সাহিত্য ছাড়াই ব্যক্তি তার দিনগুলো কাটিয়ে ফেলতে পারছে

শেষ পর্ব

প্রকাশিত : জুন ৩০, ২০১৮

মেহেদী উল্লাহ বর্তমান প্রজন্মের একজন মেধাবী গল্পকার। তার ভাষা যেমন কারুকাজময়, তেমনই চিন্তায় রয়েছে প্রথা ভেঙে নতুন কিছু তৈরির আয়োজন। গেল মেলায় প্রকাশিত হয়েছে প্রথম উপন্যাস গোসলের পুকুরসমূহ। প্রকাশিত গল্পের বই চারটি। স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন জেমকন তরুণ কথাসাহিত্য পুরস্কার ২০১৩। কবি ও কথাসাহিত্যিক আবু তাহের সরফরাজ তার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গপসপ করেছেন। প্রতি শনিবার ধারাবাহিকভাবে সেসব কথামালা প্রকাশ করা হবে:

সরফরাজ: লেখক হিসেবে শিল্প-সাহিত্যের বিভিন্ন তত্ত্বগুলোকে কে কীভাবে মোকাবেলা করেন? মানে, লেখার সময় তত্ত্ব দ্বারা আপনি কি প্রভাবিত থাকেন?
মেহেদী: লেখার বাইরে আমার অধীত বিষয়গুলোর মধ্যে `থিওরি` অন্যতম। শিল্প-সাহিত্যকে ব্যাখ্যার জন্য তত্ত্ব প্রয়োজন। তত্ত্ব না থাকলে শিল্প কেবলই শিল্পের জন্য হয়ে পড়ত। তত্ত্ব সাহিত্যকে জীবন-সমাজ-রাষ্ট্র-পুঁজি ইত্যাদির সাথে সম্পর্কিত করে তোলে। তত্ত্ব হচ্ছে সাহিত্যের সোনার কাঠি-রুপার কাঠি। সাহিত্যের চেতনা জাগায়, জাগিয়ে একে তার ঘুমতুল্য স্থবিরতা থেকে মুক্তি দেয়। তাত্ত্বিক সেই রাজপুত্র, যে রাজকন্যাকে অর্থহীন জগত থেকে উদ্ধার করে আনে। আমি ঠিক বুঝাতে পারলাম কীনা আপনাকে, জানি না। কিন্তু লেখা চলাকালীন লেখকের সাথে তত্ত্বের সম্পর্ক ভিন্নতর। সাহিত্যের আঙ্গিকের সাথে জড়িত তত্ত্বগুলো আমাকে সচেতন রাখে যে, আমি কীভাবে সেগুলোর মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। আবার সময় বা যুগের সাথে সম্পর্কিত তত্ত্ব এই সচেতনা জিইয়ে রাখে যে, আমি লেখায় সময়ের পাল্টে যাওয়া পরিস্থিতি বিষয়ে সচেতন থাকতে পারছি কীনা।

