শুকনা গদ্য

অমিতাভ পাল

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ০৩, ২০১৮

কবিতাকে চেনার জন্য আমি একটা সহজতম এবং ক্ষুদ্রতম বেঞ্চমার্ক তৈরি করেছি। সেটা হলো, একটা রচনা পড়ার পর যদি আমার মুখ থেকে স্বতস্ফূর্তভাবে `তাই তো!` শব্দটি বেরিয়ে আসে, তাহলেই সেই রচনাটিকে আমি কবিতা বলবো। তবে এই সহজতম ও ক্ষুদ্রতম শব্দবন্ধ `তাই তো!`র পিছনে সেনাবাহিনীর ডিভিশনের মতো একটা বিরাট শব্দের প্যারেডদল দাঁড়িয়ে আছে, এটা নিশ্চিত। এই প্যারেডদল নির্দিষ্ট কমান্ডেই প্রতিক্রিয়া দেখায়, নড়েচড়ে ওঠে। এই নির্দিষ্ট কমান্ড তাদের শেখানো হয়েছে, চর্চা করানো হয়েছে এবং তা মেনে চলার আদেশও দেয়া হয়েছে। ফলে একথা বলাই যায়, `তাই তো!` শব্দটা সহজতম এবং ক্ষুদ্রতম হলেও এর ইতিহাস এবং গঠন মোটেও সহজ ও ক্ষুদ্র নয়।

যেকোনো মানুষ যেকোনো সময় যেকোনো ঘটনার সামনে দাঁড়িয়ে `তাই তো!` শব্দটি যখন বলে ওঠে, তখন তার ভিতরে জেগে ওঠে অভিজ্ঞতা ও ইতিহাসজ্ঞানের এমন এক যুগ্ম দ্রবণ— যা তাকে বাধ্য করে ওই শব্দটি ঊচ্চারণ করতে। এতে বোঝা যায়, মানুষ তাৎক্ষণিকভাবেও যাকিছু করে তা আদপে তাৎক্ষণিকই নয় বরং ভাবনাচিন্তার লিটমাসে পরীক্ষিত হয়ে আসা এক অমোঘ উচ্চারণ। মূহূর্তের গঠন নিয়ে যদি ভাবি, যদি তার অস্ত্রোপচার করে বের করে আনি গাঠনিক উপাদানগুলি, তাহলে তাতে পাওয়া যাবে আবহমানতার রেশ এবং মুহূর্তের সময়স্থানাঙ্কে সংশ্লেষিত হওয়া এমন কিছু নতুনতর উপাদান, যা মুহূর্তটিকে এর আগের সবগুলি মুহূর্তের চেয়ে আলাদা করে তুলবে। ফলে মুহূর্তের সময়স্থানাঙ্কে দাঁড়িয়ে এই বিশ্বের যা কিছু আমরা দেখি, তা যেমন চিরপরিচিত, তেমনি অজানাও বটে।

কবিতা পদবাচ্য যেকোনো রচনাতেও এই দুই ঊপাদান থাকার কথা। বিনয় মজুমদারের তৈরি `মাংসরন্ধনকালীন ঘ্রাণ` বলে যে শব্দবন্ধটি আছে, সেটি এই দুই ঊপাদানের সংমিশ্রণের একটা উজ্জ্বল ঊদাহরণ। ঘ্রাণের সঙ্গে আমাদের পরিচয় গন্ধের জন্ম হওয়ার পর থেকেই। কালীন শব্দটাও প্রাচীনকাল থেকে ব্যবহৃত হতে হতে আবহমানতার ডিকসনারিতে ঢুকে গেছে ভালোভাবেই। রন্ধনকেও ওই কাতারেই রাখা যায়। কিন্তু বিনয় মজুমদারের কবিতায় যখন এই তিন পরিচিত এবং প্রচলিত শব্দ মাংসের সঙ্গে মশলার মতো যুক্ত হয় তখন এমন এক মুহূর্তের জন্ম হয়, যা আগের সব মুহূর্তগুলির ভিতরে ছিল না। এই মুহূর্ত তার নতুনত্বের স্বকীয়তায় পরিচয় এবং প্রচলনকেও করে তুলেছে মাত্রমাজা কাঁসার বাসনের মতো উজ্জ্বল।

এইরকম মুহূর্তের মুখামুখি হয়ে আমি `তাই তো!` বলা ছাড়া আর কীইবা করতে পারি! তখন আমার অভিজ্ঞতা, আমার ক্ষুধা, আমার সমস্ত স্মৃতি লাফিয়ে ওঠে এক অত্যাশ্চর্য আবিষ্কারের আনন্দে, যার বহিঃপ্রকাশ ওই সামান্য `তাই তো!` শব্দটা, যা আইনস্টাইনের মহাসূত্র e=mc2 এর মতোই গুরুভার।

কবিতা চেনার জন্য এরকম শব্দই তো দরকার।