শান্তিনিকেতন ও সৈয়দ মুজতবা আলী

রিফাত বিন সালাম

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২৮, ২০১৮

শান্তিনিকেতনে অসংখ্য মুসলিম ছাত্র পড়াশোনা করে। এখনে কে হিন্দু আর কে মুসলিম, কেবা পার্সি সেটা নিয়ে কারো বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নাই। এখন বিষয়টা খুবই স্বাভাবিক মনে হলেও শুরুর দিকে সেটা নিয়ে জটিলতা কম ছিল না। কারণ ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথের মতো সকলেই তখনো অতোটা উদার চিন্তার ছিলেন না। শিক্ষাক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের অসাম্প্রদায়িক পদক্ষেপ ছিল ঐতিহাসিক। সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘আমার অন্তর্জগৎ রবীন্দ্রনাথের গড়া’ লেখায় রবীন্দ্রনাথের সেই অসাম্প্রদায়িক চিন্তার নজির পাওয়া যায়। অনলাইনে একটা লেখা পেয়েছিলাম অনেকদিন আগে, তাদের অনুমতি নিয়েই এটা কিছুটা পরিবর্তন করে দিলাম। নানা বিষয় উঠে এসেছে এ লেখায়।

অনেককাল আগের কথা। শান্তিনিকেতনের ‘বোর্ডিং বিদ্যালয়ে’ একটি মুসলমান ছাত্রকে গ্রহণ করার জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেখানকার প্রধান শিক্ষক নেপালচন্দ্র রায়কে বারবার অনুরোধ করেছিলেন। ছেলেটির নাম ছিল রবীন্দ্র কাজী, সে আগরতলার ডা. কাজীর পুত্র। রবীন্দ্রনাথের আশংকা ছিল, আশ্রমের ট্রাস্টি দ্বীপেন্দ্রনাথের এতে আপত্তি হবে, নেপালচন্দ্রও তত উৎসাহ দেখাননি। নেপালচন্দ্রকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠি, ‘মুসলমান ছাত্রটির সঙ্গে একটি চাকর দিতে তাহার পিতা রাজি। অতএব, এমনকি অসুবিধা, ছাত্রদের মধ্যে এবং অধ্যাপকদের মধ্যেও যাহাদের আপত্তি নাই তাহারা তাহার সঙ্গে একত্র খাইবেন। শুধু তাই নয়– সেই সকল ছাত্রের সঙ্গেই ওই বালকটিকে এক ঘরে রাখিলে সে নিজেকে নিতান্ত যূথভ্রষ্ট বলিয়া অনুভব করিবে না। …আপাতত শালবাগানের দুই ঘরে নগেন আইচের তত্ত্বাবধানে আরও গুটিকয়েক ছাত্রের সঙ্গে একত্র রাখিলে কেন অসুবিধা হইবে বুঝিতে পারিতেছি না।

আপনারা মুসলমান রুটিওয়ালা পর্যন্ত চালাইয়া দিতে চান, ছাত্র কি অপরাধ করিল? এক সঙ্গে হিন্দু–মুসলমান কি এক শ্রেণিতে পড়িতে বা একই সঙ্গে খেলা করিতে পারে না? …প্রাচীন তপোবনে বাঘে–গরুতে একঘাটে জল খাইত, আধুনিক তপোবনে যদি হিন্দু–মুসলমান একত্রে জল না খায় তবে আমাদের সমস্ত তপস্যাই মিথ্যা। আবার একবার বিবেচনা করিবেন ও চেষ্টা করিবেন যে, আপনাদের আশ্রমদ্বারে আসিয়াছে তাহাকে ফিরাইয়া দিবেন না– যিনি সর্বজনের একমাত্র ভগবান তাহার নাম করিয়া প্রসন্নমনে নিশ্চিন্ত চিত্তে এই বালককে গ্রহণ করুন: আপাতত যদি কিছু অসুবিধা ঘটে সমস্ত কাটিয়া গিয়া মঙ্গল হইবে।’

