শ্রেণি সংগ্রাম

পুনর্মুদ্রণ

আবুল হাশিম

প্রকাশিত : নভেম্বর ১৯, ২০১৮

কলেমার ভ্রাতৃত্ব সর্বজনীন, এবং তা কোনো বিশেষ শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। শূন্যতাপন্থী খুব সহজভাবে সাম্যের বাণী আওড়ায়, যে জীবনদর্শনের কাজ হচ্ছে দেহের আশু বস্তুগত প্রয়োজন মেটানো, তার পক্ষে মানুষের সাম্যকে বাস্তবায়িতক করা সম্ভব নয়। যে জীবনদর্শন মানবজাতিকে পরস্পরের প্রতি নিদারুণ শত্রুতাভাবাপন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত করে এবং যে জীবনদর্শন শ্রেণি সংগ্রামের মাধ্যমে একটি মনোনীত শ্রেণি দ্বারা আরসব শ্রেণিকে নির্মূল করে দিয়ে শ্রেণিহীন সমাজ গঠনের ভান করে, সে জীবনদর্শনের ভিত্তি যে ঈর্ষা ও ঘৃণা; ভালোবাসা নয়, এতে সন্দেহ নেই। এ জাতীয় জীবনদর্শন ঘৃণার দর্শন, প্রেমের দর্শন নয়। এ জাতীয় জীবনদর্শন মনুষ্যত্বকে ধ্বংস করে দিয়ে মানুষের ভেতর পাশবিক প্রবৃত্তিগুলো লালন করে।

‘জোর যার মুলুক তার’ বলে প্রাচীন একটি প্রবাদ আছে। প্রাচীনকালে জোর বলতে বোঝাতো দৈহিক পরাক্রম। তখন দৈহিক বলে বলিয়ান শ্রেণি ও ব্যক্তিরাই ছিল শাসকশ্রেণি। দুর্বলকে তারা শোষণ করত। সভ্যতার অগ্রগতির ফলে মানুষ প্রবলের দ্বারা দুর্বলের শোষিত হওয়ার বিষয়ে সচেতন হয়ে ওঠে, আর শুরু হয় প্রবল ও দুর্বলের মধ্যে শ্রেণি সংগ্রাম। দুর্বলেরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং শেষে তারাই জয়লাভ করল। শোষণের হাতিয়ার হিসেবে দৈহিক পরাক্রমের গুরুত্ব শেষ হয়ে গেল। এরপর বাহুর শক্তির দ্বারা সামাজিক মর্যাদা আর নির্ধারিত হতো না, এই অর্থে শ্রেণিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠিত হলো। কিন্তু এই শ্রেণি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আরও একটি শ্রেণি দ্রুত গজিয়ে উঠল। নতুন এ শ্রেণি ছিল বুদ্ধিজীবি সমাজ। তখনো ‘জোর যার মুলুক তার’ নীতিই ঠিক থাকল। পার্থক্য হলো শুধু এই যে, জোর বলতে আর দৈহিক বিক্রম বোঝাতো না, বোঝাতো বুদ্ধির শক্তি। প্রাচীন ভারতের ব্রাক্ষ্মণদের মতো এসব বুদ্ধিজীবি শ্রেণি শেষপর্যন্ত শোষক শ্রেণিতে পরিণত হলো এবং আবার শুরু হলো শ্রেণি সংগ্রাম। বুদ্ধিজীবিরা সংগ্রামে পরাজিত হলো এবং আবার দেখা দিল এক শ্রেণিহীন সমাজ। কিন্তু শোষণ বন্ধ হলো না। নতুন নতুন শ্রেণির উত্থান ও পতন ঘটল কিন্তু কিন্তু শোষণ ক্রমাগত চলতে থাকল। প্রত্যেক সংগ্রামের পর ‘জোর’ নতুন অর্থ গ্রহণ করল। ক্ষমতার লড়াইয়ে বুদ্ধিজীবিদের পতনের পর ধনিক বা পুঁজিবাদী শ্রেণি শাসক ও শোষক শ্রেণিতে পরিণত হলো। বর্তমানে এই শ্রেণিই সর্বোচ্চ সামাজিক মর্যাদা ও রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী। তখন বিশ্বব্যাপী এক অর্থনৈতিক শ্রেণি সংগ্রাম চলছে। বর্তমানে একজন হারকিউলিস, ভীম বা রুস্তমের কোনোই গুরুত্বই নেই। একইভাবে, একজন পিথাগোরাস, নিউটন বা এডিসনের কাজ হচ্ছে, পৃথিবীকে শোষণ করার জন্য মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র উৎপাদনে তাদের প্রতিভা ধার দেয়া। আগের শ্রেণি সংগ্রামের মতো এই শ্রেণি সংগ্রামেও দরিদ্র জনসাধারণ জয়ী হয়েছে এবং পৃথিবীর এক ষষ্ঠমাংশে তাদের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। এসব স্থানে শ্রেণিহীন সমাজ গঠিত হয়েছে, তবে কেবল এই অর্থে শ্রেণিহীন যে আর্থিক সম্পদের ওপর ব্যক্তির অধিকারকে এখন জোর বা শোষণের হাতিয়ার বলে বিবেচনা করা হয় না। শ্রেণি সংগ্রাম ও শ্রেণিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা অবিরত চলতে পারে কিন্তু শোষণও চলতে থাকবে এবং পুরনোর জায়গায় নতুন নতুন শ্রেণি গড়ে উঠবে। ‘জোর’ এর তাৎপর্য ক্রমাগত পরিবর্তিত হতে থাকবে এবং যে পর্যন্ত মানুষের শোষণপ্রবৃত্তির মূলোৎপাটন করা না হবে, সে পর্যন্ত ‘জোর যার মুলুক তার’ ই থাকবে।

