সংস্কৃতির সংকট নেই, সংকট নিজেই সংস্কৃতি

পর্ব ১৩

প্রকাশিত : জুন ০২, ২০১৮

মেহেদী উল্লাহ বর্তমান প্রজন্মের একজন মেধাবী গল্পকার। তার ভাষা যেমন কারুকাজময়, তেমনই চিন্তায় রয়েছে প্রথা ভেঙে নতুন কিছু তৈরির আয়োজন। গেল মেলায় প্রকাশিত হয়েছে প্রথম উপন্যাস গোসলের পুকুরসমূহ। প্রকাশিত গল্পের বই চারটি। স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন জেমকন তরুণ কথাসাহিত্য পুরস্কার ২০১৩। কবি ও কথাসাহিত্যিক আবু তাহের সরফরাজ তার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গপসপ করেছেন। প্রতি শনিবার ধারাবাহিকভাবে সেসব কথামালা প্রকাশ করা হবে:


সরফরাজ: `সংস্কৃতি` বিষয়ক লেখায় আপনি একটি টার্ম ব্যবহার করে থাকেন, সেটা হচ্ছে `সংকট-সংস্কৃতি`। এ সংকট কি সংস্কৃতির সংকট?

মেহেদী: না না ভাই, সংস্কৃতির সংকট নয়। আমি বলতে চাই, সংকট নিজেই সংস্কৃতি। এদেশের মতো অনেক দেশেই এ চর্চা বহমান। সংকট এখানকার জীবনাচরণের অংশ। জাতীয় জীবন কিম্বা লোকজীবন— সবখানেই সংকট নিজেই একটা আচারে পরিণত হয়েছে। এবং সংকটকে সংস্কৃতি বলার বড় যুক্তি হচ্ছে, সেটা এমনভাবে এখানকার জীবনের অংশ হয়ে গেছে যে, মানুষ সেটাকে আর অস্বীকার করতে পারছে না, যেভাবে অন্য সংস্কৃতিও অবধারিতভাবে জীবনেরই অংশ। সংকটকে তখনই আমি সংস্কৃতি বলতাম না যখন দেখতাম, এটাকে মোকাবেলার চেষ্টা হচ্ছে। বরং এখানকার মানুষ সংকটকে নিজেদের জীবনের সাথে অকৃত্রিমভাবেই মিশিয়ে নিয়েছে। নিম্নবর্ণের হিন্দুরা মুসলমান হওয়ার কারণে অথবা হিন্দুরা বৈষ্ণবমত গ্রহণের কারণে বা একেশ্বরবাদ গ্রহণে অথবা হিন্দু-মুসলমান বাউল হয়ে যাওয়ায় যেমন নতুন কিছু চর্চার মধ্যে যেতে হয়েছে, তেমনি সংকটও এখানকার জীবনে নানা চর্চার ফল হিসাবে বহমান থেকেছে। পূর্ববাংলা ও বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলেই সেটা অনুধাবন করা যায়। একের পর এক রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, রাজনৈতিক অস্থিরতা, স্বৈরশাসন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, মূল্যবোধের অভাব, দৃষ্টিভঙ্গির সমস্যা, উগ্রবাদ ও মৌলবাদ, উত্তর ঔপনিবেশিকতাসহ নানা কারণে সংকট একটা চর্চায় পরিণত হয়েছে। যুগের পর যুগ এটা চলছেই। ফলে অনেক দেশের মতো এখানেও সংকট নিজেই সংস্কৃতি। বাংলাদেশের ছোটগল্প নিয়ে একটা কাজ করার সময় এটি আমি প্রথম খেয়াল করি। খেয়াল করলাম, পঞ্চাশ থেকে আশির দশক পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ের গল্পে অন্যান্য সংস্কৃতির মতোই সংকটও একটা সংস্কৃতি। দশকের পর দশক চলে যাচ্ছে, সংকট আরো গভীরভাবে মানুষের জীবনে মিশে গেছে। গল্পকাররা শহর ও গ্রামের গল্প শুনিয়েছেন, কিন্তু অবচেতনেই তারা গল্পের মধ্যে এ চর্চাকে উপস্থাপন করে গেছেন। ফলে সংস্কৃতির সংকট একটি আলাদা আলোচনা। যেটা একটি দেশে ভিন্ন ধর্ম, লিঙ্গ, বৈষম্য, রাজনৈতিক দলের ইডিওলজি ইত্যাদি কারণে তৈরি হয়ে থাকে। কিন্তু সংকট নিজেই সাংস্কৃতিক টুল, যেমনটি ভাষা, ধর্ম, উৎসব ইত্যাদিও। উন্নয়নশীল বা অনুন্নত দেশে সংকট নিজেই সংস্কৃতি, যেখানে উন্নত দেশে একে মোকাবেলা করে জীবন থেকে নির্মূল করা হয়। সেখানে সংকট জীবনে দীর্ঘমেয়াদি বা স্থির প্রভাব ফেলতে পারে না বলে সংস্কৃতি নয়।

সরফরাজ: সংকটকে এভাবে বোঝার চেষ্টা আর কারো মধ্যে দেখিনি, সে হিসাবে এটাকে আপনার মৌলিক ভাবনা হিসাবে স্বীকৃতি দিতে বা এটাকে থিওরিটিক্যালি প্রমাণ করতে শক্তপোক্ত কাজ নিশ্চয়ই আমরা আশা করতে পারি।

