শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা ও শিক্ষকের দায়

সোনিয়া ইসলাম নিশা

প্রকাশিত : নভেম্বর ২০, ২০১৮

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) ভর্তি হওয়ার আগে আমার ভাবনা ছিল, অনেক ঘুরব। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেব, গঠনমূলক তর্ক হবে, পড়ালেখা ও লেখালেখি হবে। মোটকথা জীবনে একটা অন্যরকম রোমাঞ্চ আসবে। বাস্তবে কিছুটা পেয়েছি, কিছুটা পাইনি। প্রতিটি ছাত্র যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে, একা আসে না। অনেকগুলো স্বপ্নের ফিরিস্তি নিয়ে আসে। জীবনকে অন্যভাবে ভাবার স্বপ্নে বিভোর হয়ে আসে। এসে বাস্তবতা আর স্বপ্নের সামঞ্জস্য পায় না অনেকেই। এর প্রধান কারণ বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে অগাধ এক্সপেকটেশন। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবগাথা শুনে শুনে বড় হয়ছি...

স্বপ্নভঙ্গের যাত্রা শুরু হয় সাবজেক্ট দিয়ে। আমাকে অনেক ছাত্রই বলেছে তারা ডাক্তারি পড়ার স্বপ্ন দেখেছিল, কিন্তু চান্স পায়নি। এখন আর পড়াশুনা ভালো লাগে না, ফ্রাস্টেশন চলে এসেছে ইত্যাদি। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরেই ভালো সাবজেক্ট, খারাপ সাবজেক্ট নিয়ে অলিখিত কলহ শিক্ষার্থীদের মধ্যে। কিছু শিক্ষকের মধ্যেও এই আচরণ দেখেছি। আসলে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে খারাপ সাবজেক্ট বলে কিছু নেই।

এইচএসসি পর্যন্ত নিয়মিত পড়ালেখা করা ছেলেটি ক্লাস করে না। কারণ ক্লাসের পড়া বুঝতে পারে না বা ভালো লাগে না, এই সাবজেক্ট পড়ে কী হবে, এই নিয়ে ভাবতে থাকে। তারপর অকৃতকার্য হয়, ইয়ার ড্রপ এবং চূড়ান্ত হতাশায় পড়ে।

দ্বিতীয় ধাক্কা হল নিয়ে, বিশেষত ছেলেদের। ক্লাসে উস্কোখুস্কো চুলে, ঘুমঘুম চোখে যখন একটা ছেলে, বলে রাতে ঘুমাতে পারিনি ম্যাডাম পলিটিক্যাল প্রোগ্রাম ছিল, তখন শিক্ষক হিসেবে আমি মাটিতে মিশে যাই। প্রথম বর্ষে যে ছেলেটি বোকামি করে পলিটিক্যাল ছাত্রদের ভয়ে হল ছেড়ে দিয়েছিল, টিকে থাকার জন্য আজ সে বড় নেতা। নির্বাচনের ক্যাম্পেইন করে বেড়ায়। প্রথম বর্ষের একটা ছেলেকে আগে ক্লাসে আসতে হবে তারপর পলিটিক্স। ছাত্রদের মধ্যে যারা ক্লাসে আসে না, পরীক্ষায় ফেল করে কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় খুব অ্যাক্টিভ রাজনীতি নিয়ে— তাদের জন্য আমার খারাপ লাগে।

পাঁচ বছর পর যখন এদের মধ্যে কেউ কেউ হতাশ হয়ে যাবে একটা যুতসই চাকরির অভাবে, সেখানে আমাদেরও দায় থাকবে। একজন শিক্ষক হিসেবে আমি হয়তো আমার ছাত্রের সমগ্র ব্যক্তিগত জীবনকে জানার অধিকার রাখি না, কিন্তু সে যেন আমাকে তার কষ্ট নির্দ্বিধায় বলতে পারে সেই পথ খোলা রাখতে হবে। ঢাবিতে শিক্ষক ছাত্র নির্দেশনা কেন্দ্রে সেই সুযোগও রয়েছে কিন্তু প্রচার ঠিক পর্যাপ্ত নয়, আমার মতে।

আমাদের একটা হেল্প লাইন থাকতে পারত, যেখানে ফোন করে চূড়ান্ত হতাশ ছেলেটি বা মেয়েটি নিজের কথা বলবে, ফোনের ওপাশে থাকা একজন দায়িত্বশীল ভলান্টিয়ার কেবল শুনবে কোনো জাজমেন্ট ছাড়া। চাইলে সরাসরিও কথা বলা যাবে। এটা কি সম্ভব করা? আমরা কি সক্ষম দায়িত্ব নিয়ে অন্যের গোপনীয়তা রক্ষা করতে? আমরা যদি এমন কোনো উদ্যোগ নিই, সেখানে যে নোংরা রাজনীতি ঢুকবে না তার নিশ্চয়তা কী!

দিনশেষে আমরা আসলে পারছি না আমাদের শিক্ষার্থীকে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখাতে। পড়াশুনায় উৎসাহী করতে। যে ছেলেমেয়েগুলো আত্মহত্যা করল, তাদের জন্য আমার কষ্ট হচ্ছে এই ভেবে, ভয়ানক ঝড়ের পরেও যে মাছরাঙার ঠোঁটের মতো সুন্দর সকাল আসে, তা ওরা দেখতে পেলো না।

আত্মহত্যা কখনোই মহান নয়। জীবন থেকে পলায়নপ্রবৃত্তি মহান কিছু হতে পারে না। কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, যত ছাত্রছাত্রী, তরুণ, কিশোর, মধ্যবয়স্ক— যার মধ্যেই আত্মহননের সামান্যতম অভিপ্রায় আছে তাদের উদ্দশ্যে বলি, যতই অন্ধকার আর দীর্ঘ রাতই হোক না কেন, তার একটা সমাপ্তি আছে, যেখানে ঝলমলে রোদ। চলুন আমরা বেঁচে থাকি রাত শেষে দিন আসা পর্যন্ত।

লেখক: শিক্ষক, যোগাযোগ বৈকল্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়