শাহরুখ পিকলুর চারটি খুদে গল্প

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ০৩, ২০১৯

রঙের খেলা

রাত দশটা বাজতে চলল। বসে আছি লাল শার্ট পরে, লাল শাল জড়িয়ে, আরো লালের অপেক্ষা... থাক, অনেক লাল হয়েছে। দ্যাখা যাচ্ছে চায়ের দোকান, সিএফএল বাতির ঝকঝকে আলোতে দিনের মতো চকচক করছে চায়ের কেতলি। প্লাস্টিকের ব্যাগে ঝুলন্ত অনেক ক্ষণিকের খাবার যা রাত পুরোলেই আর খাওয়ার যোগ্য থাকবে না। তবে সকালে রয়ে যাওয়া পচা খাবার ফেলে দেয়া হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। দোকানির লাভ ভালো হলে হয়তো তার রোগা ছেলেটা আজ রাতে ডাল-ভাতের পরে একটা কেক খাবে, না-হলে মায়ের হেঁসেলের চিনি চুরি ছাড়া গতি নেই। কেকটা পেলে তা বড়লোকের ভাষায় হবে ডেজার্ট, চিনি খেলে তা চুরি ছাড়া আর কীই বা হবে— যদি না পড়ে ধরা।

যাকগে, চুরি না ডেজার্ট তাতে কার বা কী এসে যায়! সেই দোকানের নড়বড়ে বেঞ্চে বসে আছে একটা চ্যাংড়া ছেলে, দোদুল্যমান বেঞ্চে দীপ্ত তরুণ। গায়ে তার জ্বলন্ত সূর্যের মতো টি-শার্ট, জিন্সের প্যান্ট, তাতে আবার বিশেষ কায়দায় জাগায় জাগায় রঙ চটকানো। তার চকচকে চোখে চকিত চাহনি, যেন কারো অপেক্ষায় আছে। প্রেমিক? হলে হতেও পারে। কী খেয়েছে সে? সে কি ফেন্সিডিলের ইউফোরিয়ায় আছে না ইয়াবা খেয়ে ‘উদ্দিপ্ত’? যেটাই হোক, শেষরাতে বা ভোরে তার মেজাজ খারাপ হতে বাধ্য। কে বা কারা না জানি তখন তার রোষানলে খাক হয়! ভোরে তার চোখ আর চকচক করবে না, তা নিশ্চিত। নেশার রকমটাই অমন, সব কিছুই একপর্যায়ে মেজাজ খারাপ করে।

প্রেম করে কি ছেলেটা না প্রেম কেনে? সারাদিনের কামাইয়ের টাকা দিয়ে? কি এসে যায় তাতে? প্রেমের দেহ-মিলনের বীর্যপাতের কোনো বাছ-বিচার নেই। নতুন জীবনের উদ্ভবটাও আকস্মিক। প্রতিদিন অনেকে মরে কিন্তু তার থেকে বেশি ভ্রূণ তৈরি হয়। মানুষ বেড়েই চলে, প্রেম না বাড়লেও কাম সবাইকেই গ্রাস করে, যেমনটা করে লাল রঙ। মানুষের রক্ত লাল, ঋতস্রাব লালচে, শিশু ভূমিষ্ট হয় লাল কম্বলে মুড়ে কিন্তু জীবনের বেদনার রঙ নীল। সবুজ অরণ্য থেকে বেরিয়ে এসে লালে লাল খেলার পর নীল নিয়ে শেষ। কে সৃষ্টি করল এই রঙের খেলা?

বাড়ি

মহাখালি ডিওএইচএস-এর রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসছিলাম। সকাল হবে প্রায় ছ’টা। গরমের কোনো মাফ নেই, ঘেমেনেয়ে একেবারে চিকেন স্যুপ অবস্থা। ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকোর কারখানার কাছে চলে এসেছি প্রায়, আর দু’কদম গেলেই সংরক্ষিত এলাকা থেকে সাধারণের মাঝে পড়ব। এমন সময় পাশ দিয়ে একটা রিকশা, তার আরোহী এক টগবগে যুবক। তার পিঠে একটা ঝোলা ব্যাগ, রিকশার পাদানিতে রাখা আরেকটা ট্র্যাভেল ব্যাগ, দুটোই ছোট। এই যুবকের আর এমন কী-ই বা সম্বল আছে যে বড় বড় ব্যাগ ভর্তি করে নেবে! এমন সময় একজন গার্ড গোছের লোক তাকে জিগ্যেস করল, সে এই সাতসকালে কই চলেছে। ‘বাড়ি যাই, আমি বাড়ি যাই’ বলে যুবক চোখ-মুখ ভরা একটা হাসি দিল, তার খুশি যেন ধরে না। ওই রকম খুশি আমি কোনোদিন হয়েছি কীনা, মনে করতে পারলাম না।

