শশী হকের চর্যানুবাদ
প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ০৮, ২০১৮
চর্যাপদ ১ (লুইপাদানাম্)
কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল।
চঞ্চল চীএ পইঠো কাল।।
দিঢ় অরিঅ মহাসুখ পরিমাণ।
লুই ভণই গুরু পুচ্ছিঅ জাণ।।
সঅল সমাহিঅ কাহি অরিঅই।
সুখ দুখেতেঁ নিচিত মরিঅই।।
এড়িএউ ছান্দক বান্ধ করণক পাটের আস।
সুনুপাখ ভিত্তি লেহু রে পাস।।
ভণই লুই আম্ হে ঝাণে দিঠা।
ধমণ চমণ বেণি পিণ্ডি বইঠা।।
চর্যানুবাদ ১
দেহ কল্পতরু, পাঁচখানা ডাল।
চঞ্চল চিত্তে প্রবেশে কাল।।
নিষ্ঠাসহ মহাসুখ করগা পরিমাণ।
লুই কয়, গুরুই প্রমাণ।।
সমাধিসবে কী বিহিত।
সুখ দুঃখ ভোগ, সেই তো মৃত্যু নিশ্চিত।।
ছাড় লকনা, ছন্দবন্ধ পারিপাট্য।
সাধনে নে শূন্যরূপপক্ষ।।
লুই ভনে, দেখি তা ধ্যানে।
ধমণ-চমণ বেণীর যুক্তাসনে।।
শব্দ-টীকা: কাআ- দেহ, তরুবর- বড় গাছ কিম্বা কল্পতরু, পঞ্চডাল- পঞ্চেন্দ্রিয়, সঅল সমাহিঅ- সমাধিসকল/সুখ রহিত মোক্ষ যা, চমণ- সূর্যনাড়ী, নিঃশ্বাস, ধমণ- চন্দ্রনাড়ী/প্রশ্বাস, বেনী- যুক্ত-যুগলের একত্ব।
চর্যাপদ ২ (কুক্কুরীপাদানাম্)
দুলি দুহি পিটা ধরণ না জাই।
রুখের তেন্তলি কুম্ভিরে খাঅ।।
আঙ্গন ঘরপণ সুন ভো বিআতী।
কানেট চৌরে নিল অধরাতি।।
সুসুরা নিদ গেল বহুড়ী জাগঅ।
কানেট চোরে নিল কা গই(ন) মাগঅ।।
দিবসই বহুড়ী কাড়ই ডরে ভাঅ।
রাতি ভইলে কামরু জাঅ।।
অইসন চর্য্যা কুক্কুরীপাএঁ গাইড়।
কোড়ি মঝেঁ একু হিঅহি সমাইড়।।
চর্যানুবাদ ২
কাছিম দুইয়ে আর পাত্র না-ধরে।
গাছের তেঁতুল খায় কুম্ভীরে।।
ঘরনী শোন্, ঘরই অঙ্গন।
নিশীরাতে চোর নেয় কর্ণাভরণ।।
শ্বশুর ঘুমে, বধূ জাগা।
কানেট চুরি গেলে বৃথাই মাগা।।
দিনে কাক-ডাক, বধূ ডরায়।
রাত ঘনালে সেই তো কামরূপে যায়।।
যে গান কুক্কুরীপা গাইছে।
কোটিমাঝে একজন তা বুঝেছে।।
শব্দ-টীকা: দুলি- মা-কচ্ছপ/দ্বৈততা যেখানে লীন হয় সেই মহাসুখকমল, রুখের তেন্তলি- গাছের তেতুল/দেহতরুর ফলস্বরূপ বোধিচিত্ত, কুম্ভীর- কুমীর/কুম্ভকসমাধি, আঙ্গন ঘরপণ- অর্থাৎ মন (আঙিনা/উঠান) ও দেহ (ঘর) অভিন্ন, বিআতী- বিবাহিতা, অবধূতী- নৈরাত্মা, কানেট- কর্ণাভরণ, দোষবিভব, চৌর- চোর/সহজানন্দরূপ, সুসুরা- শ্বশুর/ত্বরিত শ্বাস, কাড়ই- কাক/কায়কালপুরুষ, কামরু- কামরূপ/কামমুদ্রা/মহাসুখচক্ররূপ (স্বস্থানে)।
চর্যাপদ ৩ (বিরুবাপাদানাম্)
সে এক শুন্ডিনি দুই ঘরে সান্ধঅ।
চীঅণ বাকলঅ বারুণী বান্ধঅ।।
