রিফাত বিন সালাম

রিফাত বিন সালাম

সিপিবি ঝোঁক

রিফাত বিন সালাম

প্রকাশিত : জুলাই ২১, ২০১৮

নব গঠিত "বাম গণতান্ত্রিক জোট"-এর কমরেডরা এ আলাপ এড়িয়ে যাবেন এমনটাই ধারণা। জটিল প্রশ্ন এড়িয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার এই চেষ্টাকে "সিপিবি ঝোঁক" বলা যেতে পারে। ঐতিহাসিকভাবে সিপিবি থেকেই এই চরিত্র পেয়েছে বাংলাদেশের বাকি বামেরা। ফলে জটিল প্রশ্ন সামনে এলেই "যান ভাই, আপনারা করেন গিয়ে" এমন মুখস্ত বাণী যথার্থ।

 

বাংলাদেশের বামপন্থী আমেজের সবচেয়ে বড় দল সিপিবি। ফলে যে কোনো বাম জোটে সিপিবি থাকা মানেই তারা যে কোনো আন্দোলনে প্রভাব ফেলবেই। আর সেটা ঐতিহাসিকভাবেই আওয়ামীলীগের পক্ষেই যাবে। যেমন গিয়েছিল আইয়ুবের পক্ষে। এমনকি, এরশাদের হুমকির মুখে পার্লামেন্টের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে সামরিক শাসনকে বৈধ করার সহায়তা করে এবং সামরিক সরকারের হাতে অধিকাংশ আসন প্রদানের জাল নির্বাচন সমাপ্ত হবার পর ‘অর্জিত বিজয় সংহত করার জন্য’ বারবার আহ্বান জানিয়েছিল এই সিপিবি। নিজেদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব বিলুপ্ত করে এরা বাকশালেও যোগ দিয়েছিল!

 

"মৌলিক গণতন্ত্রী নির্বাচনে তাদের অংশগ্রহণ সম্পর্কে তাদের মূল্যায়ন হচ্ছে “সেই সময় ১৯৬৮ সালে পরিস্থিতি বিবেচনা করে পার্টি মৌলিক গণতন্ত্রী নির্বাচন বর্জনের সম্ভাবনা দেখে নাই, তাই নির্বাচনকে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনার নীতি গ্রহণ করেছিল।”১ ‘ক্ষমতাসীনদের কোন কর্মসূচী বর্জনের সম্ভাবনা দেখা’ সিপিবি’র ইতিহাসে খুবই বিরল। তবে এটাও তাদের ক্ষেত্রে সবসময় ঘটেছে যে, পরবর্তীতে তারা যখন তাদের এই আন্দোলনের হাতিয়ারকে ভগ্ন বিধ্বস্ত হিসেবে আবিষ্কার করেছেন তখন তারা একে ‘ভুল হয়েছিল’ বলে বর্ণনা করেছেন কিন্তু এতে তাদের মৌলিক তত্ত্বগত অবস্থানের কোন পরিবর্তন হয়নি।" (সিপিবি’র রাজনীতি এবং লেজুড়বাদ- অধ্যপক আনু মুহাম্মদ)

 

২০১৫ সালের কথা। সুন্দরবনের রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরোধিতা চলছে, প্রতিদিনই মিছিল হচ্ছে, ওই দিনও একটা প্রতিবাদ সমাবেশ ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে (সম্ভবত বটলার একটা নাটকও ছিল)।

 

ওই সময় বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি সভাপতি এক বিবৃতিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশে আগমনকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, "মোদীর এই সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের পারস্পরিক সমমর্যাদাভিত্তিক বন্ধুত্ব, সহযোগিতা, সৌহার্দ বাড়ানো প্রয়োজন। এই প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসী তৎপরতা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে।"

 

সিপিবির এই আজব তত্ত্ব শুনে যারা তখন হাসাহাসি করেছিল তারাও দেখছি এখন একই জোটে। তাহলে কি সিপিবি তার আগের লেজুড়বাদী অবস্থান থেকে মহান কোনো তত্ত্ব নাজিল করেছে! নাকি সেই একই অবস্থানে আছে? সেটার ব্যাখ্যা এখনো দেয়া হয় নাই জোটের পক্ষ থেকে।

 

মাত্র মাস দুই আগেও সিপিবি নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন,"প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে একটি শক্তিশালী চক্র অদৃশ্য দেয়াল তৈরী করছে।" (দৈ যুগান্তর,৫-৬-১৮)

 

রমজান মানে সিপিবি সভাপতি সরকারি ইফতার করেছে তার দুইদিন পর সরকারি বাহিনী গুলি চালিয়েছে ছাত্র ইউনিয়নের মিছিলে! তবুও নিজেদের চরিত্র একই রেখেছে দলটি।

 

