগুলোতে এই সময়ের বদলে যাওয়া সম্পর্কের কথাই বলা হয়েছে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে। মূলত রিসতা নাগরিক মধ্যবিত্তের বদলে যাওয়া ‘রিশতা’। বইটিতে আমার প্রথম গল্প ‘কাছারি’ও রয়েছে। বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বরের জলোচ্ছ্বাসে প্রাণ হারানো মানুষদের। আমার দাদি হালিমা খাতুনও তাদের একজন। এতে ১৩টি গল্প আছে— রোদ-বৃষ্টির রোগী, সিংহবাড়ির কুত্তার ইতিহাস, ফুলের ফসল, সেনসেশন আউট, গ্রিন লাভ ইন, জায়া-পতির তালা-চাবি, বর্ষার স্মার্টফোন জলে ডুবে গেল, কালার হাউস, দুর্দান্ত নীল মত্ততা, জীবন তার খুলে গেছে পাখির ডিমের মতো ফুটে, আমার আম্মার স্বামী, কাছারি, দ্য সানি এক্সপেরিমেন্ট এবং রিসতা।

সরফরাজ: `জ্বাজ্জলিমান জুদা` শব্দদুটিও কি নোয়াখালি থেকে আমাদের সাহিত্যে এসেছে?
মেহেদী: হুম, ঠিক ধরেছেন। কিন্তু অনেকেই ভাবেন জ্বাজ্জলিমান বুঝি ফারসি শব্দ। এটি কিন্তু আমাদের খুব পরিচিত শব্দ `জ্বাজল্যমান` এর অপভ্রংশ। নোয়াখালিতে জ্বাজল্যমান শব্দটিকে জ্বাজ্জলিমান উচ্চারণ করা হয়। আর জুদা শব্দটিও নোয়াখালিতে সংসার `আলাদা` হয়ে যাওয়াকে বুঝায়। মানে একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে একক পরিবারে রূপ নিলে তারা সেটাকে `জুদা` হয়ে যাওয়া বলে। এভাবেই শব্দগুলো নোয়াখালি অঞ্চলের শব্দ, চাপিয়ে দেয়া বা আরোপিত কোনো অন্য ভাষার শব্দ নয়। এই শব্দগুলো ওখানে এতই গভীর যে, বাক্য গঠন করলে মনে হয় গভীর নলকূপ থেকেই কেউ পানি উঠালো। ফলে শব্দগুলোকে জাতীয় জীবন ও সাহিত্যের সাথে যুক্ত করতে চেয়েছি। আমার মায়ের ভাষা ও সংস্কৃতির মূল্য আমার কাছে অমূল্য রতন। এটাকে একপ্রকারের উত্তর ঔপনিবেশিক চেতনাও বলতে পারেন।

চলবে