গ্রহণ করে হয়েছিল কিনা সেটি নিয়ে আর বিস্তারিত পাওয়া যায়নি। শান্তিনিকেতনে প্রথম বা দ্বিতীয় মুসলমান ছাত্র প্রবেশ করেন মুজতবা আলী, ওই ঘটনার দশ বছর পর। শান্তিনিকেতনে এলেন ১৯২১–এর জুলাই মাসে– সে তারিখ নিয়েও বিভ্রান্তি আছে। এমনকি বিভ্রান্তি আছে শান্তিনিকেতনের তিনি প্রথম স্নাতক ছিলেন কিনা তাই নিয়ে। তবে ১৯২১ থেকে ১৯২৬ পর্যন্ত যে তিনি শান্তিনিকেতনের কলেজ পর্যায়ের ছাত্র ছিলেন এ সম্বন্ধে মোটামুটি নিশ্চিত সাক্ষ্যপ্রমাণ বিশ্বভারতীতে মজুদ আছে। সুন্দর দেখতে ছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলী, তকতকে ফর্সা গায়ের রং, বিদেশিদের সাথে ভুল করে মিলিয়ে ফেলতো অনেকেই, তাঁর ডাকনাম ছিল- সিতারা, সংক্ষেপে সিতু।

১৯৩১ সালে মুজতবার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কথোপকথন, লেখকের নিজের ভাষায়, ‘বলতে পারিস সেই মহাপুরুষ কবে আসবেন কাঁচি হাতে করে?‘ আমি অবাক। মহাপুরুষ তো আসেন ভগবানের বাণী নিয়ে, অথবা শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্ম নিয়ে। কাঁচি হাতে করে? ‘হাঁ হাঁ কাঁচি নিয়ে। সেই কাঁচি দিয়ে সামনের দাড়ি ছেঁটে দেবেন, পেছনের টিকি কেটে দেবেন। সব চুরমার করে একাকার করে দেবেন। হিন্দু–মুসলমান আর কতদিন আলাদা হয়ে থাকবে?’

‘প্রথম সাক্ষাতে গুরুদেব জিজ্ঞাসা করলেন, কি পড়তে চাও? আমি বললুম, তা তো ঠিক জানিনে, তবে কোনো একটা জিনিস খুব ভালো করে শিখতে চাই। তিনি বললেন, নানা জিনিস শিখতে আপত্তি কী? আমি বললুম, মনকে চারদিকে ছড়িয়ে দিলে কোনো জিনিস বোধ হয় ভালো করে শেখা যায় না। গুরুদেব আমার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, একথা কে বলেছে? আমার বয়স তখন সতেরো– থতমত খেয়ে বললুম, কনান ডয়েল। গুরুদেব বললেন, ইংরেজের পক্ষে এ বলা আশ্চর্য নয়।

কাজেই ঠিক করলুম, অনেক কিছু শিখতে হবে। সম্ভব অসম্ভব বহু ব্যাপারে ঝাঁপিয়ে পড়লুম। গুরুদেবের সঙ্গে তখন সাক্ষাৎ হতো ইংরেজি ও বাংলা ক্লাসে। তিনি শেলি, কীটস আর বলাকা পড়াতেন`।

জানা যায়, বিশ্বভারতীতে পড়াশুনা করার সময় মুজতবা আলী একবার রবীন্দ্রনাথের হাতের লেখা নকল করে ভুয়া নোটিশ দিয়েছিলেন, ‘আজ ক্লাশ ছুটি’। সবাই মনে করেছিল রবীন্দ্রনাথ ছুটি দিয়ে দিয়েছেন! সিলেটে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেটা ১৯১৯ সালের কথা। নোবেল বিজয়ী কবি স্থানীয় ছাত্রদের উদ্দেশে যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন, তার বিষয় ছিল আকাঙ্ক্ষা। কিশোর মুজতবা আলী কারও সঙ্গে কোনোরকম শলাপরামর্শ না করেই একটা চিঠি লিখে ফেললেন রবীন্দ্রনাথকে।