একান্ত কয়েক পুরুষ ধরে ঢাকায় বাস করা মানুষ ছাড়া এই শহরের কেউ-ই শহরের আবাসস্থলকে ‘বাড়ি’ বলে না, সেটা সব সময়েই বাসা। বাড়ি তার লালমনিরহাট, বগুড়া, সিলেট, বরিশাল বা কিশোরগঞ্জের কোনো গাঁয়ে— যেখানে তার বাবা-মা, ভাইবোন বা একটা নতুন বউ আছে। অথবা কেউ-ই হয়তো নেই, শুধু বাপের ভিটেটা আছে। কিন্তু ওটাই তার বাড়ি, সারাজীবনের জন্য।

খোঁজ

ওয়ারির র‍্যাংকিন স্ট্রিটের ফ্ল্যাট থেকে বার হয়ে সাজিদ সোজা হেঁটে, নবাব স্ট্রিট, লারমিনি স্ট্রিট, ওয়্যার স্ট্রিট, বলদা গার্ডেন, ক্রিশ্চেন সেমেট্‌রি পার হয়ে হঠাৎ দাঁড়ালেন। এদিক-ওদিক দেখলেন, আবার ওখান থেকে ঘুরে জয়কালী মন্দিরের পাশের রাস্তা দিয়ে এসে হানিফ ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে হেঁটে চলে এলেন হাটখোলার মোড়ে।

সেখানে একটা রেস্টুরেন্ট আছে, পুলিশের দাঁড়াবার জায়গা আছে, চারদিকে একটা প্রাণচাঞ্চল্য আছে। গরমকালের সকাল আটটাতেই বেলা অনেক গড়িয়ে যায়। থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন তিনি, সঙ্গে যেন দাঁড়িয়ে গেল তার ‘সময়’। অন্যদের ঘড়িতে টিক টক করে কাটা এগিয়ে চলেছে, বৃত্তাকারে কিন্তু সামনের দিকে।

হাটখোলার ওই মোড়ে দেখলেন, বেশ কিছু মেয়ে কমলা শাদা ইউনিফর্ম পরে টিকাটুলির দিকে চলে যাচ্ছে, কামরুন্নেছা স্কুল হবে হয়তো, ভাবলেন তিনি। তার পাশের বাড়ির দুই পিঠাপিঠি ভাই রুমেল আর রাসেল পিঠে ব্যাগ ঝুলিয়ে তার পাশ দিয়ে চলে গেল। ওরা নটরডেম কলেজে পড়ে, যদ্দূর তার মনে পড়ে। একটা মৃদু-স্বরের সালাম ভেসে আসলো কি? তরঙ্গে? তিনি নিশ্চিত না। তবুও একটা হাত একটু তুললেন কিন্তু মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বেরুলো না তার।

হাতের ডানে ডেমরার দিক থেকে, আরো কই কই থেকে বেশ কিছু মানুষ ধীর স্রোতের মতো ঢাকাতে প্রবেশ করছে। অনবরত। তাদের বিভিন্ন কাজ আছে, যাত্রার উদ্দেশ্য আছে। বাস-ভর্তি মানুষ অফিস আদালতে চলেছে, সঙ্গে হয়তো কিছু বেকারও আছে। বেকারেরও যাত্রার উদ্দেশ্য থাকে, চাকরি বা ধান্দার ‘পাখি’ টাকে ধরতে।

সাহেবরা গাড়িতে করে একটু আগেভাগেই কাজে চলেছেন কেউ কেউ। বেশ কিছু মেয়ে পান চিবুতে চিবুতে, মুখে পানের রস আটকাবস্থায় অদ্ভুত এক গরগরে শব্দে গপ্প করতে করতে ওয়ারিমুখি। এরা বোধ হয় বাসাবাড়িতে কাজ করে।

সাজিদ নিজেকে এই বহু-রঙা জনস্রোতের মাঝে খুঁজে পেলেন না। দাঁড়িয়েই রইলেন। ভাবলেন, উনি কী অদৃশ্য এদের কাছে? ওনার কী অস্তিত্ব আছে?