সেই ১৯৮৬ সালে ‘সংস্কৃতি’ পত্রিকায় অধ্যপক আনু মুহাম্মদ "সিপিবি’র রাজনীতি এবং লেজুড়বাদ" বিষয়ক দুর্দান্ত একটা লেখা প্রকাশ করেছিলেন। যদিও এখন অধ্যপক আনু মুহাম্মদের মতো মানুষকেও গালিগালাজ/ভুল প্রমাণ করতে দ্বিধাবোধ করে না এরা।

 

দুই যুগ আগেও বাংলাদেশের বাম দলগুলো বাম-গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠন করেছিল। কিন্তু শুধুমাত্র নির্বাচন কেন্দ্রিক জোটের ক্ষেত্রে যা তাই হয়েছিল। সিপিবিও জোটে ছিল। ওয়ার্কার্স পার্টিসহ কয়েকটি দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জোটে গিয়ে ভেড়ে। আর "সিপিবি"র মতো দলগুলো নির্বাচন শেষে আবার আওয়ামী লীগের পক্ষে চলে যায়।

 

আবারো আনু মুহাম্মদের কিছু লাইন কোট করা যাক-"আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও দলের ভাঙনের সময়ে পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই তারা জনগণ ও কর্মীদের বোঝানোর জন্যই যে এসব কথা বলেছে তা তাদের পরবর্তী অভিন্ন কার্যক্রম থেকেই স্পষ্ট হয়। জিয়াউর রহমান সরকারের ১৯ দফা কর্মসূচিতেও তারা এ সরকারের প্রগতিশীলতার উপাদান দেখে এবং এই কর্মসূচির অংশ হিসেবে খালকাটা, গণভোট, সংবাদ নির্বাচন কর্মসূচিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। ‘শক্তির ভারসাম্য’ তাদের সব কাজের মহান যুক্তি। এ কাজেও তাদের এ যুক্তির অভাব হয়নি। তাদের ‘শক্তির ভারসাম্য’ এবং ‘বাস্তব আন্দোলনগত’ অবস্থা দিয়ে এরপরও এই সংগঠন এরশাদের সামরিক শাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের গণআন্দলনকে বিচার করে এবং একভাবে ২১শে মে’র চুক্তির ভয়ানক বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে শ্রমিকশ্রেণীর জাগরণকে পেছন থেকে ছুরিকাঘাত করে।৮ এবং ব্যাপক গণআন্দোলনকে ৫ দফার আন্দোলন অর্থাৎ বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ও নেতৃত্বের অধীনস্ত রাখায় সবচাইতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।৯ তারা এরশাদের হুমকির মুখে পার্লামেন্টের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে সামরিক শাসনকে বৈধ করার সহায়তা করে এবং সামরিক সরকারের হাতে অধিকাংশ আসন প্রদানের জাল নির্বাচন সমাপ্ত হবার পর ‘অর্জিত বিজয় সংহত করার জন্য’ বারবার আহ্বান জানাতে থাকে। ৫ দফার স্বাভাবিক এই পরিণতিকে ৫ দফা ও জনগণের বিজয় হিসেবে আখ্যায়িত করায় তাদের কোন কুণ্ঠা হয়নি। কয়েক বছর পর সম্ভবতঃ তারা একে ‘অতিরিক্ত আশাবাদ’ ‘কিছুটা ভুল’ ইত্যাদি বলে নিজেদের গা বাঁচানোর চেষ্টা করবে।

 

সিপিবি এবং সিপিবি কেন্দ্রিক রাজনৈতিক চিন্তার ফলে প্রতিবারই আওয়ামীলীগ বা আইয়ুব বা এরশাদের আরো শক্তিশালী করে তোলে। আসন্ন নির্বাচনে এই বাম জোট আবারো আওয়ামীলীগকে কাঙ্ক্ষিত সফলতা এনে দেবে। নির্বাচনকে জনগণের সামনে বৈধতা দেবে। সিপিবি সম্ভবত তার প্রধান রূপকার। যারা এখনো সমাজতন্ত্র নিয়ে সামান্য আশাবাদি তাদের উচিত সিপিবি বয়কট করা, সেটা জোটে হোক বা ভোটে।

 

অধ্যপক আনু মুহাম্মদের কিছু লাইন দিয়েই শেষ করা যাক, "সিপিবি’র মূল ভূমিকা সেজন্যেই দাঁড়ায় শ্রমিক কৃষক সহ শ্রমজীবী জনগণের মধ্যে শ্রেণীসংগ্রামের কথা বলে তাদেরকে অর্থনৈতিক দাবীদাওয়ার আন্দোলনে সমবেত করে তাদের অন্তর্নিহিত শ্রেণীগত শক্তিকে বুর্জোয়ার্দের ক্ষমতা ভাগাভাগির কাজে বলি দেয়া। এর ফলাফল অবশ্যম্ভাবীরূপে দাঁড়ায় সেই শ্রমিক কৃষক শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর, হতাশা এবং সমাজতন্ত্রের আন্দোলনের প্রতি অনীহা। এভাবেই সিপিবি রেডফ্ল্যাগ দিয়ে রেডফ্ল্যাগের বিকাশকে রুদ্ধ করার সংগ্রাম করে