শীত বরণের প্রস্তুতি

কাজী আশরাফ

প্রকাশিত : অক্টোবর ১২, ২০১৮

হালকা শীতের স্বাগতম। ফ্যান চালালে শীত, বন্ধ করলে গরম। মশারির ছাদের উপর পাতলা গামছা মেলে দিয়ে ভেতরে হালকা কাঁথার ভেতর ঘুমানো স্বপ্নের বাইরেও স্বপ্নের মতো আরাম।

শিল্প এলাকায় বাড়ি। গ্রামের তুলনায় এলাকা গরম। ঘন ঘন শিল্প কারখানা। উঁচু উঁচু দেয়ালের কারণে বায়ুবদ্ধতা, হাজার হাজার মেশিন, মোটর ইঞ্জিনের তাপ, কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণে এলাকাটি গরম।

এত কিছু ভেদ করেও স্বাগতম জানাচ্ছে শীত। আমার কেবলই মনে পড়ছে লরা ইঙ্গলস ওয়াইল্ডারের `ফারমার বয়` উপন্যাসের কথা। শীতকে মেনে নেয়ার প্রস্তুতি। সেখানে মাইনাসের নিচের শীতকে শুধু মেনে নেয়া নয়, বরণ করার প্রস্তুতিই যেন কিশোর বালকটির। আমি ফারমার বয় কখনোই ছিলাম না। আশেপাশে তা দেখেছি। আলু এবং ভিটালি সবজি চাষিদের দেখেছি।

বাড়ির চারদিকে শুনতাম ট্রাক্টরের রাতজাগা উল্লাস। এখন কারেন্ট জালের মেশিনের কাশির শব্দ শুনি। এখন সব নগরায়ণের সুতীব্র কামড়ে নিষ্প্রাণ হয়ে যাচ্ছে। যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছে। আমাদের পঞ্চসার ইউনিয়নের ৩২টি গ্রামের মধ্যে অন্তত অর্ধেক এলাকায় এখন এক ইঞ্চিও কৃষিজমি নাই। কলেজে দেখি শিক্ষার্থীদের মধ্যে, উত্তর ও পূর্ব দিকের ছাত্রছাত্রীরা কৃষি পরিভাষা বোঝেই না। দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকের ওরা এখনো লাঙল, কোদাল, নিড়ানি চেনে। ওরা গ্রামে থাকে বলে আমার আগে শীত টের পায়। ওদের মধ্যেই আমি লরা ইঙ্গলস ওয়াইল্ডারের ফারমার বয় জন এবং তার পরিবারের সদস্যদের দেখতে পাই।

গরম কাপড়গুলো নামিয়ে রোদে শুকিয়ে প্রস্তুত করে রাখা। দরিদ্র পরিবারগুলোতে বাঁশের বা পাটখড়ির ঘরের বেড়ায় আঁঠা দিয়ে কাগজ লাগানো, শু বা কেডস জুতা নামিয়ে, ধুয়ে, শুকিয়ে রাখা। ছেঁড়া থাকলে মেরামত করিয়ে আনা। এসময় মুচির দোকানে ভিড় থাকে। ঘন গাছপালায় আচ্ছাদিত বাড়িগুলোতে গাছের ডালপালা ছেঁটে সোনালি রোদ আসার পথ করে দেয়া। কত কিছু।

শীতের প্রথমে লাগে মাফলার। ঠাণ্ডা, জ্বর শুরুতেই দেখা দেয়। কাঁথা ধুয়ে রেডি রাখা, লেপ কম্বল আরো কিছুদিন পরের হলেও রোদে মেলে দেয়া। কভার ছেঁড়া থাকলে সেলাই করা। দরিদ্র পরিবারগুলোতে মেঝেতে বিছানোর জন্য চট কিনে রাখা। কৃষক পরিবারে, আলু চাষিদের ঘরে ছালার বস্তা আগেই থাকে। না থাকলে আলুর সিজন আসার আগে কিনে রাখা। অসুস্থ, শিশু ও বৃদ্ধদের গরম পানিতে গোসল বা অজু করার জন্য লাকড়ি সংগ্রহ করা। পাতা কুড়িয়ে বস্তায় ভরে জমানো। এলুমিনিয়ামের কেটলি কেনা, বা নামিয়ে রাখা। গরম পানির জন্য মাটির পাত্র কিনে রাখা। আগুনের তাপ পোহানোর জন্য মাটির মালসা বা আইল্লা কিনে আনা। এমন কত রকমের শীতবরণের প্রস্তুতি।

সবই মনে পড়ল আজ রাতে। এসো শীত। যে ঋতুতে আমি শারীরিকভাবে কষ্ট পাই। শুরুর দিকে, গ্রামের দিকে বিকালে- সন্ধ্যায় হাঁটতে গেলে নানা রকম কীটপতঙ্গের আক্রমণ। বিশেষ করে চোখে। ঠোঁটে ভাইরাসের আক্রমণ, জ্বরফোস্কা হওয়া। অতিরিক্ত শাকসব্জি খাওয়া হলে পেটে গ্যাস জমা। লিভার-পাকস্থলির সমস্যাকে ভয়াবহ মরণব্যাধি কল্পনা করে পরিবার সন্তানকে নিঃস্ব ও অসহায় রেখে মৃত্যুবরণের প্রস্তুতি। ত্বকে টান পরা, গ্লিসারিন মাখা। ঠোঁটে ভেসলিন না লাগালে ফেটে রক্তপাত। অতি শীতে গা জ্বলা, ডায়রিয়া, আমাশয় ঠেকাতে না পারা। গরম পানিতে গোসল করলে চামড়ায় জ্বলুনি। হাঁচি-কাশির প্রতিরোধে গরম পানির জন্য ফ্লাস্ক কিনে আনা। ঘন কফে শ্বাসনালি রুদ্ধ করে রাখা। শ্বাসকষ্টে ঘুমের সমস্যা। মেন্থল, ইনহেলার, এন্টিহিস্টামিন কেনা। ঘন কুয়াশায় নাক বন্ধ, ঘুমের ব্যাঘাত। ড্রপ কিনে আনা। এমন কত অসুবিধা।

আমি ফারমার বয়ের মতো হতে পারি নাই। লরার উপন্যাসের শক্ত-সমর্থ বালক হতে পারি নাই। সেই ব্যর্থতার গ্লানি। তবু শীত এসো। পরিবর্তন চাই। আমার অশান্তি হলেও পরিবর্তন হোক।