সাজিদ সাহেবের বয়স হয়েছে। পঞ্চাশ পেরিয়েছেন অনেক আগেই। কয়েক বছর হলো ওনার অফিসটা লাটে উঠেছে, সাথে ওনার চাকরিটাও গেছে। র‍্যাংকিন স্ট্রিটের যে ফ্ল্যাটে থাকেন, সেই ফ্ল্যাটবাড়িটার জমিতে এক সময় তার বাবার দোতলা বাড়ি ছিল, এখন সেখানে অনেকগুলো ফ্ল্যাট। ওনার দুটো, একটায় থাকেন, অন্যটা ভাড়া। দিন চলে যায় তার স্ত্রীকে নিয়ে। একমাত্র ছেলেটাকে অকালে এডিস মশা কেড়ে নিয়েছে, নিজের শরীরটাও সুবিধের না।

আজ ভোরে নাশতার টেবিলে হঠাৎ তিনি নিজেকে হারিয়ে ফেললেন। তাই খাওয়া শেষ না করেই বেরিয়ে পড়েছেন নিজেকে খুঁজতে। হাটখোলার মোড়ে পেলেন না এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে। আবার হাঁটা শুরু করলেন, ইত্তেফাক ভবনের দিক হয়ে মতিঝিল-দিলখুশা-স্টেডিয়ামের দিকে যাবেন। হয়তো ওখানে নিজেকে খুঁজে পাবেন।

ওদিকে না-পেলে আরো হাঁটবেন, আরো খুঁজবেন। পল্টন-তোপখানা-হাইকোর্ট এলাকা ছাড়িয়ে রমনা পার্কের ভিতর দিয়ে হেঁটে বিশ্ববিদ্যালয় দিয়ে সোজা গিয়ে নীলক্ষেতের বই আর লেপ-তোষকের দোকান ছাড়িয়ে নিউ মার্কেটে পৌঁছুবেন। চলতেই থাকবেন।

আজিমপুর গোরস্থানে পৌঁছে তার খোঁজ শেষ হয়ে গেল।

দীর্ঘ রাত

রাতগুলো নির্লজ্জের মতো দীর্ঘ। শেষ নেই। জানালার পর্দা টানা থাকলে কিম্বা দরোজায় আগল আঁটা থাকলে, সূর্য উঠেও রাত শেষ করতে পারে না। সে রাতে মৌনতার অন্তর্বাস খুলে হৃদয় অন্য কাউকে খোঁজে, নীড়ের খোঁজ যেন। প্রেম বা ভালোবাসা কী হৃদয়ের সাথে হৃদয়ের কথোপকথন? শরীর তবে কী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়? প্রেমের পুলক কেটে যায়, প্রেমের মানুষের সাথে সাংসারিক মিল হলে জীবনটা যেন একটা ছকে পড়ে যায়। বাঁচো, বাঁচাও, সন্তান পালন, সামাজিক দায়িত্বের জোয়াল ঘাড়ে। সেই প্রথম প্রেমের কাছে আর তখন সান্ত্বনা পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে, পড়ে থাকে তবুও শরীর, তার প্রাগৈতিহাসিক ক্ষুধা। তখন মৌনতার নয়, বাস্তবিকের অন্তর্বাস খুলে ফেলতে হয়, নইলে মানুষ যন্ত্র না-হয়ে বেঁচে থাকবে কীভাবে? শরীরকে বাদ দিয়ে প্রেমের অন্তত রেশটাকে টিকিয়ে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ে।

এসো, হে প্রেমিক, আদিম নরনারীর বেশে আলিঙ্গন করে দীর্ঘ রজনীর অন্ধকার দূর করি, সূর্যকে কাছে টানতে লজ্জা না করি, সেই আদিম বেশে। চুলোয় যাক সমাজ, তার রীতিনীতি, তার বাধ্যবাধকতা, মেকি সব বন্ধন, যে বন্ধনে সুখ নেই, প্রেম নেই, আছে নৈমিত্তিক শ্বাস নেয়া, দিনশেষে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দ্যাখা, যা সূর্যের আলোয় মুহূর্তে উবে যায়। আবার গৎবাঁধা চক্র শুরু।