মেহেদী: ক’মাস আগে হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিনে আমি একটা লেখা লিখেছিলাম পত্রিকায়। লেখাটার বিষয় ছিল, `অসুখী জাতির সুখী হুমায়ূনের গল্প`। আমার মনে হয়, তিনিও বুঝতে পেরেছিলেন এখানে সংকট একটা বহমান চর্চা। ফলে সেই অসুখী মানুষদের তিনি জীবনভর হাসানোর বা বিনোদন দেয়ার চেষ্টা করে গেছেন। তার লেখাপত্রে জীবনের নানা সংকটকে হাসির ছলে, তামাশাভরে বা সংকটের কেন্দ্র থেকে সরিয়ে পরিবেশন করা হয়েছে। সংকট থেকে উত্তরণের কোনো প্রচেষ্টা দেখানো হয়নি, যে যে সংকটে আছে সেটা নিয়ে মশকরা করছে। এতে বুঝতে পারি, তিনি এখানকার সংকটকে সংস্কৃতি হিসেবেই পর্যবেক্ষণ করেছেন। হুমায়ূন আজাদ বাঙালির মানসিক সংকটগুলোকে চিহ্নিত করেছেন, যা স্বভাবের মধ্যে মিশে আছে, যা তারা সংস্কৃতির মতোই লালন করছে, আচারের মতো পালন করছে। এভাবেই অনেকেই সংকট নিয়ে বললেও সংকটের সংস্কৃতি নিয়ে নির্দিষ্ট করে কিছু বলেননি। আমি বিচ্ছিন্নভাবে বলছি, একটা আর্টিকেল লিখেছি, `বাংলাদেশের ছোটগল্পে লোকজীবনের সংকট-সংস্কৃতি` শিরোনামে। একটি টেলিভিশনে এই শিরোনামেই এককভাবে বলেছি প্রায় ত্রিশ মিনিট। সামনে তাত্ত্বিকভাবে প্রমাণের জন্য পরিকল্পিত কয়েকটি কাজ করব। এ সংকট দীর্ঘকাল থেকে বহমান হওয়ায় কখনো প্রভূত উন্নয়নের কারণে যদি জীবন থেকে এ সংস্কৃতি হারিয়েও যায়, তবে মানসিকভাবে কমপক্ষে আরো দুশো বছর ভুগবো আমরা। এসব নিয়ে কয়েকটি আর্টিকেল লিখব। ঐতিহ্যিকভাবেই এটা ছিল, `চর্যাপদ`ও কিছু সংকট হাজির করেছে যা এখনো বর্তমান।

সরফরাজ: কিন্তু সংকট তো থাকবেই, জীবন থাকলে?

মেহেদী: তা থাকবেই। সেজন্য সংকটের সংস্কৃতিও বহমান। কিন্তু সংকটের বাইরের অন্যদুটি শব্দকেও এ ফুসরতে আলাদা করে নিতে হবে। `সংস্কৃতির সংকট` এবং `অপসংস্কৃতি`। সংস্কৃতির সংকট  ও অপসংস্কৃতি বলতে কিছু নেই। সংস্কৃতি বিভিন্ন রকমের। সেটা দেশে দেশে আলাদা। আমাদের দেশের সাথে যদি কোনো সংস্কৃতি খাপ না খায় তবে আমরা সেটাকে অপসংস্কৃতি বলতে পারি না। এ শব্দ দিয়ে অন্যদেশের সংস্কৃতিকে অসম্মান জানানো হয়। অপভাষা বলতে যেমন কিছু হয় না, যতই গালি হোক তা অন্যের মায়েরই ভাষা, সম্মানের, তেমনি সংস্কৃতিও সম্মানের। সংস্কৃতি যতই খারাপ হোক, সেটা সংস্কৃতিই। সংস্কৃতির সংকট বলতেও কিছু নেই। সংস্কৃতি একটা ন্যায্য ধারায় বহমান, মানুষের সভ্যতা সেটাকে যেদিকে নিয়ে যায় সেদিকেই যায়। কিন্তু সংকট নিজেই সংস্কৃতি, সেই সংকট যখন বড় পরিসরে দেখা দেয়, তখন তা সভ্যতারই সংকট। সংকট সংস্কৃতির অধিকতর চর্চা হতে হতে সভ্যতা সংকটে পড়ে যায়। একই সময়ে একই দেশে ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি অবস্থান করতে পারে। কেউ মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলে আবার কেউ মাটিতে সমাহিত করে। কিন্তু মানুষ মানুষকে হত্যা করে খায়, এমন সভ্যতা আর আসবে না। যদি আসে, সেটা সভ্যতার সংকট। যুদ্ধ সভ্যতার সংকট, কিন্তু জন্মগতভাবে মানুষ প্রতিশোধ পরায়ন কিংবা হিংসা, ক্রোধ এসবের যে চর্চা তা অপসংস্কৃতি নয়। এসবও জাতির সংস্কৃতির অংশ। কিন্তু সেই সংকটের সংস্কৃতি বাড়তে বাড়তে সভ্যতার সংকটের জন্ম দেয়। সংস্কৃতির সংকট নেই, চাইলেই সেটা পরিবর্তন করে নেয়া যায়, সংস্কৃতি পরিবর্তনশীল, কিন্তু সভ্যতার সংকট মেটানো কঠিন, একটি সভ্যতা গড়ে উঠলে পরবর্তী আরো উন্নত সভ্যতাই পারে তাকে পরিবর্তিত  করতে, বিলীন করতে। আরেকটি নতুন সভ্যতা আসা পর্যন্ত সভ্যতার সংকট জারি থাকে। কিন্তু যতই নতুন সভ্যতা আসুক না কেন, মানুষের সংকটের সংস্কৃতি থাকবেই। এটাই প্রাকৃতিক।

চলবে