সেই চিঠিতে তিনি জানতে চাইলেন, ‘আকাঙ্ক্ষা উচ্চ করতে হলে কী করা প্রয়োজন?’ সিলেট সফর শেষ করে রবীন্দ্রনাথ গিয়েছিলেন আগরতলায়। সপ্তাহখানেক পরেই কবির কাছ থেকে চিঠির উত্তর পেলেন কিশোর মুজতবা। খামের রং আসমানি। চিঠির কাগজও একই রংয়ের। রবীন্দ্রনাথ জবাবে লেখেন, ‘আকাঙ্ক্ষা উচ্চ করিতে হইবে— এই কথাটার মোটামুটি অর্থ এই— স্বার্থই যেন মানুষের কাম্য না হয়। দেশের মঙ্গলের জন্য ও জনসেবার জন্য স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগ কামনাই মানুষকে কল্যাণের পথে নিয়ে যায়। তোমার পক্ষে কী করা উচিত তা এতদূর থেকে বলে দেয়া সম্ভব নয়। তবে তোমার অন্তরের শুভেচ্ছাই তোমাকে কল্যাণের পথে নিয়ে যাবে।’

রবীন্দ্রনাথ এবং শান্তিনিকেতন মুজতবাকে জ্ঞান ও দীক্ষার এমন এক বহুত্বের দিকে ঠেলে দিলেন যে, তিনি তার সম্পূর্ণ স্বাদ গ্রহণ করতে করতে পদে পদে নিজেকে সমৃদ্ধ করতে লাগলেন। ভাষা শিখতে শুরু করলেন জার্মান, ফরাসি, ইংরেজি ও হিন্দি। রুশ প্রাচ্যবিদ পণ্ডিত পিতার বোগদানোফের কাছে শিখতে লাগলেন আরবি ও ফারসি। অন্য আরেকটি সূত্রে প্রকাশ, শান্তিনিকেতন এ মুজতবা বহু ভাষা শেখার সুযোগ পান। সংস্কৃত, সাংখ্য, বেদান্ত, ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান, ফারসি, আরবি, রুশ, ইতালিয়ান, উর্দু, হিন্দিসহ ১৭/১৮ টা ভাষা দখলে চলে আসে। সংস্কৃত, সাংখ্য ও বেদান্ত শিখলেন– ফরমিকি এবং বিধুশেখর শাস্ত্রীর কাছে। ড. মার্ক কলিন্সের কাছে ইংরেজি, ফরাসি ও জার্মান। তুচ্চির কাছে ইতালিয়ান। বগ্ দানফের কাছে আরবি ও ফার্সী।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ কবিতা এবং ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ প্রবন্ধ তাঁর মুখস্থ ছিল। এই প্রসঙ্গে আরো একটি উদাহরণ সেটি রবীন্দ্র আমলের অনেক পরে, আনন্দ বাজারের অন্যতম স্বত্বাধিকারী– প্রফুল্ল চন্দ্র সরকারের শ্রাদ্ধ বাসরে গেছেন নিমন্ত্রণ পেয়ে। উপস্থিত ব্রাহ্মণরা নাক সিঁটকেছে তাঁকে দেখে। গীতা পাঠে ভুল হচ্ছে দেখে বলাতে শুনতে হয়েছিল, তুমি মুসলমান, গীতার কি জানো হে? অনর্গল মুখস্থ বলে গেলেন বই না দেখে। আর সব চুপ!

