শান্তিভবন

বৈতরণী হক

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০১৮

ভীমরাও রামজি আম্বেদকর নামটা হয়তো আমাদের অনেকের শোনা। মি. আম্বেদকর ভারতের দলিত সম্প্রদায়ের কাছে দেবতাতূল্য, তাই তিনি তাদের দাদাসাহেব। আম্বেদকর জন্মেছিলেন ভারতের এক দলিত পরিবারে। বড় হয়েছেন মানুষের চোখে তাদের সম্প্রদায়ের জন্য ঘৃণা দেখে। অদম্য আত্মবিশ্বাসী ভীমরাও নিজের মেধা আর চেষ্টার গুণে হয়েছিলেন স্বাধীন ভারতের প্রথম আইনমন্ত্রী। তিনি ভারতের সংবিধান স্থাপনার অন্যতম প্রণেতা।

আম্বেদকর ভালোবাসতেন দলিত সম্প্রদায়ের নির্যাতিত মানুষগুলোকে। আর তাই গড়ে তুলেছিলেন Scheduled Castes Federation নামে একটি রাজনৈতিক দল। দাদাসাহেব পেয়েছেন তার অবদানের জন্য ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ভারতরত্ন। আজ উনি ভারতের নিগৃ্হীত দলিতদের মাঝে নেই। তবে রেখে গেছেন তার ছায়া অনেক হৃদয়বান মানুষের মাঝে, যারা বাবাসাহেবের পদাংক অনুসরণ করে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে দলিত শ্রেণির মানুষের কল্যাণে।

ড. আব্রাহাম জর্জ তাদের একজন। ১৯৪৬ সালে তিনি ভারতের কেরালা রাজ্যে জন্মগ্রহণ করেন। তরুণ বয়সে যোগদান করেন ভারতীয় সেনাবাহিনীতে। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার জন্য পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। ভেবেছিলেন, উন্নত চিকিৎসা শেষে ফিরে আসবেন ভারতে। তবে সে যাত্রায় আর তার আসা হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রে উনি পড়াশোনাতে পূর্ণ মনোনিবেশ করেন। লাভ করেন অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি। যোগদান করেন অধ্যাপনায়। পরবর্তীতে ড. জর্জ সফটওয়্যারের ব্যবসাতেও নিয়োজিত ছিলেন। স্ত্রী আর দুই সন্তান নিয়ে ভালোই কাটছিল তার জীবন। কিন্তু হঠাৎ করেই উনি একটা বড় ধরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফেলেন। তার সকল ব্যবসা বিক্রি করে দিয়ে পাড়ি জমালেন ভারতে। ৪৯ বছর বয়সী জর্জ ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠা করলেন জর্জ ফাউন্ডেশন নামে একটি চ্যারিটি সংস্থা, যার মূল অফিস ব্যাংগালোরে।

এ ফাউন্ডেশনের মূল উদ্দেশ্য ছিল তামিলনাড়ু, কেরালা ও কর্ণাটকের গরিব অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো। আর এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় শান্তিভবন চিলড্রেন ট্রাস্ট। ব্যাংগালোরে অবস্থিত এ স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করা হয় ভারতের দলিত সম্প্রদায়ের বাচ্চাদের উন্নত জীবন প্রদানের উদ্দেশ্যে। পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধূলা, জীবন দর্শন, সামাজিক দায়বদ্ধতা, সংস্কৃতি সবকিছুতে তাদের পারদর্শী করে তোলার অভিপ্রায় থেকেই শুরু হয় শান্তিভবনের পথচলা। ২০০৮ সালে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে থমকে যাওয়ার উপক্রম হয় শান্তিভবন। তখন আব্রাহাম তার পুত্র আর সহযোগী অজিত জর্জের পরামর্শে শান্তিভবন চিলড্রেন ট্রাস্টকে একটি আলাদা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেন। বর্তমানে শান্তিভবন সম্পূর্ণভাবে পরিচালিত হচ্ছে ব্যক্তিগত অর্থায়নে, করপোরেট ও এনজিওদের পার্টনারশিপ আর গ্র্যান্টসের মাধ্যমে।

শান্তিভবনে প্রতিবছর দলিত পরিবারগুলো থেকে ১২ জন ছেলে আর ১২ জন মেয়েকে ভর্তি করা হয়। তারা স্কুলে আসে চার বছর বয়সে। প্রতিটা পরিবার থেকে একজন বাচ্চাই সুযোগ পায় এ স্কুলে পড়ার। এর প্রধান কারণ হলো, একটি দলিত পরিবার থেকে একটি বাচ্চা যদি সুযোগ্য হয়ে গড়ে ওঠে তবে সে তার পরিবারের দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারবে। আর এভাবেই অনেকগুলো পরিবার অর্থনৈতিক উন্নয়নের আওতায় আসবে। শান্তিভবনে যেসকল বাচ্চারা আসে তাদের সিংহভাগের পরিবারের দৈনিক আয় দুই ডলারের কম। তার মানে তারা দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। সম্পূর্ণ বিনাখরচে এসব শিশুরা উন্নত জীবনের সকল সুবিধা ভোগ করে শান্তিভবনে। স্কুলপাশ করার পর কলেজের খরচও বহন করে শান্তিভবন। বছরে দু’বার শীত আর গ্রীষ্মকালীন সময়ে তারা বাড়ি যায়। জীবনের ১২টা বছর তাদের কেটে যায় শান্তিভবনের শান্তির জীবনে।