ব্রাক্ষ্মণ বা ধার্মিকরা এবং বুদ্ধিজীবিরা তাদের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল তাদের চরিত্র ও বুদ্ধিবলে, ক্ষত্রিয় বা শারীরিক শক্তিধরেরা তাদের তলোয়ারের জোরে, বৈশ্য বা পুঁজিপতিরা তাদের সম্পদের জোরে। এখন শূদ্র বা দরিদ্র জনগণ প্রতিষ্ঠা করেছে তাদের নিজস্ব একনায়কত্ব তাদের সংখ্যার জোরে এবং বলপ্রয়োগে অন্যদের উচ্ছেদ করে। যদি দার্শনিক ও বিজ্ঞানী প্রমুখ বিশ্বের বুদ্ধিজীবিরা রাজনীতির ক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধ হয় তবে ব্রাক্ষ্মণদের একনায়কত্ব আবার প্রতিষ্ঠিত হবে। এভাবে ক্ষমতা একশ্রেণি থেকে আরেক শ্রেণিতে বৃত্তাকারে ঘুরতে থাকবে। কিন্তু যতদিন পর্যন্ত একে অন্যকে শোষণ করার প্রবৃত্তি মানুষের মধ্যে জীবন্ত থাকবে ততদিন পর্যন্ত অবস্থার পরিবর্তন হবে না। বার্ট্রান্ড রাসেল ‘রোড টু ফ্রিডম’ বইতে বলেছেন, শূন্যতাপন্থী জড়বাদের ভাষ্যকার কার্ল মার্কস বিশ্বাস করেন যে, দরিদ্র জনগণের একনায়কত্ব অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু তিনি একথা কোথাও বলেননি যে, এটা মানবজাতির জন্য কল্যাণকর হবে। শোষণ প্রবৃত্তি মানুষের অন্তর থেকে উৎসারিত হয় এবং শ্রেণি সংগ্রাম হচ্ছে, মানুষের অন্তরের অহমিকা ও পরার্থিতার মধ্যে সংগ্রামের বহিঃপ্রকাশ। ব্যক্তিদেহের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও ইন্দ্রিয়ের মতো বিভিন্ন শ্রেণি ও গোষ্ঠি বিদ্যমান থাকবে। শান্তিপূর্ণ জীবনের পক্ষে উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টির জন্য প্রয়োজন দেহের বস্তুগত সমস্যাগুলোর সমাধান করা। কিন্তু শুধু রক্তমাংসে সমস্যাগুলো সমাধান করলেই শ্রেণিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে না। এর জন্য প্রয়োজন শ্রেণি-অহমিকা ও শ্রেণি-সচেতনতাকে কার্যকরভাবে বিলোপ করা। এটা অর্জন করা যেতে পারে আল্লাহর পিতৃসুলভ প্রভুত্ব ও মানুষের ভ্রাতৃত্বের ওপর সক্রিয় বিশ্বাসের মাধ্যমে মানব চরিত্রের মহৎ গুণাবলির বিকাশ ঘটিয়ে। যা প্রয়োজন তা সমাজ দেহের যে কোনো একটি অঙ্গ কেটে বাদ দেয়া নয়, তা হচ্ছে, সাধরণ মঙ্গলের জন্য এদের সমন্বয়করণ।

আবুল হাশিমের ‘ইসলামের মর্মকথা’ বই থেকে পুনর্মুদ্রণ করা হলো