এছাড়া এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ পাশ্চাত্যের মহা মহাপণ্ডিতকে শান্তিনিকেতনে ডেকে আনছেন– ‘সিলভ্যা লেভি, মরিস, কলিন্স, অ্যান্ড্রুজ, বেনোয়া, বোগদানোফ, ফ্লাউম, তুচ্চি, ফর্মিকি’ যেমন– আর তাদের সঙ্গে যুক্ত হলেন ভারতের বিধুশেখর শাস্ত্রী, ক্ষিতিমোহন সেন, জগদানন্দ রায় প্রমুখ– তাদের ক্লাসে না বসে মুজতবার উপায় ছিল না। কারণ একেবারে প্রথম থেকেই তিনি বিরল মুসলমান ছাত্র হিসেবে নয়, উদ্যমী ও উজ্জ্বল ছাত্র হিসেবে একেবারে প্রথম সারিতে এসে পৌঁছেছেন। তখন বিশ্বভারতী সম্মিলনী নামে ছাত্র ও শিক্ষকদের যে সমিতি গড়ে উঠেছিল, তার একাধিক অধিবেশনে তরুণ মুজতবাকে বিচিত্র বিষয়ে প্রবন্ধ পড়তে এগিয়ে আসতে দেখি।

১৩২৮ তারিখের অধিবেশনে সভাপতিত্ব করছেন রবীন্দ্রনাথ, মুজতবা আলী প্রবন্ধ পড়ছেন ঈদ উৎসব সম্বন্ধে। সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সভার শেষে ‘প্রবন্ধ লেখককে ধন্যবাদ ও আশীর্বাদ জ্ঞাপন করেন।’ ১৩ মাঘ, ১৩২৮–এর সভায় সভাপতি বিধুশেখর শাস্ত্রী, মুজতবা পড়ছেন ‘শিশুমারী’ সম্বন্ধে একটি সুচিন্তিত ও সুলিখিত প্রবন্ধ। ১০ শ্রাবণ ১৩৩০–এর সভায় সভাপতি মুজতবা আলী, প্রমথনাথ বিশী সে সভায় পাঠ করেছেন রথযাত্রা নাটক, যা রবীন্দ্রনাথকে রথের রশি লেখার প্রেরণা দিয়েছিল। ২৬ শ্রাবণ ১৩৩০–এর সভায় মুজতবা আবার পাঠ করেন আন্তন চেখফের ছোটগল্প সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ– তাও উচ্চ প্রশংসিত হয়। ১৩৩১ সালে সমিতির সম্পাদক নির্বাচিত হন মুজতবা এবং পরের বছরেও তার সম্পাদকত্ব বহাল থাকে। এর মধ্যে সমিতির বিতর্ক সভাতেও তাকে সোৎসাহে যোগ দিতে দেখি। সমিতির হাতের লেখা পত্রিকা ‘বিশ্বভারতী’তেও এই সময়ে মুজতবার একাধিক রচনা প্রকাশিত হয়েছে। তার প্রথম গল্প ‘নেড়ে’, ‘রবীন্দ্রনাথ ও স্পিটলার’ নামে একটি প্রবন্ধ এবং ‘শ্রীহট্টের দুই একটি গীত’ ইত্যাদি বিচিত্র বিষয়ে লিখছেন তিনি।

উল্লেখ্য, বাংলা সাহিত্যের আকাশে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের হাতে গড়া দুজন সাহিত্যিক বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী কৃতিত্বের সাক্ষর রেখেছেন তাদের একজন হলেন প্রমথনাথ বিশী ও অন্যজন সৈয়দ মুজতবা আলী। শান্তিনিকেতনের একটি অনুপম চিত্র ফুটে উঠেছে তার গুরুদেব ও শান্তিনিকেতন বইয়ে। এতে রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে দ্বিজেন্দ্রনাথ, বিধুশেখর, ক্ষিতিমোহন, মহাত্মা গান্ধী প্রভৃতি গুরুতর মানুষদের কথা আছে, আছে বাচুভাই শুক্ল, প্রমথনাথ বিশী প্রভৃতি সমপাঠীদের হৃদ্য স্মৃতিচারণ।