অস্কার বিজয়ী ছবি নির্মাতা ভাবেসা রুথের নির্মিত ডকুমেন্টরি সিরিজ Daughters of Destiny তে উঠে এসেছে শান্তিভবনের অনেক কথা। সেই সকল দলিত শ্রেণির মেয়েদের একটু একটু করে বেড়ে ওঠার গল্প। শান্তিভবনে বাস করে যেসব মেয়েরা তাদের জীবনযাত্রা ও চিন্তাধারা ভিন্নভাবে গড়ে ওঠে, যেটা তাদের পরিবারের সাথে মেলে না। ছুটিতে যখন তারা তাদের পরিবারের কাছে যায়, তাদের মানিয়ে নিতে বেশ বেগ পেতে হয়। তাদের এই আধুনিক চিন্তাধারাকে তাদের পরিবারের সদস্যরাও মেনে নিতে পারে না। এক অন্যরকম সমস্যার মধ্যে দিয়ে তাদের জীবনটা প্রবাহিত হয়। আর এসকল প্রতিকূলতা পাড়ি দিয়ে কীভাবে সামনে এগিয়ে যাবে সেজন্য তাদেরকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করা হয় এই শান্তিভবনেই।

যে বিষয়ে বলছিলাম, ড. জর্জ যেটা চেয়েছিলেন তার অনেকাংশে তিনি সফলতা অর্জন করেছেন। এরই মধ্যে শান্তিভবন থেকে বেশ কিছু ব্যাচ বের হয়েছে। উচ্চতর ডিগ্রি গ্রহণ করে মাজান, ইয়াহু, মার্সিটিজ বেন্জের মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানে সম্মানজনক পদে নিজেদের জায়গা করে নিয়েছে। কেউ বা আইনজীবী হয়েছে। কেউ আবার সাংবাদিক। আরও অনেক সম্মানজনক পেশায় আছে তাদের পদচারণা। আগেই বলেছিলাম, এসব ছেলেমেয়েদের মাঝে সামাজিক দায়বদ্ধতা ব্যাপারটা ঢোকানোর চেষ্টা করা হয়। সফল আর সুপ্রতিষ্ঠিত শান্তিভবনের প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরা তাদের আয়ের ২৫% থেকে ৫০% তাদের পরিবার আর অন্য দলিত শিশুদের পিছনে ব্যয় করে থাকে। যা নিঃসেন্দেহে দলিত শ্রেণির মানুষের মাঝে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বড় অবদান রাখছে।

ডক্টর আব্রাহাম জর্জ ডেভেলপমেন্ট ইকনোমিক্সে পিএইচডি লাভ করেছেন। অধ্যাপনা, গবেষণা, চাকরি, ব্যবসা ও লেখক হিসেবে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। নিজের জীবনের এমন স্বর্ণালি সময়ে অসহায় মানুষের প্রতি ভালোবাসা উনাকে ফিরিয়ে এনেছে ভারতে। নিজের থাকার বাসগৃহ রেখে সব বিক্রি করে উনি নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন এই অসহায় মানুষগুলোর জন্যে। তার মতে, একটি পরিবারের একটি সন্তান স্বাবলম্বী হলেই পরিবারটি দাঁড়িয়ে যেতে পারে। এই নীতির উপর ভিত্তি করেই তিনি আর তার পরিবার কাজ করে যাচ্ছেন। প্রকৃত অর্থে এভাবেই আসছে দলিতদের মাঝে কিছুটা হলেও অর্থনৈতিক আর সামজিক উন্নয়ন। ড. জর্জ বেড়ে ওঠেননি দলিত পরিবারে, তীব্র সামাজিক আর অর্থকষ্টে কাটেনি তার শৈশব। এরপরও অস্পৃশ্য মানুষদের কল্যাণে অবিরাম তিনি ছুটে চলেছেন। অর্থনীতির কড়া আর কঠিন থিওরিতে আটকে রাখেননি তিনি নিজেকে। সত্যিকারের অর্থনৈতিক উন্নয়ন যে মাঠপর্যায় থেকে শুরু করতে হয়, তা-ই প্রমাণ করে দিয়েছেন প্রবীণ এই অর্থনীতিবিদ।