সহজে থির করি বারুণী সান্ধ।
জেঁ অজরামর হোই দিঢ় কান্ধ।।
দশমি দুআরত চিহ্ন দেখিআ।
আইল গরাহক অপণে বহিআ।।
চউশটি ঘড়িয়ে দেল পসারা।
পইঠেল গরাহক নাহি নিসারা।।
এক সে ঘড়লী সরুই নাল।
ভণন্তি বিরুআ থির করি চাল।।
চর্যানুবাদ ৩
শুঁড়িনি সে, দুইকে ঘরে ঢোকায়।
চিকন বাকল দিয়া মদ্য বানায়।।
সহজ গভীর করে পিয়ায় মদির।
অজর আর অমর হয়ে ধরে স্থির।।
রাগে দশম-দুয়ার, প্রমোদ-সুখে।
রসিক গ্রাহক আসে গন্ধ শুকে।।
চৌষট্টি ঘড়ায় পসরা সাজানো।
ঢোকা সহজ, যায় না বেরুনো।।
ছোট্ট সেই ঘড়াটির অতি সরু নালা।
বিরুয়া কয় ধীরে, সুস্থে চালা।।
শব্দ-টীকা: শুন্ডিনি- শুঁড়িনি/একস্বর রূপিণী, অবধূতিকা দুই- চন্দ্র ও সুর্য/ইরা ও পিঙ্গলা/বাম ও ডান দুই শ্বাস, চীঅন বাকলঅ- চিকন বাকল/অবিদ্যারহিত কর্ম, বারুণী- মদ্য/বোধিচিত্তরূপ মহাসুখকমলরস. দশমি দুআরত- দশম দুয়ারে/বৈরোচনদ্বারে/জননদ্বারে, চিহ্ন- মহারাগসুখ-প্রমোদ, গরাহক- গ্রাহক/গন্ধর্ব্বসত্ত্ব, ঘরলী- ছোট ঘড়া বা ঘটি।
চর্যাপদ ৪ (গুন্ডরীপাদানাম্)
তিয়ন্ডা চাপী জোইনি দে অঙ্কবালী ।
কমলকুলিশ ঘাণ্টি করহুঁ বিআলী ।।
জোইনি তঁই বিনু খনহিঁ ন জীবমি ।
তো মুহ চুম্বী কমলরস পীবমি।।
খেপহুঁ জোইনি লেপ ন জাঅ ।
মণিকুলে বহিআ ওড়িআণে অমাঅ ।।
সাসু ঘরেঁ ঘালি কোঞ্চা তাল।
চান্দসুজবেণী পখা ফাল ।।
ভণই গুন্ডরী অম্হে কুন্দুরে বীরা ।
নরঅ নারী মাঝেঁ উভিল চীরা ।।
চর্যানুবাদ ৪
ও যোগিনী, তিনকে সেধে দেখা স্বরূপ।
পদ্মে বজ্র ঘষে রুখ কালরূপ।।
তোকে ছাড়া আমি, বাঁচি না একপল।
অধর চুমে চুমে পীয়াই কমল।।
ও যোগিনী, ক্ষ্যাপনে তুই যাস্নে ছিঁড়ে।
মণিকুল ঘুরে ফের আসিস্ ফিরে।।
শাশুরী কপাটে আটে তালা।
কাটে বেণীবন্ধ, চন্দ্র-সুর্য-পালা।।
গুন্ডরীপা ভনে, আমি তন্ত্রের বীর।
নর ও নারীর মাঝে উঁচাই যোগীর চীর।।
শব্দ-টীকা: তিয়ড্ডা- ললনা/রসনা ও অবধূতিকা- এই তিনটি নাড়ি, অঙ্কবালী- অঙ্ক, স্বচিহ্ন অর্থাৎ স্বরূপ; বালী, পালি, পারাবত পালন, কমলরস- বোধিচিত্তরূপ, খেপহুঁ- স্বস্থান থেকে উৎক্ষিপ্ত, মণিকুল- মোহমল, অড়িআনে- উড্ডীয়ানে/উড়ানে/মহাসুখচক্রে, সাসু- শাশুড়ি, শ্বাস (সান্ধ্য ভাষায়), চান্দসুজবেণী- চন্দ্র সূর্যের বেণী, ইরা ও পিঙ্গলা বা ডানবাম নাকের পালাক্রম শ্বাসপ্রবাহ, কুন্দুরে- কুন্দুরেণ (হঠযোগের পারিভাষিক শব্দ) থেকে, ক্লেশরূপ শত্রু মর্দনের যোগানুষ্ঠান দ্বারা, চীরা- চীর, ঊর্ধ্বলোকবাসী যোগীর বস্ত্রখণ্ড বা বল্কল।