সরফরাজ: কী রকম?
মেহেদী: যেমন ধরেন, আমি গল্পে খুব কমই অ্যাবজার্ডইজমের চর্চা করি, সচেতনভাবেই বিমূর্ততা পরিহার করি। আবার প্রতিবেশের প্রয়োজনেই সুররিয়ালিস্ট ভঙ্গি এসে পড়ে, কখনো কোনো পরিস্থিতি বর্ণনার ক্ষেত্রে। ইম্প্রেশনিজম আসে চরিত্রের গভীরতার জন্য। ইচ্ছে করেই প্রতীকবাদের রাস্তা পরিহার করতে হয় যখন সরাসরি কিছু বলব। প্রতীকের আশ্রয় নিই তখনই যখন এমন বাস্তবতা তৈরি হওয়ার সুযোগ আছে, যা গল্পের থিমের সাথে সমান্তরাল থাকে। আর সময়ের কথা যেটি বললাম, আমি উত্তর-ঔপনিবেশিক পরিস্থিতি নিয়ে খুবই সজাগ। সবসময় বিউপনিবেশায়ন সমর্থন করে, সেরকম সর্ব্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করি। উত্তর-ঔপনিবেশিক সময়ের সচেতনা আমাকে উত্তর-আধুনিকতার হিসাব রাখতে সাহায্য করে। আসলে লেখার সময় এগুলো অবচেতনে কাজ করে, এমন না আপনি তত্ত্বের ঝুড়ি নিয়ে বসে থাকবেন। আর আপেলের মতো খাবেন। খুবই সূক্ষ্ম এই প্রক্রিয়া। তত্ত্বের সাথে দীর্ঘদিনের পরিচয়ে সেগুলো অবচেতনে অবস্থান করে সেন্সরশিপের কাজ করে। এই সময়ে সাহিত্য সৃষ্টি করতে গেলে অবশ্যই বিউনিবেশি ধারণা রাখা উচিত, না-হয় উপনিবেশের প্রভাব নানাভাবে কী-বোর্ডেই থাকে, সেগুলো চলেও আসতে পারে, কিন্ত ব্যাকস্পেস দিয়ে মুছে ফেলতে হয়। সময়ের এই সচেতন পরিস্থিতি আপনাকে নিজ রাষ্ট্রের কাছেও ভুলভাবে উপস্থাপিত করতে পারে। যখন এমন পরিস্থিতিকে ব্যাখ্যা করার সুযোগ তৈরি হয় যে, নিজ দেশেই নাগরিক কর্তৃপক্ষীয় উপনিবেশের শিকার। এছাড়া সময়ের আরো পাহারাদারি আছে, যেমন, নারীবাদ, বিচ্ছেদ এগুলো। বিচ্ছেদ তত্ত্ব না, কিন্তু এখনো এখানকার লেখালেখিতে বিচ্ছেদকে রাধার বিরহ দিয়ে বিচার করা হয়। সেই বাস্তবতা আছে কীনা, দেখতে হবে। যখন বলা হয়, শোকের আয়ু একটা ফেসবুক স্ট্যাটাস! ফলে তত্ত্বের প্রভাব লেখক এড়াতে পারেন না। তত্ত্ব শিল্প-সাহিত্যের ওষুধ, লেখককে ডাক্তারের ভূমিকা পালন করতে হয়।

সরফরাজ: কখনো কী মনে হয়েছে, তত্ত্ব সৃজনশীলতার জন্য ক্ষতিকর?
মেহেদী: তত্ত্বের রকমফের আছে। যেসব শিল্প-আন্দোলন তত্ত্বের জন্ম দিয়েছে, যেমন দাদাবাদ, হাংরি ইত্যাদি, এসব আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতা এদেশে আছে কি? কেউ যদি দাদাবাদীদের মতো কবিতার চর্চা করে, এর তো দেশীয় লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও প্রেক্ষাপট থাকতে হবে? আবার আপনি শুধু পরাবাস্তবতার ঘেরাটোপে পড়ে ওই জাতীয় কবিতায় বুঁদ হয়ে থাকলেন সেটাও অস্বাভাবিকতা। কিন্তু যে তত্ত্ব সময় ও সত্যকে নতুন করে ব্যাখ্যা করে, সেসব নিয়ে অসচতন থাকার উপায় নেই। এসব অসচেতনতা সাহিত্যকে পঙ্গু ও বিপন্ন করে তুলতে পারে। বলা হচ্ছে, উত্তরাধুনিক সাহিত্য! এখানে পুঁজির বিকাশ না হয়ে থাকলে সেই প্রতিবেশই তৈরি হয়নি, তবে উত্তরাধুনিক সাহিত্য কাকে অবলম্বন করে তৈরি হবে— এটা তত্ত্বের ক্ষতির দিক, অবশ্যই। জোর করে চরিত্র দিয়ে সেই প্রবণতা আদায় করা কি ঠিক? সাহিত্য ও সমাজ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিপরীতমুখী। সাহিত্য তখনই প্রয়োজনীয় হয়ে উঠে। তখন বিনোদনের ভঙ্গিতেও সাহিত্য সৃষ্টি করে সমাজ নিয়ে নাড়াচাড়া করা যায়। যদিও সমাজ সেসব আমলে নেয় না কখনোই।

