শিখরে চীন

পর্ব ২

উ শিয়াওবো

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ১৫, ২০১৭

শক্ত একটি অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে আজকের চীন। এ অবস্থায় পৌঁছতে এ জাতির রয়েছে নানা ত্যাগ ও পরিকল্পনা। পশ্চাৎপদ চীনা জনগোষ্ঠীকে সুসংবদ্ধ একটি অর্থনৈতিক পাটাতন দিতে যে মানুষটি প্রথম উদ্যোগ শুরু করেন তিনি দেং শিয়াও পিং। উ শিয়াওবোা’র লেখাটি ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন সাজ্জাদ হায়দার।আজ প্রকাশিত হলো দ্বিতীয় পর্ব 

১৯৭৮ সালের আগে গণ কমিউন পদ্ধতি ২০ বছরের বেশি সময় কৃষকদের শক্ত বাঁধুনিতে বেঁধে রেখেছিল। ‘সবার জন্য একটি বৃহৎ ভাণ্ডার’ এ পদ্ধতির অসারতা আরও প্রকট হয়ে ওঠে। এ পদ্ধতিতে কৃষি উৎপাদন এতই কমতে থাকে যে, কৃষকদের বেঁচে থাকাই কঠিন হয়ে পড়ে। শিয়াওগ্যাং গ্রামের অবস্থান ছিল ‘তিন সহায়তা গ্রহণকারী গ্রাম’ তালিকায়। এ তালিকায় থাকা গ্রামের সরকারি ভর্তুকিতে খাদ্যশষ্য, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যর জন্য অর্থনৈতিক সহায়তা এবং উৎপাদনের জন্য ধার পাওয়ার কথা। প্রকৃতপক্ষে এই সহায়তা আসত না। শস্য উৎপাদন কম হলে গ্রামের কৃষকরা কাছাকাছি এলাকা থেকে খাদ্য ভিক্ষা করত। ১৯৭৮ সালের বসন্তে খরার কারণে ওই গ্রামের শষ্য উৎপাদন মারাত্মক হ্রাস পায়। কোনও বিকল্প না পেয়ে শিয়াওগ্যাং গ্রামের কৃষকরা নিজেদের মতো সমাধানের সিদ্ধান্ত নেয়। “দা বাও গান” নামে তারা একটি পদ্ধতি চালু করে। পরিবারগুলো নিজেদের জমি ভাগ করে নেয়, নিজ জমি চাষাবাদের দায়িত্ব নিজেই বহন করে। এ পদ্ধতিতে কৃষি উৎপাদনের জন্য নিজ অংশের কর্মকাণ্ড ও দায়ভার নিজকেই বহন করতে হবে। এক বছরের মধ্যে শিয়াওগ্যাং গ্রামে বিপুল শস্য উৎপাদিত হয় এবং তারা তাদের ‘ধারের শস্য’ পরিশোধ করে। অ্যানহুই প্রদেশে কমিউনিস্ট পার্টিও প্রথম সচিব ওয়ান লি’র জোড়ালো সমর্থনে শিয়াওগ্যাং গ্রামের অভিজ্ঞতা অনুসরণ করে। ফলে শস্য উৎপাদন সারা প্রদেশে ছড়িয়ে যায়। এ পদ্ধতি ‘পারিবারিক চুক্তির দায়-দায়িত্ব’ নামে পরিচিতি লাভ করে এবং সমগ্র চীনের গ্রামগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে।
চীনা সংস্করের বিগত ত্রিশ বছরের ইাতহাসে আমরা দেখতে পাই, সবচেয়ে বড় পরিবর্তনগুলো চীনা জনগণ নিজেরা করেছে। ‘স্রোত কোথায় যাচ্ছে’ সেটা দেখাই ছিল নীতি নির্ধারকদের কাজ। প্রয়োজনীয় সাহস ও উদ্যম দিয়ে তারা জনগণের নিজস্ব সৃষ্টিশীলতা ও সঠিক পথকে বোঝার চেষ্টা করেছে। সংস্কারের ত্রিশ বছরের ইতিহাসে আরেকটি জরুরি আত্ম-উপলব্ধি ছিল, চীন বাদবাকি বিশ্ব থেকে কতটা ও কি জন্য পিছিয়ে, সেটা স্বীকার করে নেয়া। এক সময় যখন যুক্তরাষ্ট্রের ৭০ শতাংশের বেশি জনগণের টেলিভিশন ছিল আর  চীনা জনগণের ছিল শূন্যে। ১৯৭৮ সালের জুলাই মাসে পিপলস্ ডেইলীর পাতায় প্রথম বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়। এ বছরের আগস্ট থেকে ওই পত্রিকার পাতায় মাঝে মাঝে বিশেষ দিনের টেলিভিশনের অনুষ্ঠানসূচি প্রকাশিত হতো। সরকার তখনও জনগণকে কৃচ্ছ্ব সাধন চালিয়ে যেতে বলত। জনগণ সিমেন্টের পুরানো ব্যাগ বারবার ব্যবহার করত এবং সেগুলোকে কখনো আর্বজনা হিসাবে বাতিল করত না। ১৯৭৮ সালে বেইজিং থেকে একব্যক্তি সাংহাই যান এবং দেখতে পান একটি বইয়ের দোকান। সেখানে বিক্রি না করে বই ধার দেয়া হতো। একব্যক্তি পরে বলেছেন, আমরা বিশ্ব থেকে কতটা পিছিয়ে ছিলাম সেটা অনুধাবন না করলে, সেই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার সাহস আমাদের থাকত না।
যাই হোক, চীনের নতুন যাত্রা চলতে লাগল। ১৯৭৮ সালের ১৮ থেকে ২২ ডিসেম্বরে বেইজিংয়ে আধুনিক চীনের ইতিহাসের অন্যতম সভা অনুষ্ঠিত হলো। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির একাদশ কমিটির এ তৃতীয় পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনের একমাত্র আলোচ্য বিষয় ছিল, পার্টির সকল কর্মকাণ্ড সমাজতান্ত্রিক আধুনিকায়ন ও নির্মাণের জন্য কেন্দ্রভূতকরণ।
এ অধিবেশনে শ্রেণি সংগ্রামই চালিকা নীতি ও সর্বহারা একনায়কতন্ত্রের অধীনে বিল্পব চালিত করো, এ দুটি শ্লোগান বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়। এ অধিবেশনে পার্টির কাঠামো ও নীতি পুনঃগঠিত হয়। এতে ব্যক্তি পূজা ও ব্যক্তি বিশেষের গুণগান প্রচারের বিরোধিতা করা হয়। এতে বিগত দিনগুলোতে কতিপয় ব্যক্তির মিথ্যা গুণকীর্তন পুনঃ মূল্যায়ন এবং “অবদান ও ভুল” এ নীতি অনুযায়ী সেসব ব্যক্তিদের কর্মকাণ্ড মুল্যায়িত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এ সভাটি ছিল নানা দিক থেকে উল্লেখযোগ্য। যেমন, এতে বলা হয়, চীনা জনগণের টিকে থাকার লড়াইয়ের মূল উৎস রাজনৈতিক আদর্শ নয়। চীন আবার বিশ্ব অঙ্গনে আসন নেবে এবং স্থিতিশীল প্রতিযোগিতায় অংশ নেবে। শত বছরের রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার পরে টিকে থাকা এ দেশ উন্নত আগামীর জন্য অর্থনৈতিক উন্নয়নকে কাজে লাগাবে।
চীনের দরজা খুলে গেল এবং জনগণ বিস্ময় ও আগ্রহ নিয়ে হঠাৎ করেই বাইরের পৃথিবীকে দেখতে পেল। দীর্ঘদিন চীন গোটা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন থাকায় পশ্চিমারাও সবদিক থেকে ব্যতিক্রম এই দেশটির প্রতি গভীর আগ্রহ অনুভব করল। ১৯৭৮ সালের শেষে টাইম ম্যাগাজিন, ১৯৭৬ সালে প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইয়ের ওপর প্রচ্ছদ প্রতিবেদন প্রকাশের পর, দ্বিতীয় চীনা নেতা হিসাবে দেং শিয়াওপিং কে নিয়ে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন প্রকাশ করল। দেং কে শুধু ‘বছরের সেরা মানব’ নির্বাচিত করেই ম্যাগাজিনটি থামল নাÑম্যাগাজিনের ৪৮ পাতা জুড়ে দেং ও চীনের খোলা নীতির বিবরণ থাকল। টাইম ম্যাগাজিন নিবন্ধ শুরু করেছিল, “নুতন চীনের প্রত্যাশা” শিরোনামে।
চলবে...