মুজতবা আলীর ইচ্ছে, ছিল শান্তিনিকেতন নিয়ে লেখার। জীবন সায়াহ্নে এসে অনেকের কাছে নিজের আগ্রহের কথা জানিয়েছিলেনও তিনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর তা লিখতে পারেননি। ১৯৬১ সালে সেখানে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে যে অনুষ্ঠানাদি হয়, সেসব তাঁর বিন্দুমাত্র পছন্দ হয়নি। এই প্রসঙ্গে কথাশিল্পী রাজশেখর বসুর নাতি দীপংকর বসুকে তিনি বলেছিলেন: ‘এখানে যা হয়েছে তা অবর্ণনীয়। বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথকে কেউ স্মরণ করেনি। করেছে পোয়েট টেগোরকে। প্রধান পুরোহিত ছিলেন পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু ও সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন। এঁরা তো ‘সোনার বাংলার’ কবি রবিঠাকুরকে চেনেন না; এঁরা চেনে গীট্যানজলি, চিট্রা, স্যাডনার (সাধনা) লেখক মিস্টার টেগোরকে। আর তাবৎ কার্যক্রম ইংরাজিতে! আমি অবশ্য কোনো পরবে যাইনি বেতারে যা শুনেছি তার থেকে বলছি।’

অল ইন্ডিয়া রেডিওর চাকরি চূড়ান্তভাবে ছেড়ে দেবার পর সৈয়দ মুজতবা আলী কলকাতায় ফিরে এলেন আবারও, ১৯৫৭ সালে। চাকরি নেই, বয়স বাড়ছে, শরীরও আগের তুলনায় দুর্বল। সামনের দিনগুলো কীভাবে কাটবে তাই নিয়ে দুশ্চিন্তার অন্ত না থাকলেও আশেপাশে ভরসা জোগাবার মতো মানুষ কম। কলকাতার একাধিক বৃহৎ পুঁজির পত্রিকাগোষ্ঠী তাঁর কাছ থেকে লেখা চায়, কিন্তু উল্টোদিকে তাঁকে একটা সম্মানজনক বেতনে চাকরি দেবার ব্যাপারে সেসব প্রতিষ্ঠানের বড়ই অনীহা। জীবিকা নিয়ে অস্থির অবস্থার মধ্যেই মুজতবা আলী কলকাতার পাট চুকিয়ে চলে গেলেন শান্তিনিকেতনে। সম্ভবত কলকাতায় এত পরিচিতজন থাকা সত্ত্বেও তাঁর কোনো কাজের ব্যবস্থা হলো না, এই বিষয়টি তাঁর মনঃপীড়ার কারণ হয়েছিল। তাই নিজের তারুণ্যের চারণভূমিতে গিয়েই স্বস্তি পেতে চাইছিলেন। তিনি শান্তিনিকেতনের গুরুপল্লীতে একটি বাসা ভাড়া করে সেখানে থাকতে শুরু করেন ১৯৫৭-র ফেব্রুয়ারি মাসে।

ওই মাসের ৮ ফেব্রুয়ারি অমলেন্দু সেনকে এক চিঠিতে ভয়ানক অভিমানের সঙ্গে লিখলেন: ‘চাকরি ছেড়ে দিয়ে এখানে একটি বাসা ভাড়া করে বাড়ি করেছি। অর্থাৎ এ স্থান আমি জীবনে ত্যাগ করতে চাইনে। দিবারাত্র সেই প্রার্থনাই করছি। এখানে এসেছি মৃত্যুর জন্য তৈরি হবার জন্য। পেটের ভাতের জন্য লিখতে হবে। সেইটুকু লিখবো। এবং কোনোদিন যদি লেখা বন্ধ করেও পেটের ভাত জোটে তবে চেষ্টা করবো, বই-পড়া থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্য। আমি এ জীবনে কলকাতা আর পারতপক্ষে যাবো না।’ এর পরে বিশ্বভারতীতে তার চাকরি হয়, ইসলামি সংস্কৃতির হেড হিসাবে আদ্যপান্ত নাস্তিক মুজতবা আলী নিয়োগ পান একপর্যায়ে, আবার জার্মান ভাষা শেখানোর দায়িত্বও পান তিনি। হযরত মুহম্মদ (সা.) নিয়ে বিস্তারিতভাবে গবেষণাধর্মী জীবনী লেখার আগ্রহ দেখিয়েছিলেন তিনি এবং বিশ্বভারতীও এগিয়ে এসেছিলো সে প্রস্তাবে, তবে কি কারণে সেটি আর হয়ে ওঠেনি তা আর জানা যায়নি।