সরফরাজ: এ সময়ে বাংলাদেশে সমালোচনা-সাহিত্য বলতে কিছু আছে কি? থাকলে তা কীরকম বলে আপনি মনে করেন?
মেহেদী: সমালোচনা-সাহিত্য নয়, বরং সাহিত্যের উপযোগিতা কমে গেছে এখানে। সাহিত্যের আগে কমে গেছে চিন্তার উপযোগিতা। সাহিত্য আর চিন্তা ছাড়াই ব্যক্তি তার দিনগুলো কাটিয়ে ফেলতে পারছে। এজন্য তাকে কোনো মাশুল দিতে হচ্ছে না। ফলে ব্যক্তির জীবনে সাহিত্যের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিচ্ছে না। এর কারণ, ব্যক্তি কীভাবে চলবে, কী করবে সে দায়িত্ব আরো অনেক কিছু নিয়ে নিয়েছে। তার মধ্যে একটা হচ্ছে, পণ্য। পণ্যের বিজ্ঞাপনগুলো ব্যক্তির জীবনের যাত্রা ও উদ্দেশ্য ঠিক করে দিচ্ছে। আমাদের এখানে সাহিত্য এখনো পণ্য হয়ে উঠতে পারেনি। সেটা খুব দরকার, পণ্য সংস্কৃতিতে সাহিত্যকেও পণ্য হিসাবেই কার্যকর থাকতে হয়। না হয় উপযোগিতা হারায়।  সাহিত্য `আত্মার খোরাক`, `মননের বিকাশ ঘটায়`, এসব বুলি ঠিক আছে, কিন্তু অবশ্যই ফ্রিতে নয়, ফ্রিতে বা পণ্য-সংস্কৃতির বাইরে গিয়ে বললে সে বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে, সম্মতি উৎপাদনে অক্ষম হবে। পুঁজি চায় মূল্যের বিনিময়ে সেবা দিতে, জৈবিকতাকে সে অস্বীকার করে। ফলে সাহিত্যকেও পণ্যই হতে হবে। এমনিতেও দশ সেকেন্ডের একটা বিজ্ঞাপনী গল্পের কাছে হেরে বসে আছে সাহিত্যের গল্প। বিজ্ঞাপনের গল্পের কাছে মানুষের প্রথম প্রত্যাশা, সেটি যেন তার বিরক্তি উৎপাদন না করে। দ্বিতীয়ত, তাকে আনন্দ দেবে। যে বিজ্ঞাপন ব্যক্তিকে খরচার রাস্তায় হাঁটায়, তার কাছে ব্যক্তির প্রত্যাশা ওইটকুই। বিজ্ঞাপন যে বিশ্বাস তৈরি করে দেয়, সে বিশ্বাস দ্বারা ব্যক্তি পণ্য কিনছে, সেটাকেই যথাযথ জীবননির্বাহ ভাবছে। সেই বিশ্বাস সাহিত্যেরও অর্জন করেই টিকে থাকতে হবে। পুঁজির বিরুদ্ধে চেতনা উৎপাদনকারী সাহিত্যকেও পুঁজির সিস্টেমের ভেতর দিয়েই ক্রেতার হাতে পৌঁছাতে হবে। ব্যক্তি তার মননের ভারও পণ্যের উপর দিতে চায়, এখন সেই অভ্যাস ও চর্চার মধ্যেই সে আছে, তাই সাহিত্যকে বা এর মাধ্যমগুলোকে পণ্যই হয়ে উঠতে হবে। যে যে পণ্যের মাধ্যমে ব্যক্তির জীবন নির্বিঘ্নে আর নিশ্চিন্তে অতিবাহিত হয়ে যাচ্ছে বলে ব্যক্তির ধারণা, সেই ধারণার মধ্যেই সাহিত্যের ফর্মগুলোকে বিন্যস্ত করতে হবে।

চলবে