শান্তিনিকেতনে চলে আসার পরও মুজতবা আলী মানসিকভাবে খুব শান্তি পেয়েছিলেন বলে মনে হয় না। আর্থিক কষ্ট তাঁকে থিতু হতে দিচ্ছিল না। তাছাড়া, তারুণ্যে দেখা বর্ণিল শান্তিনিকেতনের সঙ্গে তিনি রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুপরবর্তী এই শান্তিনিকেতনকে মেলাতে পারছিলেন না। সেই বন্ধুবৎসল পরিবেশ সেখানে তখন উধাও, সঙ্গ দেবার মতো বন্ধুরাও তেমন কেউ আর নেই। উল্টো চারিদিকে ঈর্ষাকাতরতা আর হীনম্মন্যতার প্রকাশ। ১৯৫৭ থেকে ১৯৬১ সাল অব্দি শান্তিনিকেতনে মুজতবার জীবনব্যয় লেখালেখি হতে প্রাপ্ত পারিশ্রমিক দিয়েই মূলত নির্বাহ হতো।

১৯৬৪ সালে মুজতবা আলীর বিরুদ্ধে কলকাতার কিছু পত্র-পত্রিকাও ভিন্ন কারণে কুৎসা রটনা শুরু করেছিল। ওই বছর শারদীয় বেতার জগৎ পত্রিকায় বহু আগে দেওয়া তাঁর এক বেতার ভাষণ পুনর্মুদ্রিত হয়েছিল, সেটি নিয়ে যুগান্তর পত্রিকার ‘বেতার-সমালোচনা’ বিভাগে এক লেখক যারপরনাই মিথ্যাচার করেন। মুজতবা আলীর বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক আচরণের অভিযোগ আনা হয়। এমনও বলা হয়, তিনি নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে হিন্দুধর্মের ওপর আঘাত হেনেছেন ধর্মনিরপেক্ষ ভারতবর্ষের সুযোগ নিয়ে! ওই লেখকের কুৎসা-রটনা ও মিথ্যাচারের বিপক্ষে কলম ধরে মুজতবা আলীর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন পরিমল গোস্বামী।

তিনি একটি দীর্ঘ পত্র-প্রবন্ধ লিখে মুজতবার বিরুদ্ধে করা অসার অভিযোগগুলোর সব কটিই খণ্ডন করেন। পরিমল গোস্বামী ঘটনাটির প্রতিবাদ করেছেন জেনে, ‘আমি অনিদ্রায় কাতর এই গরমি কাল থেকে। মফস্বলে বিশেষ কাগজের বিশেষ সংখ্যা পাওয়া প্রায় অসম্ভব। তবু ব্রাদার তুমিই পাঠাও। ইতিমধ্যে ঢাকায় একটি কাগজে এডিটোরিয়ালরূপে সিরিয়াল বেরচ্ছে আমার বিরুদ্ধে আমি হেঁদু হয়ে গিয়েছি। সে সব আর এখানে তুলছি না। পুনরায় নিবেদন, এসব লড়াইয়ে তুমি কি জিতবে! আর আমিই বা যাই কোথায়? ওরা বলে আমি কাফের, এরা বলে আমি লেড়ে। ভালোই, রাইকুল শ্যামকুল দুই-ই গেল। নিশ্চিন্ত হওয়া গেল।’

‘স্বাধীনচেতা মুজতবা আলী সারা জীবন এক ভবঘুরে জীবনযাপন করলেন। কোথাও স্থায়ীভাবে থাকলেন না। পাকিস্তানের কট্টরপন্থীরা তাকে ‘ভারতের দালাল’ অপবাদ দিয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছিল। কলকাতায় জনপ্রিয়তা, সুনাম, পুরস্কার সবই পেলেন, তবে কলকাতার রক্ষণশীল লেখকসমাজ তাকে ঈর্ষা করত, ছড়িয়ে বেড়াত যে, ‘মুজতবা আলীর ধর্মনিরপেক্ষ উদার দৃষ্টিভঙ্গি একটা আই ওয়াশ, আসলে আলী একজন ধুরন্ধর পাকিস্তানি এজেন্ট। দুর্বল মুহূর্তে দুঃখ করে তার গুণগ্রাহী আরেক বিখ্যাত লেখক শংকরকে বলে ছিলেন, ‘এক একটা লোক থাকে যে সব জায়গায় ছন্দ পতন ঘটায়, আমি বোধহয় সেই রকম লোক।’

আরেকটি ঘটনা কথিকার মাধ্যমে জানান মুজতবা আলীই: মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে রবীন্দ্রনাথ ‘সভ্যতার সঙ্কট’ নাম দিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখলেন। কোনো এক ইংরেজ কংগ্রেস, গান্ধিজি এদের নিয়ে কড়া কড়া মন্তব্য প্রকাশ করেছিলেন। এরা তখন জেলে ছিলেন। কাজেই রবীন্দ্রনাথ তখন সেটা লিখলেন। তাতে তিনি সেই ইংরেজকে এমন চুটিয়ে গালাগাল দিলেন, শেষটায় একজন ভীত হয়ে বললেন, ‘গুরুদেব, এটা কি ছাপানো ঠিক হবে? যদি ইংরেজ গোলমাল করে?’

রবীন্দ্রনাথ তখন বললেন, ‘দেখ, আমি প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের নাতি। আমার পিতা ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ধর্ম সংস্কার করেছিলেন। আমি বিশ্বকবি, নোবেল প্রাইজ পেয়েছি। দেশ-বিদেশে সম্মান পেয়েছি। এখন যদি ইংরেজ আমাকে জেলে পোরে, আর আমি যদি মরে যাই- মরব নিশ্চয়; তখন কী হবে? Martyr (শহীদ) হয়ে মরব। এতগুলো সম্মানের উপরে A great poet then passed away as martyr in a tiny cell of British prison. এই যে luxury, সেটা কি ইংরেজ আমাকে Indulge করতে দেবে? তা দেবে না। ইংরেজ আমাকে ধরে নিয়ে যাবে না।

সৈয়দ মুজতবা আলী রবীন্দ্রনাথকে ঘটনা ও ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে রেখে সামগ্রিক অর্থে দেখতে চেয়েছেন সবসময়। যেমন রবীন্দ্রনাথ আর্জেন্টিনার বুয়োনোস আইরেসে থাকাকালে রচিত ‘চিঠি’ নামক কবিতাটি সহজ বিশ্লেষণে মুজতবা আলী উপস্থাপন করেছেন কথিকা যেখান থেকে দুটি লাইন,

দুঃখ সহার তপস্যাতেই হোক বাঙালির জয়
ভয়কে যারা মানে তারাই জাগিয়ে রাখে ভয়
মৃত্যুকে যে এড়িয়ে চলে মত্যু তারেই টানে
মত্যু যারা বুক পেতে লয় বাঁচতে তারাই জানে।

তথ্যসূত্র: রবিজীবনী: প্রশান্তকুমার পাল, প্রবন্ধ- রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক পবিত্র সরকার, ১৯৭২/৭৩, ৭৩/৭৪ সালে ধারণকৃত রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কিত সৈয়দ মুজতবা আলীর বেতার-কথনের দুইটি অডিও ইউ টিউব, সৈয়দ মোস্তফা আলী, মুজতবা প্রসঙ্গ, ই লাইব্রেরি, আর কিছু অনলাইনে পাওয়া তথ্য।

 

লেখক: কবি, কার্টুনিস্ট, কলামিস্ট ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী